ফুটবলের অমর জুটি মেসি ও দি মারিয়া
ফুটবলের অমর জুটি মেসি ও দি মারিয়া

মেসি–দি মারিয়া: ভাঙছে ফুটবলের অমর এক জুটি

লা মাঞ্চার দন কিহোতোর কথা নিশ্চয়ই আপনাদের মনে আছে। মনে না থাকলে আরেকবার মনে করিয়ে দেওয়া যাক। ১৭ শতকে ‘দন কিহোতো’ নামে উপন্যাসটি লিখেছিলেন কিংবদন্তি স্প্যানিশ লেখক মিগেল দ্য সের্ভান্তেস। অনেকের মতে এই উপন্যাসটি দিয়েই শুরু হয়েছে আধুনিক সাহিত্যের পথচলা।

এই উপন্যাসে ‘দন কিহোতো’ নামের এক স্প্যানিশ নাইট তাঁর সহচর সানচো পানশাকে নিয়ে নিত্যনতুন সব অভিযানে বের হতেন। সের্ভান্তেসের জাদুকরি বর্ণনায় দুই অভিযাত্রীর অবিশ্বাস্য ও মজার অভিযানের গল্পগুলো আপনাকে দেবে নিরেট আনন্দ। কখনো কখনো চরিত্র দুটির জন্য আপনার মায়া হবে। বেদনাও বোধ করবেন।

আপাতদৃষ্টিতে মজার ও হাস্যকর মনে হলেও এই উপন্যাসে আধুনিক মানুষ সম্পর্কে গূঢ় সব সত্য প্রকাশ করেন সের্ভান্তেস। মানুষের বন্ধুত্ব, বিশ্বস্ততা, আস্থা ও নির্ভরতার দলিলও যেন দন কিহোতো ও সানচো পানশার এই উপাখ্যান।

যেখানে দন কিহোতোর সমস্ত অভিযানে বিনা প্রতিবাদে ও প্রশ্নে অংশ নেন সানচো পানশা। এমনকি সন্দেহ ও অনাস্থাটুকুও কখনো কিহোতোকে বুঝতে দেন না সানচো। মৃত্যুর আগমুহূর্তেও থাকেন কিহোতোর ছায়াসঙ্গী হয়ে। আধুনিক ফুটবলেও আছে তেমন এক মানিকজোড়!

যেখানে একজনকে দন কিহোতো ভাবলে অন্য জনকে সানচো পানশা বলাই যায়। আর আমাদের সেই দন কিহোতো হলেন লিওনেল মেসি, আর সানচো পানশা? নিঃসন্দেহে আনহেল দি মারিয়া। যিনি মেসি ও ফুটবল-ঈশ্বরের নিরন্তর সংযোগ রক্ষা করে চলা এক স্বর্গীয় বার্তাবাহক। তবে পার্থক্য হচ্ছে, আধুনিক দন কিহোতো তথা মেসির আগেই আজ ফুটবল থেকে বিদায় নিচ্ছেন ফুটবলের এই সানচো পানশা। অর্থাৎ দি মারিয়া।

আর্জেন্টিনার হয়ে সর্বশেষ ম্যাচের প্রস্তুতিতে আনহেল দি মারিয়া, পাশে লিওনেল মেসি

কোপা আমেরিকার ফাইনাল শেষেই যিনি ইতি টানবেন তাঁর দুঃসাহসিক অভিযাত্রার। আর কখনো দন কিহোতোর সঙ্গী হয়ে ফুটবলের সবুজ গালিচায় উইং ধরে আক্রমণে যেতে দেখা যাবে না আধুনিক ফুটবলের এই সানচো পানশাকে। যিনি না থাকলে উপন্যাসের কিহোতোর মতো ফুটবলের কিহোতোকেও হয়তো হতাশা নিয়েই অভিযান শেষ করতে হতো। তবে অর্জন ও প্রাপ্তির গল্পটা ভিন্ন হলেও মেসির প্রতি দি মারিয়ার আবেগ কিংবা দুজনের সম্পর্কটা কিহোতো এবং সানচোর মতোই অমলিন।

কিহোতোর প্রতি নিজের আনুগত্য প্রকাশে একবার সানচোকে আমরা বলতে শুনেছিলাম, ‘আমার আর কিছুই করার ক্ষমতা নেই, ওর সঙ্গে থাকা, পেছন পেছন ঘোরা ছাড়া আমি এখন অন্য কিছু ভাবতে পারি না। আমরা দুজন এক গাঁয়ের লোক। আমি ওর নুন খাই, তাই গুণ গাই। আসলে লোকটাকে আমার ভালো লাগে, আমার প্রতি তার টান আছে।... আমাদের এই জোড় ভাঙতে পারে একমাত্র কোদাল আর মাটি, মানে মরণ।’ মেসি ও মারিয়ার সম্পর্ক নিয়েও তো এই কথাগুলো আমরা বলতে পারি! সেমিফাইনালের আগে মেসি মারিয়াকে যা বলেছিলেন সেটা এই উইঙ্গারের মুখেই শোনা যাক, ‘মাঠে নামার আগে লিও (মেসি) বলেছে, তারা আমার জন্য ফাইনালে উঠতে চায়। হৃদয়টা গর্বে ভরে গেছে।’

কী কাকতালীয় দেখুন না, এক বছরের ব্যবধানে পৃথিবীর আলোয় আসা এ দুজনের জন্ম কিন্তু কিহোতো আর সানচোর মতো একই শহরে। রোজারিও থেকে যাত্রা শুরুর পর দুজনের লক্ষ্যটা এক বিন্দুতে এসে মিলতেও খুব বেশি সময় লাগেনি। এরপর শুরু হয় তাঁদের যৌথ অভিযানের। যার শুরুটা শুধুই ব্যর্থতা ও হতাশার। দুজনের হতাশার শুরুটা সেই ২০১০ বিশ্বকাপ দিয়ে। দক্ষিণ আফ্রিকার সেই বিশ্বকাপে শেষ আটেই থেমে যায় মেসি-মারিয়ার যাত্রা। কে জানত, সেদিনের হারে দুঃসময় শেষ হয়নি, বরং সেটি ছিল কেবলই শুরু।

এরপর আফ্রিকার দুঃখ ভুলতে চার বছর পর দুজন মিলে অভিযানে যান প্রতিবেশী ও চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দেশ ব্রাজিলে। অভিযানের সব ঠিকঠাকই এগোচ্ছিল। মারাকানায় ফাইনালের টিকিটও কেটে ফেলেছিলেন তাঁরা। কিন্তু এরপরই ঘোরতর এক দুঃস্বপ্নে ঘুম ভাঙে মারিয়ার। অপয়া চোট তাঁকে ছিটকে দেয় ফাইনাল থেকে। কিন্তু খেলার জন্য সেদিন সম্ভাব্য সব চেষ্টাই করেছিলেন মারিয়া।

ট্রেনারকে বলেছিলেন, ‘আমি ভেঙেচুরে গুঁড়িয়ে যেতে রাজি আছি। কিছুই পরোয়া করি না। কিন্তু সবকিছুর বিনিময়ে আমি খেলতে চাই।’ একই কথা বলেছিলেন কোচ আলেসান্দ্রো সাবেয়াকেও, ‘আমি শুধু বিশ্বকাপ জিততে চাই। তুমি যদি আমাকে মাঠে নামাও, আমি ভেঙেচুরে না যাওয়া পর্যন্ত খেলব।’ বেঞ্চে বসে সেদিন কোচের ডাকের অপেক্ষায় ছিলেন আধুনিক ফুটবলের সানচো পানশা। নাহ, অভিযানে নামার সেই ডাক আর আসেনি।

বিশ্বকাপ ট্রফি হাতে দি মারিয়া ও তাঁর পরিবার

সহচরকে ছাড়া আধুনিক ফুটবলের দেবদূতের জীবনেও নেমে আসে ঘোরতর এক দুঃসময়। সেদিন ঐশ্বরিক বার্তাবাহক দি মারিয়া মাঠে নামতে না পারায় দেবপুরুষ মেসিও আর কোনো দিক খুঁজে পাননি। ১২০ মিনিট দিগ্‌বিদিক ছোটার পর আমাজনে জলাঞ্জলি দিয়ে আসেন বিশ্বকাপ শিরোপা স্বপ্ন। আধুনিক ফুটবলের এই দুই নাইটের পরের দুটি অভিযান ছিল নিষ্ফলা ও কান্নায় ভেজা। কিহোতো ও সানচোর মতো এবার তাঁরা অভিযানে গিয়েছিলেন চিলিতে। কিন্তু এবারও ফাইনালে সেই ভুতুড়ে চোট-কাণ্ড।

এবারও নামার পর মাত্র ২৯ মিনিটে ছাড়তে হলো মাঠ। সহযোদ্ধাকে হারিয়ে এবারও হতাশায় অভিযান শেষ করতে হলো মেসিকে। এক বছর পর আবারও সেই একই গল্পের পুনরাবৃত্তি। যুক্তরাষ্ট্রে কোপার সেই ফাইনালে এবার দি মারিয়া মাঠ ছাড়লেন ৫৭ মিনিটে। আর হারের পর কাঁদতে কাঁদতে মেসি ছেড়ে দিলেন আন্তর্জাতিক ফুটবলই।
তবে অভিযান অসমাপ্ত রেখে নাইট কি আর যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বিদায় নিতে পারেন!

কোটি ভক্তের ডাকে সাড়া দিয়ে মেসিকেও ফিরতে হলো। কিন্তু ভাগ্য তবু তাঁদের দিকে ফিরে তাকাল না। একপর্যায়ে মনে হচ্ছিল, হয়তো উপন্যাসের দন কিহোতো ও সানচোর মতো, জাতীয় দলের জার্সিতে ফুটবলের দুই নাইটের অর্জনও মরীচিকা ও আকাশকুসুম স্বপ্ন হয়ে থেকে যাবে। আর দন কিহোতোর মতো বিদায় বেলায় মেসিও হয়তো বলবেন, ‘ঈশ্বরের অসীম করুণায় আমার ভুল ভাবনাচিন্তা থেকে অব্যাহতি পেয়েছি।’


কিন্তু নাহ্, এবারের শেষের অধ্যায়টা বদলে দিলেন অলক্ষ্যে বসে ফুটবলের ভাগ্যলিপি লিখতে থাকা অন্য এক সের্ভান্তেস। যেখানে নায়ক ও সহনায়কের গল্প যে গল্পের শুরুটা হয় সেই মারাকানা দিয়েই। তাঁর গোলেই সেদিন ব্রাজিলের মাটিতে ব্রাজিলকে হারিয়ে কোপা আমেরিকার শিরোপা জেতে আর্জেন্টিনা। আর্জেন্টাইন ফুটবলের আধুনিক সানচো পাশার হাত ধরেই দন কিহোতো তথা মেসি পান তাঁর প্রথম সাফল্য। এরপর ফিনালিসিমাতেও সেই মারিয়ার গোলেই ইতালিকে হারিয়ে নিজের দ্বিতীয় সাফল্য পান মেসি।

এভাবে আর কখনো একসঙ্গে দেখা যাবে না মেসি ও দি মারিয়াকে

তারপর আসে এই দুজনের যুগলযাত্রার সবচেয়ে বড় অভিযানটি। আর এবারও দন কিহোতোকে অভিযান জেতাতে এগিয়ে এলেন সেই সানচো পানশা। ২০২২ বিশ্বকাপে লুসাইলের ফাইনালে দি মারিয়াই প্রথম পেনাল্টিটি আদায় করে দিয়েছিলেন মেসিকে। এরপর করেছিলেন ম্যাচের দ্বিতীয় গোলটিও। দি মারিয়ার গোলের পর মেসি কি হারতে পারেন! সেদিন যত নাটকীয়তাই হোক, শেষ পর্যন্ত মেসিকেই গোল করতে হতো। ফুটবলের সানচো পানশা যে দন কিহোতোর জন্য গোল করেছেন! সেই গোলই এশিয়ান ভূখণ্ডে ‘নাইট’ মেসির ক্যারিয়ারকে দিল পূর্ণতা। ট্রফি নিয়েই একসঙ্গে নিজেদের লা মাঞ্চা তথা রোজারিওতে ফিরেছিলেন তাঁরা। যেখান থেকে শুরু হয়েছিল এই অভিযাত্রা।

এখন আরও একটি অভিযান জয়ের দ্বারপ্রান্তে এই মানিকজোড়। কলম্বিয়ার বিপক্ষে কোপা আমেরিকা ফাইনাল দিয়ে শেষ হবে এ যুগলের পথচলা। আর্জেন্টাইন ফুটবলের সানচো পানশা যে এখানেই আন্তর্জাতিক ফুটবল অভিযানের ইতি টানতে যাচ্ছেন। সানচোর বিদায়ের পর দন কিহোতো তথা মেসির ফুটবল অভিযান কতটা দীর্ঘায়িত হবে, সে প্রশ্নের উত্তর অজানা। তবে সানচোকে ছাড়া কিহোতোর পথচলায় যে একটা বিশাল শূন্যতা তৈরি হবে, সেটি তো না বললেও চলছে।