লিওনেল মেসি ও কিলিয়ান এমবাপ্পে
লিওনেল মেসি ও কিলিয়ান এমবাপ্পে

কাতার থেকে উৎপল শুভ্র

‌আর্জেন্টিনা দলে মেসি যেমন, ‌ফ্রান্সে এমবাপ্পে তেমন

আর্জেন্টিনা এখনো মেসিনির্ভর। ফ্রান্স  ক্রমশ সেই পথেই যাচ্ছে। ফ্রান্সের চার ম্যাচের তিনটিতেই এমবাপ্পে ম্যাচসেরা।

সৌদি আরবের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচেই পরাজয়ে হতবিহ্বল আর্জেন্টিনাকে কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছেন মেসি। বিশ্বকাপ যত এগোচ্ছে, ততই যেন খুলছে তাঁর খেলা। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে দ্বিতীয় রাউন্ডের ম্যাচে তো বার্সেলোনার জার্সি গায়ে সেই পুরোনো মেসি। যিনি জ্যামিতির মাপে শট নিয়ে গোল করেন। একের পর এক ডিফেন্ডারকে বিবশ করে এগিয়ে যান অপূর্ব ছন্দে। পোলিশ কোচ সেসওয়াফ মিখনিয়েভিৎসের ভাষায়, ‌‘ইতালিয়ান স্কিয়ার আলবার্তো তোম্বার মতো’।

সাবেক ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ও ইংল্যান্ড ডিফেন্ডার রিও ফার্ডিনান্ড অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে মেসিকে দেখে রীতিমতো মুগ্ধ। এই বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত সেরা একক পারফরম্যান্সের স্বীকৃতিও দিয়ে দিয়েছেন। গ্রুপ পর্বের এমবাপ্পেকে দেখে সেই ফার্ডিনান্ডই আবার ঘোষণা দিয়ে ফেলেছেন, মেসি-রোনালদোকে পেছনে ফেলে এ মুহূর্তে বিশ্বের সেরা ফুটবলার এমবাপ্পে। মনে রাখতে বলি, ফার্ডিনান্ড এ কথা বলেছেন পোল্যান্ডের বিপক্ষে ওই ‘এমবাপ্পে শো’-এর আগেই।

বিশ্ব ফুটবলে মেসি-রোনালদোর যুগল রাজত্ব চলছে সেই কবে থেকে। এরপর কে—এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা শুরু হয়েছে, এটাও কম দিন নয়। দুজনের মাঝখানে উঁকি দিয়েছিলেন নেইমার। কিন্তু তৃতীয় স্থান থেকে আর উত্তরণ ঘটেনি তাঁর। মেসির ছায়া থেকে বেরোবেন বলে বার্সেলোনা ছেড়ে প্যারিস সেন্ট–জার্মেইয়ে এসেছিলেন। এমনই কপাল, তাঁর পিছু পিছু মেসিও কিনা সেখানেই। প্রথম ম্যাচেই চোট পেয়ে এই বিশ্বকাপটা সেভাবে শুরুই করতে পারেননি। আর মেসির তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বী বুঝিয়ে দিচ্ছেন, বয়স শুধুই একটা সংখ্যা নয়। তা কাউকেই ছাড়ে না, এমনকি তিনি ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো হলেও!

আর্জেন্টিনা দলের সাবেক রাইটব্যাক পাবলো জাবালেতা কদিন আগে বলেছেন, তাঁর সময়ে আর্জেন্টিনা দলের প্ল্যান ‌‌‘বি’ বলতে কিছু ছিল না। প্ল্যান ‌‘এ’টা অনুমেয়ই। মেসি পাশে থাকলে ওকে বল দিয়ে দাও। এখনো যে সেই অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন হয়েছে, তা নয়। আর্জেন্টিনা এখনো যতটা মেসিনির্ভর, এই বিশ্বকাপে আর কোনো দলই নির্দিষ্ট কোনো খেলোয়াড়ের ওপর ততটা নয়। তবে ফ্রান্স হয়তো ক্রমশ সেই পথেই যাচ্ছে। এই বিশ্বকাপেই দেখুন না! চার ম্যাচ খেলে তিনটাতেই ম্যাচসেরার ট্রফি এমবাপ্পের হাতে। যে ম্যাচটায় সেরার স্বীকৃতি পাননি, সেটিতে আসলে যথেষ্ট সময় খেলারই সুযোগ পাননি। নেমেছিলেন বদলি হিসেবে। তিউনিসিয়ার বিপক্ষে সেই ম্যাচের ফল নিশ্চয়ই মনে করিয়ে দিতে হবে না।

বিশ্বকাপে ছন্দে আছেন লিওনেল মেসি

একজন ফুটবলার সম্পর্কে যত বিশেষণ ব্যবহার করা সম্ভব, মেসি সম্পর্কে তার সবই ব্যবহার করা শেষ। নতুন কিছু বলা আর সম্ভব নয়। এমবাপ্পেকে নিয়ে সবার যে উচ্ছ্বাস দেখছি, তাতে একসময় তাঁকে নিয়েও এই সমস্যা অবশ্যম্ভাবী বলেই মনে হচ্ছে। পোল্যান্ডের বিপক্ষে দুই গোলের পর নতুন করে যেন সবার মনে পড়ছে, এই ছেলেটার বয়স এখনো ২৪ হয়নি!

গোল দুটিও কি! প্রথমটাতেই যদি কেউ মুগ্ধ হয়ে থাকেন তো দ্বিতীয়টায় হতবাক হয়ে যাওয়ার কথা।  ৪৫ ডিগ্রি কোণ থেকে অমন মায়াবী এক শট। এই ম্যাচের আগে পোলিশ গোলকিপার ভয়চেক সেজনি বলেছিলেন, ‘এমবাপ্পেকে থামানোর উপায়? কেন, আমি!’ তা পারেননি বলে কেউই সেজনিকে খোঁচা দিয়ে কথা বলছেন না। এমবাপ্পের ওই দুটি শট ঠেকানোর ক্ষমতা যে পৃথিবীর কোনো গোলকিপারেরই আছে বলে মনে হয় না।

ম্যাচ শেষে পোল্যান্ডের কোচ সেসওয়াফ মিখনিয়েভিৎস সবার মনের কথাটাই বলে দিয়েছেন, ‌‘এমবাপ্পের এই ফর্মে তাকে থামানোর কোনো রেসিপি নেই।’ তা আরও ভালো বুঝেছেন ম্যাটি ক্যাশ। এমবাপ্পেকে মার্কিংয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল এই পোলিশ ডিফেন্ডারকে। সেই অভিজ্ঞতার যে বর্ণনা দিয়েছেন, তাতে মনে হতেই পারে, এমবাপ্পে অতিজাগতিক কিছু! ‘সারা দিন ওর ভিডিও ক্লিপিংস দেখলাম। কোনো লাভই হলো না। এই থামছে, এই দৌড়াচ্ছে, এত দ্রুতগতির কিছু আমি জীবনে দেখিনি।’

ফরাসি তারকা কিলিয়ান এমবাপ্পে

সেই গতির একটা হিসাবও পাওয়া গেল। ম্যাচ চলাকালীনই যা ভেসে উঠল স্টেডিয়ামের বড় পর্দায়। ঘণ্টায় মাত্র ৩৫ কিলোমিটার! এই বিশ্বকাপে ৫ গোল করে গোল্ডেন বুটের দৌড়েও সবচেয়ে এগিয়ে। সব মিলিয়ে ৯ গোল। ১১ ম্যাচ কম খেলে মেসির সমান। পেছনে রোনালদো, ম্যারাডোনা, রসি, রুমেনিগে আরও বড় বড় কত নাম! গত বিশ্বকাপেই পেলেকে টেনে এনেছিলেন। আনছেন এই বিশ্বকাপেও। ২৪ ছোঁয়ার আগে বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি গোলের রেকর্ডে যে পেছনে ফেলেছেন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা ফুটবল-সম্রাটকে।

অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচেই অলিভিয়ের জিরু ১৩ বছরের পুরোনো ফরাসি রেকর্ড ভাঙলেন। ফ্রান্সের জার্সি গায়ে থিয়েরি অঁরির সবচেয়ে বেশি গোলের রেকর্ড। জিরুর যে রেকর্ডের অঁরির মতো স্থায়িত্ব পাওয়ার প্রশ্নই নেই। মাত্র পাঁচ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারেই তো ৩৩ গোল হয়ে গেছে এমবাপ্পের।

জিরুর ৫২ গোলের ফরাসি রেকর্ড ভেঙে দেওয়া শুধুই সময়ের ব্যাপার বলে মনে হচ্ছে, মিরোস্লাভ ক্লোসার বিশ্বকাপ-রেকর্ডও কি তা-ই নয়! কোনো কারণে অকালে ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গেলে ভিন্ন কথা, নইলে ক্লোসার ১৬ গোলের রেকর্ড তো পরের বিশ্বকাপেই অতীত বানিয়ে দিতে পারেন এমবাপ্পে। মাত্র ৭ গোলই তো লাগে। মনে রাখা ভালো, এই বিশ্বকাপেই আরও তিনটি ম্যাচ খেলা সম্ভব এমবাপ্পের পক্ষে। 

কথাটা তো মেসির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। দুই ‌‌‘এম’-এর লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত যে কে জেতেন!