সূর্য তখনো পুব আকাশে উঁকিঝুঁকি মারছে। বসুন্ধরা কিংস স্পোর্টস কমপ্লেক্সে তখন জনমানুষের দেখা পাওয়া দায়। এর মধ্যেই কমপ্লেক্সের অনুশীলন মাঠের বাইরে থেকে স্পষ্ট ভেসে আসছিল একজনের ভারী কণ্ঠ।
বাংলাদেশ নারী দলের ইংলিশ কোচ জেমস পিটার বাটলার সেই কাকডাকা ভোরেই হাজির তাঁর দল নিয়ে। মেয়েরা বল নিয়ে অনুশীলন করছেন, তার মধ্যেই পিটার বাটলার দিচ্ছেন নানা নির্দেশনা। সাবিনা খাতুন, সানজিদা আক্তার, মাসুরা পারভীন, কৃষ্ণা রানি সরকারদের সামান্য ভুলও বাটলারের চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে না।
নেপালে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ সামনে রেখে চলছে জাতীয় দলের অনুশীলন। এক মাস ধরে ভোর সাড়ে পাঁচটায় মতিঝিলের বাফুফে ভবন থেকে বাসে করে বসুন্ধরা স্পোর্টস কমপ্লেক্সে গিয়ে চলে নারী দলের অনুশীলন। দুই বছর আগে নেপাল থেকেই প্রথমবারের মতো সাফ জিতে ফিরেছিলেন মেয়েরা। ভোরের এই অনুশীলন সেই শিরোপা ধরে রাখার প্রত্যয় বুকে ধারণ করেই।
সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ শুরু হবে ১৭ অক্টোবর থেকে। ২০ অক্টোবর পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচ বাংলাদেশের। দ্বিতীয় ম্যাচটা ফাইনালের মতোই—ভারতের বিপক্ষে, ২৩ অক্টোবর।
যেকোনো অর্জন ধরে রাখা যে কঠিন, সেটি এবার খুব ভালোভাবেই জানেন সাবিনা, সানজিদারা। কণ্ঠে অবশ্য তাঁদের আত্মবিশ্বাসই ঝরল। অতশত ভেবে যে লাভ নেই, সেটি বলেও দিলেন মাসুরা, ‘আমাদের কাজটা ঠিকমতো করতে হবে আসল সময়ে। দেখা যাক কী হয়। যেকোনো টুর্নামেন্টই চ্যালেঞ্জিং।’
দুই বছর আগে নেপালে সাফ জিতে দেশের মানুষকে আনন্দে ভাসিয়েছিল বাংলাদেশ নারী দল। দেশের মাটিতে পা রাখার পর ছাদখোলা বাসে করে পুরো দলকে বিমানবন্দর থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বাফুফে ভবনে। রাস্তার হাজার হাজার মানুষ নারী দলকে অভিনন্দিত করেছিল উৎসব করতে করতেই। কোচ বাটলার দুই বছর আগের ঘটনাপ্রবাহে সময় নষ্ট করতে চান না একেবারেই।
তাঁর কাছে নেপালে এবারের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ নতুন চ্যালেঞ্জ, নতুন এক লড়াই, ‘বাংলাদেশ দুই বছর আগে সাফ জিতেছিল। এটা অতীত। আমি অতীত নিয়ে ভাবতে চাই না। আমি বর্তমানে বাস করি, ভবিষ্যতে কী হবে, সেটা নিয়ে কাজ করি। হ্যাঁ, আমরা শিরোপা জিতেছিলাম। তবে এবার নতুন করে মনোযোগী হতে হবে আমাদের। চ্যালেঞ্জ যা আসবে, তা একেবারেই নতুন।’
দুই বছর আগের তুলনায় দল বদলে গেছে অনেকটাই। সেই দলের কয়েকজন যেমন নেই, তেমনই নতুন কয়েকটি মুখও যোগ হয়েছে। কোচ বাটলার আগেই বার্তা দিয়ে রেখেছেন, তাঁর কাছে ‘চেনা মুখ’ বড় কিছু নয়। মাঠের পারফরম্যান্স, প্রভাবই মূল। গত জুনে দায়িত্ব নিয়েই চীনা তাইপের বিপক্ষে দুটি আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচে তার প্রমাণ রেখেছিলেন।
এক ম্যাচে দলের সবচেয়ে অভিজ্ঞ ফুটবলার, অধিনায়ক সাবিনাকে দ্বিতীয়ার্ধে তুলে নিয়েছিলেন, অন্য ম্যাচে খেলিয়েছিলেন, শেষ ১৩ মিনিট। দলের অন্য পজিশনেও কিছু বদল এনেছিলেন। জুলাইয়ে ভুটানের বিপক্ষে থিম্পুর দুই আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচেও পরীক্ষা-নিরীক্ষা জারি রেখেছিলেন। নেপালে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের আগে বদলে যেতে পারে অনেক কিছুই, সেটি তিনি বলেও দিয়েছেন কথার ফাঁকে, ‘দলে কারও জায়গার গ্যারান্টি নেই।’
প্রতিপক্ষ নিয়েও খুব বেশি চিন্তিত নন বাটলার। যদিও এবার গ্রুপ পর্বেই ‘চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী’ ভারতের মুখোমুখি হচ্ছে বাংলাদেশ, ‘আসলে প্রতিপক্ষ সম্পর্কে খুব বেশি জানা সম্ভব নয়। আমি জানি না, কেমন দল হবে, আপনিও জানেন না, আমি তো মনে করি প্রতিপক্ষের কোচও এখনো স্থির করতে পারেননি তাঁর দল। প্রতিপক্ষ, প্রতিপক্ষের শক্তি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যেতে পারে। ৭৫ ভাগ ধারণা নিয়েই আসলে একে অন্যের বিপক্ষে খেলতে নামে দলগুলো।’
ভোর সাড়ে পাঁচটা থেকে সাড়ে সাতটা—দুই ঘণ্টা চলল কঠোর অনুশীলন। ম্যাচ সিচুয়েশন, ফরমেশন ট্রেনিং, সেটপিস—সবই করালেন কোচ বাটলার। সেই সঙ্গে চলল ব্রিফিং। কোন খেলোয়াড়ের দায়িত্ব কী, কে, কীভাবে প্রতিপক্ষের দিকে প্রেস করবেন, কেউ ওপরে উঠলে, কারা নিচে নেমে প্রতিপক্ষের প্রতি–আক্রমণ সামলাবেন—দৃঢ় কণ্ঠে বাটলার সেগুলোও বুঝিয়ে দিলেন।
তবে কোচের কণ্ঠেও এত বড় একটা টুর্নামেন্ট খেলতে যাওয়ার আগে প্রস্তুতিমূলক ম্যাচ খেলতে না পারার আক্ষেপটা ঝরল, ‘আমার কোনো অভিযোগ নেই, তবে পরিস্থিতি এবার অন্য রকম। তবে প্রস্তুতি ম্যাচ খেলতে পারলে ভালো হতো। আমি ইতিবাচক, আমার হাতে যা আছে, তা–ই নিয়েই আমি ঝাঁপাব। আক্ষেপ করে কোনো লাভ নেই। আমি আমার হাতের রসদ নিয়েই জেতার জন্যই দলকে মাঠে নামাব।’
অনুশীলন শেষ করে তৈরি হয়েই বাসের দিকে ছুটলেন খেলোয়াড়েরা। বাফুফে ভবনে গিয়েই সারবেন সকালের নাশতা। তবে দুই ঘণ্টার কঠোর অনুশীলনের পরও কারও চেহারাতেই ক্লান্তির ছাপ নেই। স্পোর্টস কমপ্লেক্সের অনুশীলন মাঠের পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিল টিম বাস। মাঠের পাশেই বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে কাশবন। শরতের ভোরে মৃদুমন্দ হাওয়ায় কাশবনের সামনে দাঁড়িয়ে মেয়েরা একটু থমকেই গেলেন। কাশফুলকে পেছনে রেখে ছবিটবিও তোলা হলো। এমন চমৎকার কাশবন পেলে ছবি না তুলে কী আর থাকা যায়!