অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী আরহাম ইসলাম এখন বাংলাদেশের
অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী আরহাম ইসলাম এখন বাংলাদেশের

মেলবোর্ন থেকে ঢাকা, কম্বোডিয়ায় বাংলাদেশের জার্সি পরবে আরহাম

খুব ছোট থাকতেই বাবা–মায়ের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ায় চলে যাওয়া আরহাম ইসলামের। মেলবোর্ন থেকে খানিকটা দূরে তার বেড়ে ওঠা। স্কুল, পড়াশোনার মধ্যেই ফুটবলটাকে আপন করে নেওয়া। শখের খেলাটাই এখন আরহামের ‘জীবন’, ভালোবাসা।

অস্ট্রেলিয়ার ‘এ’ লিগের ক্লাব ওয়েস্টার্ন ইউনাইটেড মেলবোর্নভিত্তিক ক্লাব। আরহামের প্রতিভা তাদের চোখ এড়ায়নি। ওয়েস্টার্ন ইউনাইটেডের অনূর্ধ্ব–১৮ দলে খেলছে সে। সেখানে আলো ছড়িয়ে আরহাম এখন বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব–১৭ দলের অংশ। কম্বোডিয়াতে এএফসি অনূর্ধ্ব–১৭ এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে বাংলাদেশের চূড়ান্ত স্কোয়াডে জায়গা করে নিয়েছে আরহাম।

আরহামের বাবা আরিফুল ইসলাম পেশায় প্রকৌশলী। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে পড়াশোনা করে প্রবাসজীবন বেছে নেন। আর দশটা বাবার মতোই ছেলেকে ফুটবলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। তবে আরহাম যে ফুটবলকে এভাবে আঁকড়ে ধরবে, সেটি তিনি শুরুতে ভাবেননি।

অস্ট্রেলিয়ার ক্লাব ওয়েস্টার্ন ইউনাইটেডের বয়সভিত্তিক দলে খেলছেন আরহাম

মেলবোর্নের বালারাট ক্ল্যারেনডন কলেজে পড়া আরহামকে যখন ওয়েস্টার্ন ইউনাইটেড ক্লাবের স্কাউটরা দলে নেওয়ার প্রস্তাব দেন, বেশ অবাক হয়েছিলেন আরিফুল ইসলাম। অগ্রাধিকার ছিল ছেলের পড়াশোনায়। কিন্তু ছেলের ধ্যানজ্ঞান আবার ফুটবল। তাই ওয়েস্টার্ন ইউনাইটেডের প্রস্তাবটা ফিরিয়ে দিতে পারেননি আরিফুল।

আরিফুল জানান, ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ ও ইংলিশ চ্যাম্পিয়নশিপের বেশ কয়েকটি ক্লাবের স্কাউটরাও নাকি আরহামের ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। তবে মাইনর প্রোটেকশন রুলসের বাধ্যবাধকতায় সাইন করাতে পারেননি। সর্বশেষ মৌসুমে প্রিমিয়ার লিগ থেকে নেমে যাওয়া শেফিল্ড ইউনাইটেডেরও দৃষ্টি ছিল তার দিকে।

বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব–১৭ দলে আরহামের আসাটা মূলত বাংলাদেশের একটি স্পোর্টস ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই। আরিফুল ইসলাম জানান, ‘কনফিয়ানজা নামের একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয় অস্ট্রেলিয়াতেই। শুনলাম, তারা বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলে ফিনল্যান্ডপ্রবাসী ফুটবলার তারিক কাজীকে এনে দিয়েছে। তাদের মাধ্যমেই ছেলের যাবতীয় কাগজপত্র বাফুফেতে পাঠাই। অনূর্ধ্ব–১৭ দলের কোচ সাইফুল বারী এরপর আরহামকে দেশে এসে ট্রায়ালে অংশ নিতে বলেন।’

আরিফুল ইসলাম ছেলেকে নিয়ে দেশে এলেও খুব একটা নিশ্চিত ছিলেন না পুরো বিষয়টি নিয়ে, ‘অস্ট্রেলিয়া থেকে বাংলাদেশে এসে ক্যাম্পে থেকে ট্রায়াল দেওয়া। আমি নিশ্চিত ছিলাম না, আমার ছেলে পারবে কি না। তবে অস্ট্রেলিয়াতে ওয়েস্টার্ন ইউনাইটেডের অনূর্ধ্ব–১৮ দলে সে যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গেছে, তাতে ওর একটা ট্রেনিং হয়েই আছে। বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব–১৭ দলের অনুশীলনে দেখি, আমার ছেলে খুব ভালো মানিয়ে নিয়েছে।’

বাংলাদেশে এসে মানিয়ে নেওয়ার ব্যাপারটি খুব সহজ ছিল না আরহামের জন্য। সেটি জানান অনূর্ধ্ব–১৭ দলের ম্যানেজার, জাতীয় দলের সাবেক স্ট্রাইকার জাহিদ হাসান এমিলি, ‘অস্ট্রেলিয়ায় একধরনের পরিবেশে সে বড় হয়েছে। এখানে পুরোপুরি অন্য পরিবেশ। কমলাপুর স্টেডিয়ামের ক্যাম্প, সেখানকার খাওয়াদাওয়া, দলের বাকিদের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া—সবকিছুই কঠিন ছিল ওর জন্য। ছেলেটি সবকিছুই মানিয়ে নিয়েছে। দারুণ প্রতিভাবান ফুটবলার আরহাম। বয়সভিত্তিক দলে ওর ভালো করার সম্ভাবনা দেখছি আমি।’

কোচ সাইফুল বারীও আরহামকে পরখ করে তার প্রতিভা নিয়ে নিঃসন্দেহ, ‘উইঙ্গার–স্ট্রাইকার পজিশনে একজন ফুটবলারের যা যা গুণ দরকার, সবই আছে ওর। মানসিকভাবেই দৃঢ়। এই গরমে কষ্ট সহ্য করে দলের সঙ্গে মানিয়ে নিচ্ছে। আবহাওয়াকে জয় করতে পারলে সে নিজেকে পুরোপুরি মেলে ধরতে পারবে বলে আমি মনে করি।’

ছোট ভাইয়ের সঙ্গে আরহাম

বসুন্ধরা স্পোর্টস কমপ্লেক্সে মঙ্গলবার ভোরের অনুশীলনেও সপ্রতিভ দেখাল আরহামকে। প্রচণ্ড আর্দ্রতা আর গরমকে উপেক্ষা করে দলের বাকিদের সঙ্গে সমানতালে খেলে গেল আরহাম। অনুশীলন শেষে আরহাম ভাঙা ভাঙা বাংলায় জানাল নিজের অনুভূতি, ‘বাংলাদেশের হয়ে খেলার সুযোগ পাচ্ছি। ক্যাম্পে খুব মজা হয়। আমার টিমমেটরা দারুণ। আমার যেন কোনো কষ্ট না হয়, সেদিকে তাদের খেয়াল। আমি কী খেতে চাই, সেটা নিয়েও ওরা অনেক টেনশন করে।’

বাংলাদেশের হয়ে খেলার কথা ওয়েস্টার্ন ইউনাইটেডের কোচকে বলতেই নাকি দারুণ উৎসাহ দিয়েছেন তিনি, ‘আমাকে তো ওদের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে আসতে হয়েছে। আমি যখন বললাম, আমার দেশ বাংলাদেশের হয়ে খেলতে যাব, তখন কোচ দারুণ উৎসাহ দিলেন। বলেছেন, এএফসি এশিয়ান কাপের অভিজ্ঞতা আমাকে আরও ভালো ফুটবলার হয়ে উঠতে সাহায্য করবে। মাতৃভূমির জন্য নিজেকে উজাড় করে দিয়ে খেলতে বলেছেন।’

ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবছে না আরহাম। ভাবছেন না তার বাবাও। আরহামের কথা, ‘বাংলাদেশের হয়ে খেলার সুযোগ যখন এসেছে, তখন নিজের সেরাটাই দেব। বাকিটা জানি না। আমি তো মাত্র ফুটবলার হয়ে উঠছি। সামনে অনেক সময় পড়ে আছে। আপাতত কম্বোডিয়াতে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব–১৭ দলের হয়ে যেন ভালো খেলতে পারি, সেটা নিয়েই ভাবি।’

বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব–১৭ দলের অনুশীলনে আরহাম

আরহামের বাবার কথা, ‘মাত্র ১৭ বছর বয়স ওর। ফুটবল শিখছে, শিখুক। এর মধ্যেই বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব–১৭ দলে খেলার সুযোগ পেয়েছে। আমি জানি না, আরহাম ব্যাপারটার গুরুত্ব কতটা অনুধাবন করছে। আমি এখনই ওর ব্যাপারে কোনো কিছু চাপিয়ে দিতে চাই না। দেখি না, সে কত দূর যায়।’

এএফসি অনূর্ধ্ব–১৭ এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বে বাংলাদেশ খেলবে গ্রুপ ‘বি’তে। ১৯ অক্টোবর থেকে কম্বোডিয়ার নমপেনে শুরু হবে বাছাইপর্বের খেলা। বাংলাদেশের গ্রুপে আছে আফগানিস্তান, ম্যাকাও, ফিলিপাইন ও স্বাগতিক কম্বোডিয়া। কালই (১৬ অক্টোবর) দেশ ছাড়বে বাংলাদেশ দল। ১৯ অক্টোবর প্রথম দিনই কম্বোডিয়ার মুখোমুখি হবে দল।