ম্যাচের আগেই অস্ট্রেলিয়ান ফুটবলারদের উচ্চতা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন কোচ হাভিয়ের কাবরেরা। মেলবোর্নের এ এএমআই পার্কে খেলা শুরুর চতুর্থ মিনিটেই সেই উচ্চতা ব্যবহার করে অস্ট্রেলিয়া দেখিয়ে দিয়েছে কাবরেরার শঙ্কা কতটা সত্যি। শুধু উচ্চতা কেন, ব্যক্তিগত স্কিলেও দুই দলের খেলোয়াড়দের পার্থক্য কতটা সেটিও বুঝতে পেরেছে বাংলাদেশ। কনোর মেটকাফে, ব্রেন্ডন বোরেলো, মিচেল ডিউক, ক্রেইগ গুডইউনরা রীতিমতো ছেলেখেলা করলেন বাংলাদেশের ফুটবলারদের সঙ্গে। অস্ট্রেলিয়ান হাই প্রেসিং ফুটবল, নিখুঁত পাসের সামনে মেলবোর্নে আজ জামাল ভূঁইয়া, মোহাম্মদ হৃদয়, তারিক কাজীরা ছিলেন একেবারেই অসহায়। র্যাঙ্কিংয়ের ২৭ নম্বর স্থানে থাকা অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ‘সম্মানজনক’ কিছু করার লক্ষ্য নিয়েই মাঠে নেমেছিল বাংলাদেশ। কিন্তু স্কোরলাইনটা তেমন সম্মান জনক থাকল কই। বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের দ্বিতীয় রাউন্ডে ‘আই’ গ্রুপে নিজেদের প্রথম ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার কাছে ৭–০ গোলে হেরেছে বাংলাদেশ।
গত অক্টোবরে মালদ্বীপের বিপক্ষে বাছাইপর্বের প্রাথমিক রাউন্ডে ঢাকার যে ম্যাচটি বাংলাদেশ জিতেছিল, সেই দলে আজ দুটি বদল এনেছিলেন কোচ হাভিয়ের কাবরেরা। ডিফেন্ডার শাকিল হোসেনের জায়গায় হাসান মুরাদ, আর সে ম্যাচে লাল কার্ড দেখা সোহেল রানা জুনিয়রের জায়গায় খেলেছেন মজিবর রহমান জনি। মুরাদ আজ ম্যাচে একেবারে খারাপ খেলেননি। শাকিল অবশ্য পরে মুরাদের বদলি হিসেবেই মাঠে নামেন।
ম্যাচের চতুর্থ মিনিটেই ‘সেট পিস’ প্রথম সর্বনাশটা করে বাংলাদেশের। বক্সের একটু দূরে মোহাম্মদ হৃদয় ফাউল করেছিলেন ক্রেইগ গুডউইনকে। সেই গুডউইনের ফ্রি কিক থেকেই হেড করে গোল করেন হ্যারি সুটার। বাংলাদেশের রক্ষণ সেনাদের মাথার ওপর দিয়ে রীতিমতো দাঁড়িয়ে থেকেই হেড করেন ইংলিশ ক্লাব লেস্টার সিটির হয়ে খেলা সুটার। ৬ ফুট ৬ ইঞ্চি উচ্চতার সুটার পুরোপুরি ব্যবহার করেন নিজের উচ্চতা। বাংলাদেশের রক্ষণভাগের খেলোয়াড়েরা বুঝেই উঠতে পারেননি, সুটার কীভাবে তাদের মাথার ওপর দিয়ে হেড করলেন!
গোল খেয়ে বাংলাদেশ একটা ভালো আক্রমণে অবশ্য উঠেছিল বাংলাদেশ। মাঝমাঠ থেকে জামাল ভূঁইয়ার লম্বা থ্রু থেকে বল পেয়ে গিয়েছিলেন রাকিব হোসেন। তিনি সুন্দর করে অস্ট্রেলীয় সীমানায় ঢুকেও পড়েছিলেন, কিন্তু স্কিলে পেরে ওঠেননি। এমন আক্রমণ কয়েকটি করেছে বাংলাদেশ। কিন্তু সব আক্রমণ আটকে গেছে এক জায়গায় ব্যক্তিগত টক্করে। রক্ষণেও একই সমস্যা ছিল পুরো ম্যাচ জুড়ে। অস্ট্রেলিয়ার ফুটবলাররা পায়ে-পায়ে বল নিয়ে বারবার যখন ঢুকে পড়ছিলেন, তখন বাংলাদেশের ডিফেন্ডাররা তাদের কোনোভাবেই ঠেকাতে পারছিলেন। অস্ট্রেলিয়ার ফরোয়ার্ডরা একে অন্যকে ‘ব্যাকআপ’ করেছেন দারুণভাবে। সেই সুযোগটাই পাননি বাংলাদেশের ডিফেন্ডাররা।
অস্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয় গোলটি করেন ব্রেন্ডন বরেলো। অফসাইড ট্র্যাপ ভেঙে কনর মেটকাফে যে কাট ব্যাকটি করেছিলেন, সেটি থেকে গোল করেন বরেলো। ৩৭ মিনিটে আসে তৃতীয় গোল। উচ্চতা ব্যবহার করেই বাংলাদেশের ডিফেন্ডারদের মধ্যে দাঁড়িয়েই বরেলোর ক্রস থেকে হেড করে গোল করেন মিচেল ডিউক। অস্ট্রেলিয়াকে ৪-০ গোলে এগিয়ে নেন ওই ডিউকই। প্রথমার্ধে অস্ট্রেলিয়া এগিয়ে ছিল ৪-০ গোলেই।
দ্বিতীয়ার্ধে আরও তেড়েফুঁড়ে শুরু করে অস্ট্রেলিয়া। তিন খেলোয়াড়কে বদল করে। ৪৭ মিনিটে এক বদলি খেলোয়াড়ই দলকে ৫-০ গোলে এগিয়ে নেন। জর্ডান বসের পাস থেকে গোল করেন ম্যাকলারেন। ৫২ মিনিটে মিতুল মারমার দারুণ একটা গোল বাঁচান। ম্যাকলারেনের গুলির মতো শট বাংলাদেশের গোলকিপার ঠেকান ঝাঁপিয়ে পড়ে। দ্বিতীয়ার্ধে বাংলাদেশ আনে চার পরিবর্তন। অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়ার বদলে নামেন রবিউল হাসান, হাসান মুরাদের জায়গায় শাকিল হোসেন, রাকিবের জায়গায় রফিকুল ইসলাম আর ফয়সাল আহমেদ ফাহিমের জায়গায় শেখ মোরছালিন। কিন্তু অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি।
দলের ষষ্ঠ আর সপ্তম গোলটি করে হ্যাটট্রিক পূরণ করেন ম্যাকলারেন। তিনি তাঁর দ্বিতীয় গোলটি করেন ৭০ মিনিটে। ৮৪ মিনিটে তিনি পূরণ করেন নিজের হ্যাটট্রিক। ম্যাচের একেবারে শেষ দিকে আসে বাংলাদেশের সবচেয়ে উজ্জ্বল মুহূর্তটি। পেনাল্টি ঠেকান গোলকিপার মিতুল মারমা।
২০২২ বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে কাতারের বিপক্ষে দোহার ম্যাচটিতে ৫-০ গোলে হেরেছিল বাংলাদেশ। সে ম্যাচে বাংলাদেশ বুঝেছিল এশিয়ার শীর্ষ কোনো দলের সঙ্গে নিজেদের শক্তির পার্থক্যটা। সেটি ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসের কথা। এরপর বাংলাদেশ প্রচুর ম্যাচ খেললেও এশিয়ার শীর্ষস্থানীয় কোনো দলের বিপক্ষে খেলেনি। জুনের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে লেবানন ও কুয়েতের বিপক্ষে ভালো খেললেও এ দুটি দলের সঙ্গেও অস্ট্রেলিয়ার পার্থক্য অনেক। আজ মেলবোর্নে অস্ট্রেলিয়ার মতো প্রচণ্ড শক্তিশালী দলের সঙ্গে এই ম্যাচটি বড় এক অভিজ্ঞতা হিসেবেই নিতে পারে বাংলাদেশ।