২০২২ সালের ১৪ ডিসেম্বর রাত! আর্জেন্টিনার কাছে হেরে বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল থেকে বিদায় নেয় ক্রোয়েশিয়া। আর্জেন্টিনার ফাইনালে যাওয়ার উৎসবের ভিড়েও একটি মুখ খুঁজে ফিরছিল সবার চোখ। সেই হার দিয়ে যে শেষ হলো কিংবদন্তি লুকা মদরিচের বিশ্বকাপ-স্বপ্ন। সেদিনের সেই হার আরেকবার মদরিচের হৃদয় ভেঙেছিল বটে। অনেকে ধরেও নিয়েছিলেন, সেই হারের পর মদরিচ হয়তো আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারকে বিদায়ই বলে দেবেন।
কিন্তু মদরিচ যে অন্য ধাতুতে গড়া, তাঁর ভেতরের অতিমানবীয় সত্তাটিকে টলানো কি অত সহজ! কেউ অবশ্য পারেওনি! নয়তো বিশ্বকাপের সেই হতাশা ভুলে ছয় মাসের ব্যবধানে মদরিচ নিশ্চয় আরেকটি ফাইনাল খেলতে পারতেন না! পাশাপাশি আরেকটি আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টের ফাইনালে উঠে বুঝিয়ে দিলেন বয়স ৩৭ পেরোলেও এখনো তিনি ফুরিয়ে যাননি।
মদরিচের জীবনের গল্পটাই অবশ্য হার না মানার, ফুটবলের গল্পটাও তাই আর ভিন্ন কেন হবে! তাঁর শরীরে যে লড়াই ও যুদ্ধের রক্ত। সেসবই হয়তো মদরিচকে এখনো তাতিয়ে রেখেছে। যে বয়সে সবাই ফুটবলকে বিদায় বলে সরে দাঁড়ান, সে বসয়ে মদরিচ মাঠে নামছেন শিরোপার সন্ধানে। আর মাঠের মদরিচ তো একেবারেই অন্য রকম। তিনি তখন দলের তরুণতম খেলোয়াড়টির চেয়ে বেশি তরুণ। মাঠের সর্বত্র চষে বেড়াতে পারেন ক্লান্তিহীনভাবে।
কখনো ওপরে উঠে দলের গোলে অবদান রাখছেন, আবার কখনো নিচে নেমে বল ক্লিয়ার করছেন। ক্রোয়াট দলে তো বটেই, আন্তর্জাতিক ফুটবলেও মদরিচ এখন বিরল প্রজাতির এক ফুটবলার। সবশেষ নেদারল্যান্ডসকে হারিয়ে ক্রোয়াটদের নেশনস লিগের ফাইনালে তোলার নায়কও ছিলেন মদরিচ। ১২০ মিনিট মাঠে থেকে গোল করেছেন, করিয়েছেন। গড়ে দিয়েছেন ম্যাচের পার্থক্যও। আর আজ মদরিচের সামনে সুযোগ আক্ষেপ মোচনের। দেশের হয়ে প্রথম কোনো শিরোপা জেতার সুযোগ তাঁর সামনে।
১৭ বছর, ১৬৫ ম্যাচ, ২৪ গোল—পরিসংখ্যানে মদরিচ ধরা দেন এভাবেই। বলা যায়, ক্যারিয়ারের বেশির ভাগ সময়জুড়ে ক্রোয়েশিয়া দলের নিউক্লিয়াস হয়ে ছিলেন এই মিডফিল্ড জেনারেল। দলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে একাধিকবার নিয়ে গেছেন সাফল্যের কাছাকাছিও। কিন্তু শেষ ধাপটি আর কখনোই পেরোনো হয়নি। অথচ সেই মদরিচের দখলে কিনা ক্লাব ফুটবলের ২৯টি শিরোপা, যেখানে ৩টি লা লিগা শিরোপার সঙ্গে ৫টি চ্যাম্পিয়নস লিগ ট্রফিও আছে। জিতেছেন ব্যক্তিগত শ্রেষ্ঠত্বের সর্বোচ্চ পুরস্কার ব্যালন ডি’অরও।
মূলত মদরিচের হাত ধরেই পতন হয়েছিল মেসি-রোনালদোর দ্বৈত সাম্রাজ্যের। কিন্তু জাতীয় দলে চিত্রটা হয়ে আছে মহাকাব্যের ট্র্যাজেডি। ২০১৮ সালের বিশ্বকাপের কথায় ধরা যাক। পুরো টুর্নামেন্টে মদরিচ আলো ছড়িয়ে গেছেন। যে দলটিকে বিশ্বকাপ শুরুর আগে কেউ হিসাবেই রাখেননি, সেই ‘আন্ডারডগ’ দলটিকে মদরিচ নিয়ে গেলেন ফাইনালের মঞ্চে। কিন্তু ফাইনালে এমবাপ্পে-পগবাদের দেয়াল ভেঙে শিরোপা-স্বাদ আর নেওয়া হয়নি। সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে রানার্সআপ হয়ে।
গত বছরের কাতার বিশ্বকাপের গল্পটাও একই। এবার মদরিচের নামের পাশে লাগানো হলো ‘বুড়ো’ ট্যাগ। অথচ সেই ‘বুড়ো’ কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রাজিলের বিপক্ষে ১২০ মিনিট মাঠে থেকে নিখুঁত পাস দিয়েছিলেন ৯০.৫২ শতাংশ। সব মিলিয়ে সফলভাবে সম্পন্ন করেছেন ১০৫টি পাস এবং বল স্পর্শ করেছেন ১৩৯ বার। বলা যায়, ইস্পাতদৃঢ় মদরিচের কাছেই সেদিন হার মানতে হয়েছিল টুর্নামেন্ট ফেবারিট ব্রাজিলকে। কিন্তু সেমিফাইনালে গিয়ে হতাশা নিয়েই থামতে হয়েছিল মদরিচকে।
অবশ্য প্রকৃতি যেখানে লিওনেল মেসির বিশ্বকাপ ট্রফি তুলে দেওয়ার চিত্রনাট্য রচতে বসেছিলেন, মদরিচ সেখানে একা আর কীই–বা করতে পারেন! সেদিনও পারেননি। বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে আন্তর্জাতিক শিরোপার জায়গাটাও তাই খালিই পড়েছিল। তবে শেষবেলায় সেই খালি জায়গা ভরাট করার সুযোগটা আরেকবার এসেছে মদরিচের সামনে। আজ রাতের ফাইনালে স্পেনকে হারাতে পারলে ক্যারিয়ারে প্রথম আন্তর্জাতিক শিরোপার দেখা পাবেন মদরিচ, যা কিনা বিদায়বেলায় ক্রোয়াটদের জন্য মদরিচের বিশেষ উপহারও হয়ে থাকবে।
কিন্তু এবার না হলে হয়তো আর কখনোই নয়। সরাসরি ঘোষণা না দিলেও এ ম্যাচই যে মদরিচের শেষ ম্যাচ হতে পারে, সেই ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছেন মদরিচ। ফাইনালের লড়াই নিয়ে মদরিচ বলেছেন, ‘জাতীয় দলের হয়ে খেলা আমি সব সময় পছন্দ করি। এটি আমার শেষ প্রতিযোগিতা বা শেষ ম্যাচ হতে পারে, সে জন্য নয়। বরং প্রতিটি ম্যাচ (জাতীয় দলের হয়ে) প্রতিটি অনুশীলন আমার জন্য আনন্দের। যতক্ষণ পর্যন্ত আমার মনে হবে আমি সাহায্য করতে পারব, ততক্ষণ পর্যন্ত আমার এখানে না থাকার কোনো কারণ নেই।’
আজ যদি মদরিচ শিরোপা জিততে পারেন, তবে একটি চক্রও পূরণ হবে। ৩৭ বছর আগে বসনিয়া যুদ্ধের সময় সার্বিয়ার আগ্রাসনে পালিয়ে আসা এক পরিবারে মদরিচের জন্ম। জন্মস্থান ক্রোয়েশিয়ার জাদারে। মদরিচের দাদাকে শত্রুপক্ষ মেরে ফেলেছিল এবং ঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। মদরিচের বাবা স্টিপে মদরিচ ছিলেন সেনাবাহিনীর কার মেকানিক, আর মা রাদোকা মদরিচ ছিলেন টেক্সটাইলশ্রমিক। সে সময় মদরিচের পরিবারের খাবার, জামাকাপড় ও থাকার জায়গাটুকুও ছিল না। সেখান থেকেই মদরিচের পায়ে-পায়ে অনবদ্য এক গল্প লেখার শুরু।
যন্ত্রণা ভুলতেই পায়ে তুলে নিয়েছিলেন ফুটবল। সারা দিন বল নিয়ে পড়ে থাকতে দেখে জাদারের চেয়ারম্যান একবার বলেছিলেন, ‘এই ছেলে সারাক্ষণ হোটেল পার্কিংয়ে বলে লাথি মারত। সে ছিল কঙ্কালসার ও বয়সের তুলনায় অনেক ছোট। তবে তার দিকে তাকালে বুঝবেন, বিশেষ কিছু তার মধ্যেও ছিল।’
সেই ‘বিশেষ’ প্রতিভা নিয়েই একসময় মদরিচ হয়ে উঠলেন ইতিহাসের সেরা মিডফিল্ড মায়েস্ত্রোদের একজন। আজ নেশনস লিগের শিরোপাটা তাই মদরিচের জন্য চক্র পূরণের ‘চেরি অন দ্য কেক’ বানানোর সুযোগ। জিতলে যাত্রাটা পূর্ণতা পাবে, নয় তো অনেক প্রাপ্তির ভিড়ে মদরিচকে শেষবেলায় দীর্ঘশ্বাস ফেলতে হবে।
জীবনটাই যাঁরা হার না মানার, তাঁর মুখে দীর্ঘশ্বাস কি মানায়?