ম্যাড়মেড়ে আর হতশ্রী খেলার প্রদর্শনী চলছিল তখন। দুই দলের খেলা দেখে ধারাভাষ্যকারও বললেন, সবচেয়ে বাজে ডার্বিগুলোর একটি। তবে সেই বাজে ডার্বিতে কিছুটা রং ফেরাল ম্যানচেস্টারের লাল অংশ, অর্থাৎ ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড।
১ মিনিট ৫৫ সেকেন্ডের মধ্যে জোড়া গোল করে ২–১ ব্যবধানে প্রাপ্য জয়টি আদায় করে নিল ইউনাইটেড। শেষ ৭ মিনিটে ইউনাইটেডের এই পারফরম্যান্স বাদ দিলে পুরো ম্যাচ নিয়ে বিশেষ কোনো ট্যাকটিক্যাল বিশ্লেষণ না করলেও হয়।
সত্যি কথা বলতে, এই ম্যাচে দুই দলেরই কৌশলগত কোনো অবস্থান ছিল না। এ যেন ৯০ মিনিট ধরে লাল–নীল জার্সি পরা দুটি দলের উদ্দেশ্যহীন ছোটাছুটির গল্প। আর শেষে যে রং বদলাল, তাতে এটুকু স্পষ্ট হলো যে এই মুহূর্তে নীলের চেয়ে লাল খানিকটা এগিয়ে। কিন্তু তাতেও নীল জার্সি পরা ম্যানচেস্টার সিটির দায় একেবারে কম নয়।
পুরো ম্যাচ বাদ দিয়ে সিটির হজম করা গোল দুটির বিশ্লেষণ করলেই চিত্র আরেকটু পরিষ্কার হবে। পিছিয়ে থাকার পর নির্ধারিত সময়ের শেষ মুহূর্তে ইউনাইটেডের প্রথম গোলটি এসেছে পেনাল্টি থেকে। বক্সের ভেতরে ইউনাইটেড উইঙ্গার আমাদ দিয়ালো যে জায়গায় ছিলেন, সেখান থেকে অ্যাঙ্গেল বের করে গোল করা সহজ ছিল না।
সিটি গোলরক্ষক এদেরসনও বলের লাইনে ছিলেন। এমনকি পোস্টের সামনে কাভারও ছিল। কিন্তু আচমকা ছুটে এসে ম্যাথুস নুনেস এমনভাবে ফাউল করলেন, যেন তিনি প্রতিপক্ষকে পেনাল্টিটা উপহারই দিতে চাইছিলেন! পেনাল্টি হজম করার পর নুনেসের অভিব্যক্তি বলে দিচ্ছিল, বিষয়টি তাঁর নিজেরই মানতে কষ্ট হচ্ছে। দৃষ্টিকটুভাবে পেনাল্টি উপহার দেওয়ার দৃশ্যটাই মূলত পুরো ম্যাচে সিটির ‘ব্রেন ফেড’ পারফরম্যান্সের সারাংশ।
সিটির সর্বশেষ ১১ ম্যাচের পরিসংখ্যানটা এমন—৮ হার, ২ ড্র ও ১ জয়।
আমাদের করা দ্বিতীয় গোলটিও তেমনই আরেকটি দৃষ্টান্ত। লিসান্দ্রো মার্তিনেজের কাছ থেকে পাওয়া বলটা যেভাবে চার ডিফেন্ডারের মধ্য দিয়ে অবলীলায় বের করে নিলেন, তা সত্যিই অবিশ্বাস্য। নাহ, অবিশ্বাস্য কাজটা আমাদ করেননি, করেছেন সিটির চার ডিফেন্ডার। তাঁরা যেন আমাদকে মার্ক করতে নামেননি, বরং নেমেছেন গার্ড অব অনার দিতে! তাঁদের মধ্য দিয়ে মাখনে ছুরি চালানোর ভঙ্গিতে বল নিয়ে বেরিয়ে গেলেন আইভোরিয়ান তরুণ। তবে গোলের গল্পটা এখনো শেষ হয়নি।
চার ডিফেন্ডারের মধ্য দিয়ে বের হওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের কৃতিত্ব না থাকলেও ফিনিশিংয়ের কৃতিত্বটা তাঁকে দিতেই হবে। প্রথমে এদেরসনকে ফাঁকি দিয়ে লব করে বলটা বের করে নিলেন। এরপর তিনজন খেলোয়াড়ের ফাঁদ এড়িয়ে দারুণভাবে বল জালে জড়ালেন। ম্যাচ শেষে সিটির এমন হতশ্রী ডিফেন্সকে গার্দিওলা ব্যাখ্যা করলেন এক লাইনে, ‘আমাদের ডিফেন্স বলতে কিছুই ছিল না।’ গার্দিওলা একটুও বাড়িয়ে বলেননি, সত্যিকার অর্থেই সিটির ডিফেন্স ছিল তাসের ঘরের মতো। ইউনাইটেড ঠিকঠাক টোকা দিতে পারলে গোলের জন্য ৮৮ মিনিট পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো না। আরও আগেই ভেঙে পড়তে পারত।
আর এমন তালগোল পাকানোর পর সিটির সর্বশেষ ১১ ম্যাচের পরিসংখ্যানটা এমন—৮ হার, ২ ড্র ও ১ জয়। সিটি কতটা বাজে অবস্থায় আছে, তা বোধ হয় আর খুলে না বললেও হয়। যেখানে আগের দুই মৌসুমে সব মিলিয়ে সিটি ম্যাচ হেরেছিল ৭টি, সেখানে গত ১১ ম্যাচের মধ্যে ৮ বার হারের অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যেতে হলো দলটিকে। ম্যাচ শেষে গার্দিওলা অসহায় সুরেই বললেন, ‘আমি যথেষ্ট নই। আমি বস, আমিই কোচ। আমাকেই সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। এখন পর্যন্ত আমি তা পারিনি। এটাই বাস্তবতা।’
কে কবে গার্দিওলার কণ্ঠে এমন হতাশার সুর শুনেছিলেন! প্রায় ১৭ বছরের কোচিং ক্যারিয়ারে এমন দিন হয়তো গার্দিওলা দুঃস্বপ্নেও কখনো দেখেননি। প্রবল প্রতাপে যিনি নিজেকে সর্বকালের সেরা কোচদের একজন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, তিনি এমন কিছু ভাববেনই–বা কেন! কিন্তু জীবন এমনই। মুদ্রার একটা পিঠই এত দিন শুধু দেখেছেন কিংবদন্তি এই কোচ।
জীবন এখন গার্দিওলাকে দেখাচ্ছে তার রূঢ় ও কঠিন রূপটাও। জীবনের এই রূপ যে গার্দিওলা ঠিকঠাক মোকাবিলা করতে পারছেন না, তা–ও স্পষ্ট। ম্যাচ নিয়ে পরিকল্পনা ও কৌশলগত গন্ডগোল তো আছেই, এর সঙ্গে যোগ করা যেতে পারে নিজের নাক–মুখ নিজেই খামচে দেওয়া, রাতের পর রাত ঘুমাতে না পারা ও খেতে না পারা এবং সংবাদ সম্মেলনে অসংলগ্ন কথা বলার মতো ঘটনাও।
গত রাতে ম্যানচেস্টার ডার্বি হারার পর সিটির শিরোপা ধরে রাখার সম্ভাবনা যে তলানিতে নেমে এসেছে, তা বোধ হয় না বললেও হয়। শীর্ষে থাকা লিভারপুলের চেয়ে এখন এক ম্যাচ বেশি খেলে ৯ পয়েন্টে পিছিয়ে আছে সিটি। খারাপ পরিস্থিতি থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে সিটি লিগ শিরোপা ধরে রাখতে পারবে কি না, তা সময়ই বলে দেবে। ২০২২–২৩ মৌসুমে আর্সেনালের চেয়ে ৮ পয়েন্টে পিছিয়ে থেকেও ঘুরে দাঁড়িয়েছিল সিটি।
কিন্তু এবারের সিটি একেবারেই ভিন্ন। ঘুরে দাঁড়ানোর সেই তেজ ও মানসিকতাটুকুও যেন আর অবশিষ্ট নেই দলটির মধ্যে। নিছক সাফল্যের কঙ্কালে পরিণত হওয়া একটি দল যেন! তাই সিটি ও গার্দিওলার এখন যা দরকার, তার নাম ‘অলৌকিকতা’। আলাদিনের চেরাগের মতো কিছু একটা। তবে এখন পর্যন্ত তেমন কিছু খুঁজে পাওয়া অসম্ভব বলেই মনে হচ্ছে।