স্পেনে ছুটি কাটাতে গিয়ে মাদ্রিদের ছেলে আলেক্স গারনাচোর প্রেমে পড়েন পাত্রিসিয়া ফেরেইরা ফার্নান্দেজ। পরে আলেক্সের সঙ্গেই ঘর বাঁধার সিদ্ধান্ত নেন। জন্মভূমি আর্জেন্টিনা ছেড়ে থেকে যান স্পেনেই। মাদ্রিদে গারনাচো–পাত্রিসিয়া গড়ে তোলেন সুখের সংসার। ঘর আলো করে আসে দুই সন্তান। একজন আলেহান্দ্রো গারনাচো, অন্যজন রবার্ত গারনাচো।
সন্তানদের প্রথমজনকে নিশ্চয়ই পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ১৮ বছর বয়সী উইঙ্গার আলেহান্দ্রো গারনাচোকে যে ফুটবলবোদ্ধাদের কেউ কেউ সময়ের অন্যতম সেরা উঠতি তরুণ মনে করছেন! আগের মৌসুমে ইউনাইটেডের মূল দলের হয়ে মাত্র দুই ম্যাচ খেলার সুযোগ পেলেও চলতি মৌসুমে নিয়মিতই একাদশে থাকছেন। এ বছর তো এরিক টেন হাগের দলে অপরিহার্য সদস্যই। সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে গোল ৩টি, আরও ৫ গোল করিয়েছেন সতীর্থদের দিয়ে। তার চেয়েও বড় কথা—গারনাচো যতক্ষণ মাঠে থাকেন, মাতিয়ে রাখেন। বল পায়ে হয়ে ওঠেন ভয়ংকর।
গারনাচোর পরিবার নিয়ে এত দিন অনেকেরই ভুল ধারণা ছিল। সংবাদমাধ্যমে লেখা হয়েছে, তিনি স্পেনে জন্ম নেওয়া আর্জেন্টাইন মা–বাবার সন্তান। সত্যিটা কী, শুরুতে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে—বাবা আলেক্স স্প্যানিশ, মা পাত্রিসিয়া আর্জেন্টাইন।
দুই অভিভাবক দুই দেশের হওয়ায় স্পেন–আর্জেন্টিনা উভয় দেশের নাগরিকত্ব পেয়েছেন গারনাচো। মা–বাবা দুজনকেই খুশি রাখতে বয়সভিত্তিক পর্যায়ে খেলেছেন দুই দেশের হয়েই। কিন্তু জাতীয় দল বেছে নেওয়ায় কাজে দিয়েছে তাঁর মায়ের ‘প্রভাব খাটানো’। গ্যাবিয়েল বাতিস্তুতার ভক্ত পাত্রিসিয়া ছেলেকেও বানাতে চেয়েছেন স্ট্রাইকার। স্পেনে জন্ম নিলেও মায়ের কল্যাণে আর্জেন্টিনার আকাশি নীল–সাদা জার্সি গারনাচোর গায়ে উঠেছে শৈশবেই।
ছোটবেলায় গারনাচোর ধ্যানজ্ঞান ছিল দুটি—জাপানের হাস্যরসাত্মক কার্টুন সিরিজ ‘ক্যাপ্টেন সুবাসা’ আর ফুটবল। সুবাসা ওজোরা ছিল ১১ বছর বয়সী এক কার্টুন চরিত্র, যে ফুটবল খুব ভালোবাসে ও জাপানকে বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন দেখায়। কার্টুনে তাকে দেখানো হয়েছে স্বর্গ থেকে আগত শিশু ফুটবলার হিসেবে। ‘ক্যাপ্টেন সুবাসা’ দেখেই অনুপ্রাণিত হন গারনাচো। সেটা এতটাই যে বলেও আর্জেন্টিনার আকাশি নীল-সাদা রং করেছিলেন।
গারনাচোর মতো তুখোড় প্রতিভা বেশি দিন আড়ালে থাকেনি। ২০১৫ সালে যোগ দেন লা লিগার ক্লাব হেতাফেতে। সে বছরই আতলেতিকো মাদ্রিদের নজরে পড়েন। চলে আসেন জন্মশহরের ক্লাবে। পাঁচ বছর আতলেতিকোর যুব দলে খেলেছেন।
তবে গারনাচোর সম্ভাবনাময় ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরে যায় তিন বছর আগে, যখন ইউনাইটেড তাঁকে কিনে নেয়। তরুণ প্রতিভা খুঁজে বের করার সুখ্যাতি অনেক আগে থেকেই আছে রেড ডেভিলদের। ইংল্যান্ডের অন্যতম সফল ক্লাবটি ২০২০ সালে গারনাচোকে দলে ভিড়িয়ে যুব ফুটবল অঙ্গনে সাড়া ফেলে দেয়।
গারনাচোর পেশাদার চুক্তির হওয়ার গল্পটাও বেশ মজার। সে বছরের অক্টোবরে ইউনাইটেড একাডেমির কর্তারা তরুণ প্রতিভা অন্বেষণে মাদ্রিদে যান। তরুণ খুঁজতে গিয়ে পেয়ে যান সে সময়ের ১৬ বছর বয়সী কিশোর গারনাচোকে। আতলেতিকো তাঁকে ছাড়তে দাম হাঁকায় ৫ কোটি ৩২ লাখ টাকা। এত টাকা ওই মুহূর্তে ইউনাইটেড একাডেমির কর্তাদের পকেটে ছিল না। কিন্তু এমন প্রতিভা পেয়েও ছেড়ে দিলে কেমন দেখায়? ইউনাইটেড কর্তারা সঙ্গে সঙ্গে পার্শ্ববর্তী উত্তোলন পয়েন্ট থেকে টাকা তুলে আতলেতিকো মাদ্রিদকে পরিশোধ করে তাঁকে নিয়ে যান ওল্ড ট্রাফোর্ডে।
২০২১ সালে ইউনাইটেডকে যুব কাপ জেতাতে বড় অবদান রাখেন গারনাচো। নিজে জেতেন সেরা তরুণ খেলোয়াড়ের পুরস্কার। এরপর তাঁকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ডাক পান টেন হাগের মূল দলে। যেখানে সতীর্থ হিসেবে পেয়ে যান নিজের আদর্শ ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে।
রোনালদো গারনাচোর গল্পের মোড় ঘুরিয়েছেন তাঁর শৈশবেই। গারনাচোর মা পাত্রিসিয়া চেয়েছিলেন ছেলে হোক তাঁর পছন্দের ফুটবলার বাতিস্তুতার মতো। কিন্তু গারনাচো আর্জেন্টিনার জার্সি পরেই অনুসরণ করতে শুরু করেন পর্তুগিজ মহাতারকাকে। বাতিস্তুতার মতো স্ট্রাইকারও হননি। হয়েছেন ডান পায়ে খেলা বাঁ পাশের উইঙ্গার। রোনালদোও যে ডান পায়ে খেলেন! বড় হয়ে নিজের স্বপ্নের ফুটবলারকে দিয়ে গোল করাতে কিংবা তাঁর উদ্দেশে পাস বাড়াতে গারনাচোর উইঙ্গার হওয়ার ‘ভূত’ মাথায় চড়ে বসে।
বয়ঃসন্ধিকাল চলে আসার পর রোনালদোকে অনুসরণ শুধু মনে মনে সীমাবদ্ধ রাখেননি গারনাচো। তা অনুকরণ–এ উন্নীত হয়। রোনালদোর সব ট্রেডমার্ক উদ্যাপন গারনাচো ‘কপি–পেস্ট’ করছেন। ইউনাইটেড কিংবদন্তি পল স্কোলস ‘শিল্পী’ সম্বোধন করে গারনাচোর মধ্যে তরুণ রোনালদোর ছায়া খুঁজে পেয়েছেন। শুধু রোনালদোর ৭ নম্বর জার্সিটাই নেওয়া বাকি।
ফুটবলবিষয়ক অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ‘ওয়ান ফুটবল’ গারনাচোকে নিয়ে সম্প্রতি একটি বিশ্লেষণধর্মী নিবন্ধ প্রকাশ করেছে। সেখানে তারা লিখেছে, গারনাচো নিজেই প্রতিপক্ষ ফুল–ব্যাকদের দুর্বলতা চিহ্নিত করেন। সেসব বিশ্লেষণও করেন। তাঁর খেলা দেখলেই সেটা আঁচ করা যায়। তিনি এমন এক উইঙ্গার, যিনি ডিফেন্ডারদের মধ্যে ভীতি ছড়াতে পারেন। তাঁর মতো বাঁ প্রান্তে খেলা ডান পায়ের ফুটবলার ধারণাগতভাবে খুঁজে পাওয়া কঠিন। ১৮ বছর বয়স নিজেকে উন্নতির চূড়ায় নিয়ে যাওয়ার আদর্শ সময় নয়। তবে গারনাচো এর উল্টোটা করে চলেছেন। তাঁর মধ্যে না আছে আত্মবিশ্বাসের অভাব, না আছে আত্মতৃপ্তিতে ভোগার মতো কোনো বিষয়।
‘ওয়ান ফুটবল’ আরও লিখেছে, কৌশল অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। তবে ২০২৩ সালে এসে খেলার ধরন বিশ্লেষণ করতে গিয়ে কৌশলকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। কিছু খেলোয়াড়কে মাঠে নিজের মতো করে খেলার স্বাধীনতা দেওয়া হয়। গারনাচো তেমনই একজন, যিনি পূর্ণ স্বাধীনতা নিয়ে খেলেন।
গত বছর মার্চে কাতার বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে ইকুয়েডর ও ভেনেজুয়েলার বিপক্ষে ম্যাচে গারনাচোকে জাতীয় দলের ক্যাম্পে ডাকেন আর্জেন্টাইন কোচ লিওনেল স্কালোনি। সেখানে লিওনেল মেসির দেখা পেয়ে যান গারনাচো। ধারণা করা হয়েছিল ওই দুই ম্যাচের কোনোটিতে আর্জেন্টিনার হয়ে তাঁর অভিষেক হতে পারে, যেন ভবিষ্যতে স্পেন তাঁকে না পায়। কিন্তু স্কালোনি গারনাচোকে মাঠে নামানোর প্রয়োজন মনে করেননি। কাতার বিশ্বকাপ দলে থাকার জোর সম্ভাবনার কথা শোনা গেলেও শেষ পর্যন্ত স্কালোনি তাঁকে রাখেননি।
গারনাচো হাল ছাড়ার পাত্র নন। ইউনাইটেডের জার্সিতে আলো ছড়িয়ে নজর কাড়তে চান সবার। আগামী বছরের জুনে ক্লাবটির সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ ফুরোবে তাঁর।
তবে ইউনাইটেড জানিয়েছে, তারা ২০২৮ সাল পর্যন্ত গারনাচোকে রেখে দিতে চায়। বড় জোর রোনালদোর উদ্যাপন নকল আর ‘পুডিং বাটি’র মতো চুলের স্টাইল নিয়ে ‘অভিযোগ’ থাকতে পারে ক্লাব কর্তৃপক্ষ ও সমর্থকদের।
কিন্তু গারনাচোর প্রতিভা নিয়ে কারও কোনো অভিযোগ নেই। বরং অপেক্ষা আছে। সবার চাওয়া, ইউনাইটেডের সুদিন ফেরাতে তাঁর ভূমিকা থাকুক। সম্ভাবনাময় এই প্রতিভা প্রত্যাশার চাপ নিতে পারবেন কি না, তা সময়ই বলে দেবে। তবে অভিজ্ঞতাও তো কম হলো না। এত অল্প বয়সে মেসি-রোনালদো দুজনকেই সতীর্থ হিসেবে পাওয়া কজনের ভাগ্যে জুটেছে?