দোহায় আর্জেন্টিনার অনুশীলনে মেসি ও ম্যারাডোনার ব্যানার হাতে সমর্থক। এই ব্যানারের ছবিটাই যেন সব বলে দেয়
দোহায় আর্জেন্টিনার অনুশীলনে মেসি ও ম্যারাডোনার ব্যানার হাতে সমর্থক। এই ব্যানারের ছবিটাই যেন সব বলে দেয়

মেসি, ‘সোনার ছেলে’র গল্পে আর দুই ধাপ বাকি

নানির আদর মানে সাত খুন মাফ। নাতি কিছু চাইবে আর সেটা হবে না, এটা কী করে হয়!

সেলিয়ার ছোট নাতিও ফুটবলার হতে চেয়েছিল। পরিবার থেকে সবচেয়ে বেশি প্রশ্রয় দিয়েছে কে? অবশ্যই সেলিয়া। গোল করে তাঁর নাতি এখনো আকাশে তাকিয়ে সেই প্রশ্রয়ের কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেন। একজন ফুটবলারের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত ওই মুহূর্তে—পরিবারের অন্য কারও ঠাঁই নেই সেখানে। সন্দেহটা তাই আরও গাঢ় হয়ে ওঠে। সেই অলৌকিকতার পেছনে আসলে প্রশ্রয়, না প্রয়োজন?

ঘটনাটা খুলে বলা যাক। সালভাদর রিকোর্দো আপ্রিসিও তখন গ্রান্দোলির পুঁচকে-পাঁচকাদের কোচ। টিম ’৮৬ (১৯৮৬ সালে জন্ম নেওয়া কচিকাঁচাদের নিয়ে গড়া দল) ম্যাচ খেলবে। দলে একজন কম। এসে পৌঁছায়নি। এদিকে সময় ঘাই মারছে। কী করা যায়…কী করা যায়, ভাবতে ভাবতে সালভাদর খেয়াল করলেন, মাঠের কোণে দেয়ালে বল মেরে এক পুঁচকে খেলছে। বয়স আরও কম, গড়নেও তাঁর খেলোয়াড়দের চেয়ে আরও ছোট।

একটু দূরেই পুঁচকের নানি সেলিয়া বসে। রোজ মঙ্গল ও বৃহস্পতিবার নিয়ম করে দুই নাতিকে অনুশীলন করাতে নিয়ে আসেন গ্রান্দোলিতে। সালভাদরের দাবি, পুঁচকের মাকে বলে কাজ হয়নি; আসলে বড়দের সঙ্গে খেলতে দিতে মায়েরা কখনো রাজি হন না। পরে তিনিই সেলিয়াকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে রাজি করিয়ে ৫ বছরের ওই বাচ্চা ছেলেটিকে দলে নেন।

ছেলেটির পরিবারের ভাষ্য অন্য রকম। দলে একজন খেলোয়াড় কম দেখে সেলিয়াই নাকি তাঁর ছোট নাতিকে নেওয়ার ওকালতি করেন, ‘ওকে নাও, খেলা দেখলে তাক লেগে যাবে।’ সালভাদর খানিক গাঁইগুঁই করে অগত্যা অনুরোধে ঢেঁকি গেলেন, ‘ঠিক আছে, কিন্তু আমি ওকে টাচলাইনের পাশে খেলাচ্ছি। কেঁদেটেঁদে ফেললে টেনে নিজের কাছে নিতে পারবেন।’

বল ও মেসির এই যুগলবন্দী সব সময়েই আনন্দের

পরের ঘটনা নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। তবু আর্জেন্টিনার সান্তা ফে ঘুরে এসে গার্ডিয়ানে জোনাথন উইলসনের লেখার একটি অংশ তুলে দেওয়া হলো—
‘সেদিন রোজারিওর ধুলোময় মাঠের ঘটনা নিয়ে কারও দ্বিধা-দ্বিমত নেই। বেঢপ বড় জার্সি, প্রথম পাসটা পেয়েছিল ডান পায়ে। আরেকজনকে দিয়ে দেয়। পরেরটা বাঁ পায়ে পেতেই শুরু করল ড্রিবলিং।’ সেই ড্রিবলিং নিয়ে সেলিয়ার কথাটা এ রকম—‘সেটা ও এমনভাবে করল, যেন জন্মই হয়েছে এটা করার জন্য।’

উইলসন লিখেছেন, ‘সেদিন মাঠের দর্শক অলৌকিক দেখেছিল। হ্যাঁ, পিবেই তো ‘সেই তো ধুলোমাখা মুখ, বুদ্ধিদীপ্ত চোখ আর বল পায়ে দুনিয়া জয়ের চাহনি। উইলসন এ কথা লেখেননি। তিনি লিখেছেন ‘হেয়ার ওয়াজ এ পিবে ইন অ্যাকশন।’ আর্জেন্টাইন ফুটবলে অবতারতুল্য ‘পিবে’কে বোঝাতে ওই বর্ণনা, যার শ্রেষ্ঠ কুশীলব ডিয়েগো ম্যারাডোনা। তখন তাঁরই সময়। তবু সেদিন সেই ছেলেটির মধ্যেও লোকে ‘এল পিবে’র রূপ দেখেছিল। ছেলেটির নাম লিওনেল মেসি।

আর্জেন্টাইন ফুটবল বিশ শতকের প্রথম দশকে ব্রিটিশদের শৃঙ্খলাবদ্ধ খেলার শিকল ভেঙে ফেলে। সমাজের নিচু স্তরে বল নিয়ে কলা-কৌশলের চল শুরু হয়।

‘আবিষ্কারক’ সালভাদর রিকার্দো অ্যাপরিসিওর সঙ্গে চার বছর বয়সী মেসি (ডান থেকে দাঁড়ানো দ্বিতীয়)

চল্লিশের দশকে সেই প্রভাব এতটা বাড়ে যে খেলা হয়ে ওঠে উপভোগের, আনন্দের। ঘরোয়ায় কিছু দলের ফরোয়ার্ড লাইনকে ‘ব্যালে’ দলও বলা হতো। খেলার এই আর্জেন্টাইন ধারার একটা নামও জোগার হয়। নাম মানে ব্রিটিশ ধারার প্রভাবমুক্ত আর্জেন্টাইন ‘আইডেনটিটি’ বা চেতনা। এই চেতনার সলতে জ্বালিয়ে রাখার কাজটা করে ১৯১৯ সালে যাত্রা শুরু করা সাময়িকী ‘এল গ্রাফিকো’।

‘ক্রিয়োল্লো স্টাইল’খেলার ধারাকে ছড়িয়ে দেয় তারা। শহরে বিল্ডিংয়ের মধ্যে যে ফাঁকা জায়গা (পোত্রেরোস) গলি-ঘুপচিতে অল্প একটু জায়গায় যেভাবে ফুটবল খেলা হয়, সেসব বৈশিষ্ট্য মিলিয়েই ক্রিয়োল্লো স্টাইল। এই চেতনাকে মানুষের আদলে ভাস্কর্যে রূপ দেওয়ার দাবি তুলেছিলেন সংবাদকর্মী রিকার্দো লোরেঞ্জো ‘বোরোকোতো’। কল্পনার সেই মানসপুত্রের গড়ন কেমন হবে, সেটাও ‘এল গ্রাফিকো’র এ সম্পাদক লিখেছিলেন ১৯২৮ সালে।

আর্জেন্টাইন ফুটবল-চেতনার সেই কল্পিত মানসপুত্রই ‘এল পিবে’, ইংরেজিতে ‘দ্য কিড।’বোরোকোতো লিখেছিলেন, ‘একটা অল্প বয়সী ছেলে, মুখটা ময়লা, চিরুনির অবাধ্য চুল, কিন্তু চোখ দুটো বুদ্ধিদীপ্ত ও কৌশলে ভরপুর…ছবির মতো সুন্দর হাসি…পরনে আর্জেন্টাইন স্ট্রাইপ, কিছু জায়গা ইঁদুরে খাওয়া…হাঁটুতে ক্ষত…খালি পা…পায়ের তলায় কাপড়ের বল, ড্রিবলিংয়ের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে…এমন একটা ভাস্কর্য কোনো একদিন গড়লে, আমাদের অনেকেই হয়তো হ্যাট খুলে সম্মান দেখাবে, যা গির্জায় করে।’

আর্জেন্টিনার ট্যাঙ্গো গীতিকার রেইনালদে ইয়োসো ১৯৪৩ সালে ‘দ্য ড্রিম অব এল পিবে’ নামে গান লিখেছিলেন। যেখানে একটি ছেলে ফুটবলার হয়ে মাকে তার স্বপ্নের কথা বলে। এই ট্যাঙ্গোটা ১৯৮২ বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়ার আগে টিভিতে গেয়েছিলেন ম্যারাডোনা। গানের ‘একদিন আমি হবো বালদোনেদো, মার্তিনো, বোয়ের মতো’ লাইনটি পাল্টে, ‘একদিন আমি হবো ম্যারাডোনা, কেম্পেস, ওলগুইনের মতো।’

দোহায় আর্জেন্টাইন এক সমর্থকের পতাকায় মেসি ও ম্যারাডোনা

ম্যারাডোনা ‘এল পিবে’র শ্রেষ্ঠ রূপকার। দারিদ্র, গলি-ঘুপচির ফুটবলে কল্পনাতীত প্রতিভা, নিয়মের তোয়াক্কা করে না, বল পায়ে স্বাধীন, আনন্দময় ও অফুরান সৃষ্টিশীল সর্বোপরি আর্জেন্টাইন ফুটবলের ‘প্রমিজ’বয়ে বেড়ানো, কিন্তু ব্যক্তিজীবনে খুঁত ; ম্যারাডোনা (এল পিবে দে ওরো বা গোল্ডেন বয়) ‘পিবে’র সব শর্তই পূরণ করেই ’৮৬ এনে দিয়েছেন আর্জেন্টিনাকে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ডান দিক দিয়ে সেই যে দৌড়, খুব অল্প জায়গার মধ্য দিয়ে ডিফেন্ডারের পর ডিফেন্ডার কাটিয়ে, ওটাই পোত্রেরোসের খেলা। বেলজিয়ামের বিপক্ষে করা গোলটাও। খুব অল্প জায়গার মধ্যে কলা-কুশলের সূচে গোল গেঁথে ফেলা। অন্যভাবে বলা যায়, কার্লোস বিলার্দোর বাকি ১০ জন ছিল ম্যারাডোনোর পোত্রেরোস খেলার ডাইভার্সন।

হুয়ান রোমান রিকেলমে, কার্লোস তেভেজ, সের্হিও আগুয়েরোদের গল্পও এমন। অবসরে বন্ধুদের নিয়ে নেমে পড়তেন পোত্রেরোস খেলতে। পেশাদার হয়েও ‘পিবে’র মতো স্বাধীন, সৃষ্টিশীল খেলার শিশুসুলভ আনন্দ তারাও নিয়েছেন। আর মেসি?

কাতারে পঞ্চম বিশ্বকাপ খেলতে এসেছেন মেসি

তিনিও আরেক পিবে। সবচেয়ে বড় নিন্দুকও বলবেন, সেই (পিবে হওয়ার) চেষ্টা কখনো থামাননি। অল্প বয়সে স্পেনে চলে গেলেও তার আগের জীবনটা তো পোত্রেরোসের। ক্যাম্প ন্যু থেকে বল পায়ে তাঁর দৌড়ের শুরু থেকে যে আনন্দ, যে স্বাধীনতা ও অবাধ্যতার মিশেলে গড়া অবিষ্মরণীয় সব মুহূর্ত; সবকিছুর শিকড় ওখানে! বক্সের সামনে ডিফেন্ডার পরিবেষ্টিত হয়ে তাঁর প্রতিটি মুভ ‘পিবে’র শিকল ভাঙা স্বাধীনতার রূপ, কিংবা আরেকটু পেছন থেকে উঠে আসা, আরও বেশি সময় বল পায়ে রেখে এঁকেবেঁকে চলা, ওটা ‘গ্যামবেতা ক্রিয়োল্লো’—বল যতটা সম্ভব পায়ে রেখে কী কী করতে পারি দেখানো। নামটা বোরোকোতোর দেওয়া।

মাঠে মেসির জীবনটাই বল পায়ে এঁকেবেঁকে চলার। ২০০৭ কোপা দেল রে সেমিফাইনালে হেতাফের ডান দিক দিয়ে আঁকাবাঁকা দৌড়ে ম্যারাডোনার ‘গোল অব দ্য সেঞ্চুরি’ ফিরিয়েছিলেন। ‘পিবে’র অবাধ্যতাও মনে করিয়েছেন সে বছরই, লিগে এস্পানিওলের বিপক্ষে ‘হ্যান্ড অব গড’ফিরিয়ে। কিংবা অন্য অর্থে মেসি প্রশ্ন রেখেছেন, পিবের শ্রেষ্ঠ রূপকারের মতোই নয় কি? তারপর মাইলের পর মাইল দৌড়ে, একের পর এক ডিফেন্ডারকে পিছে ফেলে মেসি এখন গোললাইনটা দেখতে পাচ্ছেন। আর মাত্র দুই ধাপ!

সেদিন বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে পাসটা, ওটাই তো ‘পিবে’র খেলার সারসংক্ষেপ। সামনে একজন ডিফেন্ডার নিয়ে তেরছা করে ছুটছিলেন। সেই ডিফেন্ডারের পেছনে সরু একটা চ্যানেল, সেদিক দিয়ে বল দিলে নাহুয়েল মলিনা পাবেন। তাঁর সামনে, পেছনে ডিফেন্ডার লেগে। সবচেয়ে বড় সমস্যা মেসির সামনের ডিফেন্ডার। অন্য কেউ হলে হয়তো খেলাটা পেছনে নিতেন কিংবা বড়জোর ডিফেন্ডারকে কাটানোর চেষ্টা করতেন। কিন্তু ‘পিবে’রা তেমন নয়। গলি-ঘুপচিতে জায়গা কম, তার ওপর প্রতিপক্ষও কম নয়, যা করার চকিতভাবে এর মধ্যেই করতে হয়। মেসিও তাই ‘পান্নামুভ’ (নাটমেগ) পাসটা দিলেন, সামনের ডিফেন্ডারের দুই পায়ের মাঝ দিয়ে বল দিলেন একেবারে মলিনার সামনে!

বিশ্বকাপে আর্জেন্টাইন সমর্থকদের মধ্যে এভাবেই পাশাপাশি জায়গা করে নিয়েছেন মেসি ও ম্যারাডোনা

ম্যারাডোনা ’৮৬ এনে দিয়ে ’৯০–এ গিয়ে পারেননি। মেসি ২০১৪–তে না পেরে ২০২২ এসে আশা পূরণের খুব কাছে। শেষ দুটি ধাপ পেরোতে পারবেন? যদি না পারেন!
তবু মেসি ‘পিবে’ই থাকবেন। কলম্বিয়ায় যেভাবে কার্লোস ভালদেরেমা (এল পিবে)। মেসিকে নিয়ে ‘মোর দ্যান আ ক্রাক’ ট্যাঙ্গো গানে আর্জেন্টাইন কবি ও মিউজিশিয়ান পল মার্চেত্তি লিখেছেন, ‘এল পিবে/উইথ দ্য শার্ট অব বার্সা নাম্বার ১০/…এল পিবে/ উইথ দ্য ওয়ান দ্যাট সেজ মেসি/ ক্যারিজ দ্য বল…।’

ওমর শিভোরি…ওমর করবাত্তা…মারিও কেম্পেস…ডিয়েগো ম্যারাডোনাদের পা ঘুরে এখন মেসির পায়ে বল। চিকচিক চোখে বিশ্বজয়ের নেশা। আর ছবির মতো সুন্দর হাসি, সেটাও থাকুক শেষ দুই ধাপ।

সেলিয়া ও সালভাদরের পিঠ চাপড়ে তখন স্বয়ং ম্যারাডোনাই হয়তো বলবেন, সেদিন তোমরা ওই কম্মোটি করেছিলে বলেই ‘এল পিবে দে ওরো ইজ ব্যাক!’