ঢাকা স্টেডিয়ামে দর্শকের চিৎকার যেন কাঁপিয়ে দিল গোটা এলাকা! সেই আওয়াজ কানে আসার যে অনুভূতি, তার সঙ্গে আর কোনো কিছুকেই আজ মেলাতে পারেন না আলমাস খান। স্মৃতিচারণা করতে করতে তাঁর গলা ধরে আসে, কণ্ঠে তিরতির আবেগ। ফুঁপিয়ে কাঁদলেন। কোথায় হারাল সেসব দিন, সেই সব মুহূর্ত!
১৯৮৭ সালের লিগের কথা বলছিলেন আলমাস। ৪৭ বছর ধরে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে কাজ করছেন। কৈশোর, যৌবন—সব ঢেলে দিয়েছেন মতিঝিলের টয়নবি সার্কুলার রোডে সাদা-কালোদের এই ক্লাবে। আলমাস ১৯৭৬ সালে মোহামেডানে এসেছিলেন বলবয় হয়ে। খেলোয়াড়দের ফাইফরমাশ খাটতেন। এখন অফিস সহকারী। সেটা আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব, আসলে তাঁর কাজের পরিধি আরও অনেক বিস্তৃত। আলমাস খানকে ছাড়া মোহামেডানের কর্মকর্তারা এক পা-ও নড়তে পারেন না। ক্লাবের কাছে এতটাই বিশ্বাসের, এতটাই নির্ভরতার জায়গা মানুষটি।
মোহামেডান ক্লাবের কয়েক প্রজন্মের স্মৃতির ভারে আলমাস খান নিজেই যেন স্মৃতির এক ‘বটবৃক্ষ’। কত বড় বড় তারকাকে চোখের সামনে দেখেছেন। তাঁদের স্নেহ-ভালোবাসা পেয়েছেন। গজনবী, প্রতাপ শঙ্কর হাজরা, হাফিজউদ্দিন আহমেদ, জাকারিয়া পিন্টু, বাদল রায়, সালাম মুর্শেদী, আবুল হোসেন, শহীদুর রহমান শান্টুদের সঙ্গে কায়সার হামিদ, সাইদ হাসান কানন, রুম্মান বিন ওয়ালি সাব্বির কিংবা ইমতিয়াজ সুলতান জনি, ইমতিয়াজ আহমেদ নকীব, জুয়েল রানা, আলফাজ আহমেদ—নাম বলতে থাকলে সেই তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতরই হবে।
নাসের হেজাজির মতো কোচকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন; এমেকা ইজিউগো, রেজা নালজেগার, ভিজেন তাহিরি, আজামত আবদু রহিমভ, ওলেগ জিভতনিকভদের বিদেশি তারকাদের কত কাজ করে দিয়েছেন। দেশি তারকারা তো তাঁকে দেখেন সহযোগী, বন্ধু কিংবা অভিভাবক হিসেবে। মোহামেডান ক্লাবের চৌহদ্দিতে অনেক কিছু ঘটতে দেখেছেন। আনন্দের স্মৃতি কিংবা দুঃখের—আলমাস যেন মোহামেডানের ‘জীবন্ত’ এক ইতিহাস।
’৮৭-এর লিগের সেই মুহূর্তের কথা বলতে বলতে আবেগ ধরে রাখতে পারলেন না আলমাস, ‘সেবার ব্রাদার্সের সঙ্গে ম্যাচে মোহামেডান এক গোলে পিছিয়ে। সেই ম্যাচ হারলে মোহামেডানের লিগ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কোনো সুযোগ থাকবে না। খেলা শেষ হওয়ার ৫-৭ মিনিট বাকি থাকতে রাগে, দুঃখে, হতাশায় স্টেডিয়াম থেকে বেরিয়ে পড়লাম।
ক্লাবে এসে দেখি সাদা-কালো পতাকাটা তখনো ফ্ল্যাগ স্ট্যান্ড থেকে নামানো হয়নি। আমি সেটি নামাতে লাগলাম। ঠিক তখনই স্টেডিয়ামের দিক থেকে বিকট আওয়াজ শুনলাম। দর্শকদের উল্লাসের আওয়াজ। বুঝে গেলাম, মোহামেডান গোল শোধ করে দিয়েছে। স্টেডিয়ামের সেই আওয়াজের সঙ্গে এখন আর কোনো কিছুরই মিল পাই না ভাই। ওই আওয়াজ অন্য রকম।’ কথাগুলো বলার সময় ফোঁপাচ্ছিলেন আলমাস।
মোহামেডানের সঙ্গে আলমাসের নাড়ির টান। সেই ছোটবেলা থেকে এ ক্লাবে তাঁর আসা-যাওয়া। সেটি অবশ্য ঘটনাচক্রেই। মোহামেডান ক্লাব তখন বায়তুল মোকররম জাতীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে। ষাটের দশকের শেষ দিকের কথা। আলমাসের বাবা ক্লাবের পাশেই একটা মনিহারি দোকান চালাতেন। সেই দোকানে বসতেন আলমাসও। মোহামেডানের সব তারকা ফুটবলার দোকানে আসতেন, টুকটাক জিনিস কিনতেন। আলমাস একদিন সাহস করে ক্লাবের ভেতরে ঢুকে গেলেন। স্যুট-টাই পরা এক ভদ্রলোক তাঁকে ডেকে একটা কাজ করে দিতে বললেন। সেই থেকে শুরু!
স্যুট-টাই পরা সেই ভদ্রলোক ছিলেন মইনুল ইসলাম। মোহামেডান ক্লাবের সেই সময়ের সভাপতি। গণপূর্তের প্রধান প্রকৌশলী মইনুল ইসলাম মোহামেডানের কিংবদন্তি প্রশাসক। নিজের পকেটের টাকা দেদার খরচ করতেন ক্লাবের জন্য, ‘মইনুল সাহেব আমাকে চিনতেন না। ক্লাবের বারান্দায় আমাকে দেখে ইশারায় ডেকেই একটা কাজ করে দিতে বললেন। খুব সম্ভবত দোকান থেকে কিছু একটা এনে দিতে বলেছিলেন। আমি এনে দিলাম। তখন অনেক ছোট। মোহামেডান ক্লাবের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেললাম সেই থেকেই।’
মইনুল ইসলামের সঙ্গে অনেক স্মৃতি আলমাসের, ‘তিনি আমাকে খুবই আদর করতেন। আমাকে খুবই বিশ্বাস করতেন। এমনও হয়েছে, হাতে টাকা দিয়ে বলেছেন কাউকে পৌঁছে দিতে। ক্লাবের অনেক কাগজপত্রও আমার হাত দিয়ে পাঠাতেন। কোনো খেলোয়াড়ের সঙ্গে হয়তো তিনি ব্যক্তিগতভাবে কথা বলবেন, আমাকে বলতেন ডেকে দিতে। এমন মানুষ আর খুঁজে পাওয়া যায় না। শুধু মইনুল সাহেব না, আবদুল মোনেম সাহেবের কথা বলতে হয়, সিরাজুল হক চৌধুরীর কথা বলব, মনিরুল হক চৌধুরী, গজনবী সাহেব, আনোয়ারুল হক হেলাল—সবার স্নেহ, ভালোবাসা পেয়েছি।’
সোনালি সেই অতীত খুব মিস করেন আলমাস, ‘কী ফুটবল ছিল আমাদের! এখন কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে! এই যে মোহামেডান ক্লাব দেখছেন চুপচাপ, ফাঁকা ফাঁকা...আগে তো এমন ছিল না। সারাক্ষণ ভিড় লেগে থাকত সমর্থকদের। সবাই খেলোয়াড়দের দেখার জন্য দাঁড়িয়ে থাকত। লিগ জিতলে কত আনন্দ-উৎসব হতো। সেই দিনগুলো হারিয়ে গেছে। খুব খারাপ লাগে। মোহামেডান ম্যাচ হারলে সমর্থকদের কী ক্ষোভ! ভয়ে খেলোয়াড়েরা তো বটেই, আমরাও ক্লাব থেকে বের হতাম না।’
মোহামেডান ক্লাবে আলমাসের অনেক স্মৃতি। কোনটা ছেড়ে কোনটা বলেন, ‘১৯৮৬ সালে মোহামেডানের অবস্থা খুব খারাপ। তার আগে তিন মৌসুম লিগ জিতেছে আবাহনী। পারলে সমর্থকেরা সবাইকে খেয়ে ফেলে। এর ওপর ফেডারেশন কাপের ফাইনালেই উঠতে পারেনি দল। লিগেও আবাহনী থেকে অনেকটা সময় পয়েন্টের ব্যবধানে পিছিয়ে থাকতে হয়েছে। প্রথম পর্বের শেষ ম্যাচ থেকে পরিস্থিতি ঘুরে গেল। বাদলদার (বাদল রায়) গোলে মোহামেডান জিতল। সুপার লিগের শেষ ম্যাচে আবাহনী ভারত থেকে আনল চিমাকে (নাইজেরিয়ান ফুটবলার), মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য আর ভাস্কর গাঙ্গুলীকে। কিন্তু সে ম্যাচও মোহামেডান জিতল। ইলিয়াস আর মনু ভাইয়ের গোলে। মনু ভাইয়ের গোলটি ছিল অসাধারণ। সেদিন ক্লাবে সারা রাত ধরে রং খেলা হয়েছিল। সেই স্মৃতি ভোলার নয়।’
আলমাসের দৃষ্টিতে মোহামেডানের সেরা সময় ছিল ইরানি কোচ নাসের হেজাজির অধীন। ১৯৮৭ সালে মোহামেডান কোচ কাম খেলোয়াড় হিসেবে নিয়ে এসেছিল ইরানের হয়ে ১৯৭৮ বিশ্বকাপ খেলা গোলরক্ষক হেজাজিকে। সঙ্গে আরও তিন ইরানি ফুটবলার—রেজা নালজেগার, মোর্তজা ইয়াকেহ ও বোরহানজাদেহ।
হেজাজিকে নিয়ে অনেক স্মৃতি আলমাসের, ‘হেজাজি সাহেব সাতাশি সালের লিগে একটি ম্যাচেই মাঠে নেমেছিলেন, সেটা আবাহনীর সঙ্গে। গোলরক্ষক কানন আহত হয়েছিল। ২১ মিনিট খেলেছিলেন তিনি। ২-১ গোলে পিছিয়ে থাকা মোহামেডান সেই ম্যাচ জিতেছিল ৩-২ গোলে। হেজাজি কোচ হিসেবে কেমন ছিলেন, সেটা খেলোয়াড়েরা বলতে পারবেন। তবে তাঁর সময় মোহামেডান দুটি লিগ শিরোপা জিতেছিল। এশিয়ান ক্লাব কাপে এশিয়ার বড় বড় দলের সঙ্গে সমানতালে টক্কর দিয়েছিল। ওই সময় ক্লাবে অনেক পরিবর্তন আসে। আধুনিক ধ্যানধারণা নিয়ে এসেছিলেন তিনি। প্রথমেই খেলোয়াড়দের খাওয়াদাওয়ায় পরিবর্তন এনেছিলেন। তিনি ম্যাচের আগে ফুটবলারদের ভাত খেতে দিতেন না, এটা মনে আছে। আমাকে দেখলেই ভাঙা ভাঙা বাংলায় বলতেন, “আলমাস আছিস কেমন!” উনি পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। আল্লাহ তাঁকে বেহেশত নসিব করুন।’
বহু বছর প্রিমিয়ার লিগের শিরোপার মুখ দেখেনি মোহামেডান। সাদা-কালো জার্সির সেই জৌলুশ আর নেই। মোহামেডানকে নিজের জীবনের অংশ করে ফেলা আলমাস খানের জন্য ব্যাপারটি নিরন্তর কষ্টের। তবু তাঁর মন-প্রাণজুড়ে এই ক্লাব, ‘মোহামেডানের ভালো সময় দেখেছি। উপভোগ করেছি। খারাপ সময়ে তো আমাকে আরও বেশি করে ক্লাবের পাশে থাকতে হবে। অপেক্ষা করে আছি, সেই দিনগুলো আবার ফিরবে। সাফল্যে সাফল্যে উৎসবমুখর হয়ে উঠবে এ ক্লাব। সেই দিন খুব বেশি দূরে নয়!’