ক্যালেন্ডারের পাতা ওলটাতে ওলটাতে চলে গেছে ৫৩টি বছর। কিন্তু ১৯৭১ এখনো অমলিন বাংলাদেশের ক্রীড়া ইতিহাসে। ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই ভূখণ্ডের স্বাধীনতার জন্য সব জনপদ যখন রক্তাক্ত, বাংলাদেশের দামাল ছেলেদের একটি দল ফুটবলকে হাতিয়ার বানিয়ে নেমে পড়ে স্বাধীনতাযুদ্ধে। তাদের যুদ্ধটা ছিল একটু ভিন্ন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরি ও মুক্তিযোদ্ধাদের অর্থসহায়তার উদ্দেশ্যে ভারতের বিভিন্ন শহরে ১৬টি প্রদর্শনী ম্যাচ খেলেছে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল। যা থেকে মুক্তিযোদ্ধা তহবিলে কয়েক লাখ টাকা অনুদান দেওয়া হয়েছিল।পৃথিবীর ইতিহাসে দেশের স্বাধীনতার পক্ষে যুদ্ধের সময় গড়া প্রথম এবং একমাত্র ফুটবল দল এটি।
২০০৩ সালে জারি করা সরকারি প্রজ্ঞাপনে স্বাধীন বাংলা দলের খেলোয়াড়সংখ্যা ৩১ বলা হয়েছে। তবে ঐতিহাসিক দলটি গঠনের নেপথ্যে থাকা বাংলাদেশ ক্রীড়া সমিতির প্রথম সভাপতি শামসুল হক স্বাক্ষরিত তালিকা থেকে জানা যায়, স্বাধীন বাংলা দলের খেলোয়াড় সংখ্যা ৩৫। সংগঠক ১৩ জন, কোচ ও ম্যানেজার একজন করে। খেলোয়াড় ৩৫ জন ধরলে তাঁদের ১৮ জনই আজ স্মৃতির পাতায় স্থায়ীভাবে ঠাঁই নিয়েছেন। বাকি ১৭ জন দেশে-বিদেশ নানা জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন। সংগঠকদের মধ্যে আছেন দলটির গর্বিত ম্যানেজার তানভীর মাজহার তান্না। তবে বাংলাদেশ ক্রীড়া সমিতির ১৩ সংগঠকের কেউই আর নেই। কোচ ননী বসাকও চলে গেছেন সেই কবে।
সর্বশেষ চলে গেছেন ফজলে সাদাইন খোকন। অধিনায়ক জাকারিয়া পিন্টু গেলেন কদিন আগে। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর এই প্রথম বিজয় দিবসে নেই জাকারিয়া পিন্টু। চলে যাওয়া বাকি নামগুলো আইনুল হক, আলী ইমাম, সাইদুর রহমান প্যাটেল, মেজর জেনারেল (অব.) খন্দকার নুরুন্নবী, এ কে এম নওশেরুজ্জামান, শেখ মনসুর আলী (লালু), অমলেশ সেন, বিমল কর, শেখ আবদুল হাকিম, লুৎফর রহমান, দেওয়ান মোহাম্মদ সিরাজউদ্দিন সিরু, আবদুস সাঈদ, মনিরুজ্জামান পেয়ারা, আমিনুল ইসলাম সুরুজ, মাহমুদুর রশিদ ও আবদুল খালেক।
সবার আগে পরপারে পাড়ি জমান গেন্ডারিয়ার শেখ মনসুর আলী লালু। মুক্তিযুদ্ধ শেষে একাত্তরের ১৮ ডিসেম্বর ঢাকায় ফিরে ওই দিনই চলে গেছেন তিনি। সেটিও এক দুর্ঘটনায়। স্বাধীন বাংলা দলের সদস্য শেখ আশরাফ আলী ৫৩ বছর পেছনে ফিরে তুলে আনেন দিনটা, ‘আমি আর লালু ১৮ ডিসেম্বর কলকাতা থেকে একসঙ্গে ঢাকা আসি। যদ্দুর শুনেছি, ইস্টএন্ড ক্লাবে ওই দিন আড্ডা মারছিল লালু। তারুণ্যের রোমাঞ্চেই কি না, একটা রিভলবার দেখে নাড়াচাড়া করেছিল। ওটার ভেতরে যে গুলি ছিল, জানত না। হঠাৎ গুলি বের হয়ে যায়। ঘটনাস্থলেই লালু মারা যায়। সেই রাতে ইস্টএন্ড ক্লাবের পাশে দাফন করা তাকে।’
১৯৮৯ সালের ১৪ মার্চ ঢাকার কলাবাগানে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে মারা যান আলী ইমাম। ১৯৯৪ সালের ৯ মে মাহমুদুর রশিদ, ২০০৪ সালের ৮ অক্টোবর মনিরুজ্জামান পেয়ারা, ২০১৩ সালে সিরাজউদ্দিন সিরু, ২০১৬ সালের ৮ ডিসেম্বর ঢাকায় মেজর জেনারেল (অব.) খন্দকার নুরুন্নবী। ২০১৭ সালের ২৮ আগস্ট ক্যানসারের কাছে হার মানেন আইনুল হক।
একই বছরে ৭ অক্টোবর ধানমন্ডিতে আবাহনী ফুটবল দলকে অনুশীলন করাতে করাতে হার্ট অ্যাটাকে চলে যান অমলেশ সেন। ২০১৯ সালের ১৪ জুন আবদুল খালেক, ২০২০ সালের ১৯ জুন যশোরে নিজ বাসভবনে লুৎফর রহমান, একই বছর ২১ সেপ্টেম্বর করোনাভাইরাসের কাছে হার মানেন নওশেরুজ্জামান, ২০২২ সালের ২৮ আগস্ট মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়ে ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন যশোরের আবদুল হাকিম। আবদুস সাঈদ মারা গেছেন৩০ জানুয়ারি ২০০৮ সালে।
গত পাঁচ মাসে চলে গেছেন ৫ জন। ২৯ জুলাই আমিনুল ইসলাম সুরুজ, ৮ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রে স্বাধীন বাংলা দলের অন্যতম উদ্যোক্তা ও ফুটবলার সাইদুর রহমান প্যাটেল, ১৯ সেপ্টেম্বর বিমল কর, ১৮ নভেম্বর অধিনায়ক জাকারিয়া পিন্টু ও ৭ ডিসেম্বর অনন্তলোকে পাড়ি জমিয়েছেন ৭২ বছর বয়সী ফজলে সাদাইন খোকন। একে একে স্মৃতির পাতায় ঠাঁই নিচ্ছেন ইতিহাসের মহানায়কেরা।
স্বাধীন বাংলা দলের বীরত্বগাথার গল্প চাইলে আপনি শুনতে পারেন ১৭ জনের কাছে। কিন্তু অনেকের স্মৃতিতেই ধুলো জমেছে, এখন আর অনেক কিছু মনে নেই। গর্বটা ঠিকই রয়ে গেছে প্রতাপ শঙ্কর হাজরা, কাজী সালাহউদ্দিন, এনায়েতুর রহমান খান, শেখ আশরাফ আলী, শাহজাহান আলম, মুজিবুর রহমান, মোহাম্মদ কায়কোবাদ, তছলিম উদ্দিন শেখ, সুভাষ সাহা, বীরেন দাস বীরু, আবদুল মোমেন জোয়ার্দার, সঞ্জীত কুমার দে, মোজাম্মেল হক, আবদুস সাত্তার, অনিরুদ্ধ চ্যাটার্জি, নিহার রঞ্জন দাস, প্রাণ গোবিন্দ কুন্ডুদের।
চুয়াডাঙ্গার আবদুল মোমেন জোয়ার্দার, মাদারীপুরের মুজিবুর রহমান বর্তমানে কোথায় আছেন, জানা যায়নি। অনিরুদ্ধ সত্তরের মাঝামাঝি মধ্যপ্রাচ্য চলে যান বলে জানালেন প্রতাপ শঙ্কর হাজরা। সেখান থেকে নাকি ভারতে পাড়ি দেন। এখন কলকাতার স্থায়ী বাসিন্দা। নিহারও ভারতে থাকেন। প্রাণ গোবিন্দ কুন্ডু যুক্তরাষ্ট্রে, এনায়েতুর রহমান কানাডায়। তছলিম উদ্দিন নাটোরে, সুভাষ সাহা নরসিংদীতে, বীরেন দাস খুলনায়, সঞ্জীত কুমার দে নারায়ণগঞ্জে থাকেন বলে জানা গেছে। বাকি সাতজন ঢাকায় আর মুখগুলোও চেনাজানা—প্রতাপ শঙ্কর হাজরা, কাজী সালাহউদ্দিন, শেখ আশরাফ আলী, মোহাম্মদ কায়কোবাদ, আবদুস সাত্তার, মোজাম্মেল হক ও শাহজাহান আলম।
নিজেদের মধ্যে অবশ্য যোগাযোগ কম। মৃত্যুর পর দেখা যায় একেকজন খবরে আসেন। শেখ আশরাফ আলী মোটামুটি খোঁজখবর রাখেন, তবে সবার বর্তমান অবস্থান তাঁরও জানা নেই। নিজেই বললেন, ‘বহু বছর ধরে অনেকের সঙ্গেই যোগাযোগ নেই। আসলে সবাই যার যার জীবনে ব্যস্ত। অনেকে অসুস্থ। জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে সবাই। তছলিম অসুস্থ। তছলিম, মোজাম্মেল, বীরু, সাত্তার মাঝেমধ্যে ফোন করে। টুকটাক কথা হয়। ব্যস, এটুকুই।’
৫৩ বছরে কত কিছুই বদলেছে। বদলায়নি শুধু তাঁদের বিজয়ের আনন্দ। সেই আনন্দের অনুভূতি শব্দের মালায় গাঁথতে গিয়ে আজও আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়াবিদেরা। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের দিনে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সহ-অধিনায়ক প্রতাপ শঙ্কর হাজরা ছিলেন কলকাতায় তাঁর চাচাতো ভাই আমহার্স্ট থানার ওসি তারা শঙ্কর হাজরার বাসায়।
৫৩ বছর পেছনে ফিরে অশীতিপর প্রতাপ আজও আপ্লুত, ‘আমরা পরিবারসহ আমহার্স্ট স্ট্রিটে ওনার বাসাতেই থাকতাম। ওখান থেকে দলের সঙ্গে যাতায়াত করতাম। ১৬ ডিসেম্বর মুক্তির খবরটা পেয়ে আনন্দে আত্মহারা ছিলাম। যেন মায়ের মুক্তি হয়েছে। ১৮ ডিসেম্বর আমি আর কায়কোবাদ মেহেরপুর দিয়ে বাংলাদেশে আসি। সেসব দিন কখনো ভোলার নয়।’
১৬ ডিসেম্বর মুক্তির খবরটা পেয়ে আনন্দে আত্মহারা ছিলাম। যেন মায়ের মুক্তি হয়েছে। ১৮ ডিসেম্বর আমি আর কায়কোবাদ মেহেরপুর দিয়ে বাংলাদেশে আসি। সেসব দিন কখনো ভোলার নয়।প্রতাপ শঙ্কর হাজরা, সদস্য, স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল
শেখ আশরাফ আলী ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর কলকাতার ধর্মতলায় স্বাধীন বাংলা দলের ক্যাম্পে ছিলেন। সেখানে ছিলেন আরও কয়েকজন। দিনটা উদ্যাপন করেছিলেন নিজেদের মতো করে। আবাহনীর সাবেক অধিনায়ক ডুব দেন স্মৃতিতে, ‘পাকিস্তান আর্মি ঢাকায় আত্মসমর্পণ করেছে, এটা শুনে আমরা আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ি। ওই অনুভূতি আজ এত বছর পর বুঝিয়ে বলা কঠিন। সেদিন কলকাতার রাস্তায় একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে বিজয় উদ্যাপন করি।’
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর হিলি সেক্টরে উল্টো দিকে বালুর ঘাটে ছিলেন সুভাষ সাহা। সেখানে একাই ছিলেন জানিয়ে নরসিংদী থেকে ফোনে তাঁর কণ্ঠে দিনটির বর্ণনা, ‘বালুর ঘাটে তখন ভারতীয় সেনা অফিসাররা ছিলেন। তাঁরা আমাকে অভিনন্দন জানান। কয়েকজন আমাকে মিষ্টির দোকানে নিয়ে মিষ্টি খাওয়ান। আর্মি অফিসাররা দোকানদারকে বলেছিলেন, আমাকে সব খাওয়াতে। টাকা তারা দেবে।’
৫৩ বছরের এসব স্মৃতি আজও অমলিন মুক্তিযোদ্ধা ফুটবলারদের কাছে।