অস্ট্রেলিয়ার কোচ গ্রাহাম আরনল্ড
অস্ট্রেলিয়ার কোচ গ্রাহাম আরনল্ড

কাতার থেকে উৎপল শুভ্র

আর্জেন্টিনাকে হুমকি দিচ্ছেন অস্ট্রেলিয়ার কোচ

খেলাটা যে ক্রিকেট নয়, ফুটবল—গ্রাহাম আরনল্ডের তা মনে আছে তো? অস্ট্রেলিয়ার কোচ যে আর্জেন্টিনাকে ক্রমাগত হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন! শেষ ষোলোর প্রতিপক্ষ চূড়ান্ত হওয়ার পরই নিজের দেশের এক টিভি চ্যানেলে ঘোষণা দিয়েছেন, এই ম্যাচে আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে দেবে তাঁর দল।

প্রশ্নকর্তা সাংবাদিক এরপর হয়তো মজা করেই জিজ্ঞেস করেছেন, ফাইনাল পর্যন্ত গেলে কোন দলকে প্রতিপক্ষ হিসেবে পছন্দ তাঁর। একটুও বিব্রত না হয়ে গ্রাহাম আরনল্ড সোজা বলে দিয়েছেন, ‘ব্রাজিল।’

গ্রাহাম আরনল্ড সংবাদ সম্মেলনেও এলেন যুদ্ধের দামামা বাজাতে বাজাতে। যুদ্ধ মানে যুদ্ধই। অবলীলায় বলে দিলেন, ‘এটা হলুদ জার্সি বনাম নীল-সাদা জার্সি। এটা লড়াই, এটা যুদ্ধ। এগারো বনাম এগারো। আমরা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত।’

গ্রাহাম আরনল্ডের কথা শুনতে শুনতে ভাবছিলাম, এই না হলে অস্ট্রেলিয়ান! খেলা যেটাই হোক, শক্তিতে প্রতিপক্ষ যতই এগিয়ে থাকুক, চিরন্তন সেই অজি মানসিকতা আসলে বদলানোর নয়। খেলা মানেই লড়াই। খেলা মানেই যুদ্ধ। খেলা মানেই সর্বস্ব উজাড় করে দেওয়া। নয়তো আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ম্যাচের আগে অস্ট্রেলিয়ার ফুটবল কোচ কীভাবে এমন যুদ্ধংদেহী মেজাজে দেখা দিতে পারেন! সাংবাদিকেরা পর্যন্ত একটু হকচকিয়ে গেলেন।

ডিফেন্ডার হ্যারি সুটারকে নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে কোচ গ্রাহাম আরনল্ড

‘এগারো বনাম এগারো’ আর ‘সর্বস্ব উজাড় করে দেওয়া’র কথাটায় অবশ্য দুই দলের কোচের মিল থাকল। লিওনেল স্কালোনি এর আগেই বলে গেছেন, ফুটবল ম্যাচ মানে ‘এগারো বনাম এগারো’। সৌদি আরবের কাছে হেরে যাওয়ার পর থেকেই যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাচ্ছেন, আবারও তা দিলেন, ‘উই উইল ব্রেক আওয়ার ব্যাক।’ মানে তো ‘সর্বস্ব উজাড় করে দেওয়া’ই, নাকি!

মিল বলতে এই দুটি কথাতেই। নয়তো দুই কোচের সংবাদ সম্মেলন দুটি হলো বিপরীত চরিত্রের। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে আর্জেন্টিনা অবধারিত ফেবারিট, এই অমোঘ সত্যটাকেই পাত্তা দিতে চাইলেন না স্কালোনি। বরং মনে করিয়ে দিলেন, এই বিশ্বকাপে কী সব কাণ্ড হয়েছে! বিশ্বকাপে কোনো ম্যাচই সহজ নয়। গ্রাহাম আরনল্ড যেখানে যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েই ক্ষান্ত হলেন না, দাবি করলেন, আর্জেন্টিনা অস্ট্রেলিয়ার সেরাটা বের করে আনে।

ফুটবলে কবে তা হয়েছে? সেই সুখস্মৃতি রোমন্থন করার সুযোগও পেলেন। আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ছয় ম্যাচে একবারই জিতেছে অস্ট্রেলিয়া। ১৯৮৮ সালে দুই দলের মধ্যে প্রথম ম্যাচেই। সেই ম্যাচে খেলেছেন গ্রাহাম আরনল্ড। এটা যদি অনেক আগের ঘটনা হয়, একেবারে সাম্প্রতিক অতীতও এল। গত জুলাইয়ে টোকিও অলিম্পিকে আর্জেন্টিনাকে ২-০ গোলে হারিয়েছে অস্ট্রেলিয়া। সেই ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার গোলদাতা মার্কো টিলিও তো জানিয়েই দিয়েছেন, মাঠে নামতে তাঁর তর সইছে না।

১৯৮৮ সালে গোল্ড কাপে অস্ট্রেলিয়ার যে দলটি আর্জেন্টিনার মুখোমুখি হয়েছিল

যেকোনো কোচই এমন কিছু শুনলে খুশি হবেন। গ্রাহাম আরনল্ডের জন্য তা উল্টো সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দলের ২৬ খেলোয়াড়েরই যে মাঠে নামতে তর সইছে না! লিওনেল মেসির বিপক্ষে খেলার সুযোগ যেকোনো ফুটবলারের জন্যই এমন মহার্ঘ্য যে এই ম্যাচের প্রথম একাদশে থাকতে চান অস্ট্রেলিয়ার ২৬ জনই! গ্রাহাম আরনল্ডকে তাই খেলোয়াড়দের সঙ্গে আলাদা কথা বলে বোঝাতে হয়েছে, ব্যক্তির চেয়ে দেশ বড়। তবে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে সৌদি আরবের কোচকে যে আগুনে বক্তব্য দিয়ে খেলোয়াড়দের উদ্দীপ্ত করতে হয়েছিল, গ্রাহাম আরনল্ডকে তা করতে হবে বলে মনে হয় না। অস্ট্রেলিয়ান খেলোয়াড়েরা কথাবার্তা যা বলছেন, সব কোচের সুরেই। আর্জেন্টিনা বড় দল, মেসি বড় খেলোয়াড়, তাতে কী? আমরাও খেলতে জানি।

সেই খেলাটা কেমন, তা মূলত ভিডিও দেখেই জানতে হয়েছে আর্জেন্টিনাকে। আর্জেন্টাইন রদ্রিগো দি পল যেমন জেনেছেন, অস্ট্রেলিয়ার দুই উইংই খুব দ্রুতগতির। ডিফেন্ডারদের তাই খুব সাবধান থাকতে হবে। অস্ট্রেলিয়া খুব ফিজিক্যাল টিম, ম্যাচটা তাই পোল্যান্ডের মতোই হবে বলে তাঁর ধারণা। তা হলে তো আর্জেন্টিনার খুশি হওয়ারই কথা। এই বিশ্বকাপে পোল্যান্ডের বিপক্ষে ওই একটা ম্যাচেই তো শুধু আর্জেন্টিনাকে আর্জেন্টিনার মতো মনে হয়েছে। বিশ্বকাপের আগে ৩৬ ম্যাচে অপরাজিত থাকা ওই দলের মতো। যে কারণে রদ্রিগো দি পল বললেন, এই ম্যাচের পরই শুধু তিনি বিশ্বকাপ একটু উপভোগ করতে শুরু করেছেন।

অস্ট্রেলিয়ার দ্রুতগতির উইঙ্গারদের কথা বললেন স্কালোনিও, আরও নির্দিষ্ট করে ডান দিকের কথা। সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে বড় শক্তি হিসেবে বললেন, ওরা একটা ‘টিম’। দিলেন ব্যাখ্যাও, ‘টিম বলতে আমি বোঝাচ্ছি এমন একটা জাতীয় দল, যে দলের খেলোয়াড়েরা নিজেদের উজাড় করে দেয়।’

চোটে পড়েছেন আনহেল দি মারিয়া

মুখে যতই বিনয় দেখান, অস্ট্রেলিয়ার চেয়েও স্কালোনির বড় দুশ্চিন্তা মনে হচ্ছে তাঁর নিজের দল নিয়ে। আনহেল দি মারিয়ার চোট আছে। তিনি খেলবেন কি না, নিশ্চিত কিছু বললেন না। সম্ভাব্য একাদশ নিয়ে বললেন, ‘আমি তো খুব কমই পরপর দুই ম্যাচে একই একাদশ নামাই। আমি একাদশ ঠিক করি কাদের সঙ্গে খেলছি, তা দেখে।’ দুশ্চিন্তাটা আসলে দি মারিয়ার চোট বা একাদশ নির্বাচন নিয়ে নয়। মাত্র দুই দিন পরই আবার মাঠে নেমে যাওয়ার ক্লান্তি নিয়ে। পোল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচের পরই এ নিয়ে আপত্তির কথা জানিয়ে ফিফার সমালোচনা করেছেন। আবারও সেই প্রসঙ্গ তুলে বললেন, ‘কালকের দিনটা (বৃহস্পতিবার) তো গেল রিকভারি করতেই। আজ একটাই ট্রেনিং সেশন, তা দেখে আমাকে সবকিছু চূড়ান্ত করতে হবে।’

অস্ট্রেলিয়াও একই দিন শেষ গ্রুপ ম্যাচ খেলেছে। তবে আর্জেন্টিনার চেয়ে চার ঘণ্টা আগে। এটাকেও অনেক বড় ব্যাপার মনে হচ্ছে স্কালোনির, ‘আমরা রাত ১০টায় খেলতে নেমেছি। ম্যাচ শেষে ফেরার পর বিছানায় যেতে যেতে ভোর চারটা।’

এসব জয় করার প্রেরণাটাও খেলোয়াড়দের মনে করিয়ে দিচ্ছেন স্কালোনি। আর্জেন্টিনার ম্যাচে গ্যালারি নীল-সাদা করে রাখছেন আর্জেন্টাইন সমর্থকেরা। বাংলাদেশে আর্জেন্টিনা নিয়ে উন্মাদনার কথাও এল। বিশ্বকাপ ফুটবলে আর্জেন্টিনা ফুটবল দলের কোচের সংবাদ সম্মেলন শেষ হচ্ছে বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানানোর মাধ্যমে...এই বিশ্বকাপ বিস্ময় উপহার দিচ্ছে অনেকভাবেই।