ইউরোতে হতাশ করেছেন রোনালদো
ইউরোতে হতাশ করেছেন রোনালদো

ইউরো

নিষ্প্রভ রোনালদোই কি ডোবালেন পর্তুগালকে

থিও হার্নান্দেজ যখন টাইব্রেকারে শেষ শটটি নিতে আসছিলেন, তখনো হয়তো ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর বিশ্বাস ছিল, কিছু একটা হতে পারে। এই দিয়োগো কস্তাই তো দুই দিন আগে টানা তিন পেনাল্টি শট ঠেকিয়ে দায়মুক্তি দিয়েছিলেন রোনালদোকে। আজও কি তেমন কিছু হবে? কিন্তু এবার আর হলো না। হার্নান্দেজ ভুল করেননি।

হার্নান্দেজের লক্ষ্যভেদ ফ্রান্সকে ইউরোর সেমিফাইনালে তুলে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রোনালদোর ইউরো–অধ্যায়েরও ইতি টেনে দিয়েছে। ম্যাচ শেষে আগের দিনের মতো কান্নায় ভেঙে পড়েননি। তবে পর্তুগিজ মহাতারকার বিধ্বস্ত মুখচ্ছবিই বলে দিচ্ছিল, ভেতরটা ধসে পড়েছে তাঁর। চেষ্টা করেও যেন আড়াল করতে পারছেন না কান্না।

এভাবে ইউরোর সমাপ্তিটা হয়তো কল্পনা করে আসেননি ‘সিআর সেভেন’। কিন্তু নিয়তির সঙ্গে কে আর লড়তে পারে! রোনালদো অবশ্য গোধূলিবেলায় এসে সে লড়াইটাই লড়তে চেয়েছিলেন। কিন্তু পারলেন আর কই! বরং ৪০ ছুঁই ছুঁই শেষ বেলায় তাঁর জোর করে টিকে থাকার আকাঙ্ক্ষা পর্তুগালকে ডোবাল কি না, সে প্রশ্নও তুলেছেন অনেকে। এমনকি রোনালদোকে কৌশলী হয়ে খেলালে ইউরোতে পর্তুগালের টিকে থাকার সম্ভাবনা আরও বাড়ত বলেও মনে করেন কেউ কেউ।

জর্জিয়ার বিপক্ষে শেষ ২৫ মিনিট বাদ দিলে পর্তুগালের হয়ে প্রতিটি মিনিট মাঠে ছিলেন রোনালদো। কিন্তু বিপরীত পরিসংখ্যান হতাশা জাগানো। রোনালদো এই টুর্নামেন্টে ২৩টি শট নিয়েও কোনো গোলের দেখা পাননি। ১৯৮০ সালে গ্রুপ পর্ব চালুর পর যা কোনো খেলোয়াড়ের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শটে গোলহীন থাকার ঘটনা। কোনো গোল না করা রোনালদোর প্রত্যাশিত গোল (এক্সপেক্টেড গোল) ৩.৫১, যা ১৯৮০ সাল থেকে পুরুষদের কোনো প্রধান টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ।

রোনালদো ও মার্তিনেজ

কিন্তু রোনালদো যখন এমন হতাশাজনক পারফরম্যান্স দেখিয়ে যাচ্ছিলেন, তাঁকে নিয়ে আলাদা করে ভাবেননি মার্তিনেজ। হয়তো এর আগে পর্যন্ত খেলা ৫টি ইউরো ও ৫টি বিশ্বকাপে গোল করার দৃষ্টান্তকেই সামনে রেখেছিলেন এই কোচ। ভেবেছিলেন, দলের প্রয়োজনে হয়তো ঠিকই জ্বলে উঠবেন পর্তুগিজ মায়েস্ত্রো। কিন্তু নক্ষত্রেরও তো পতন হয়। সাঁঝবেলায় নদীতীরে খেলতে থাকা শিশুটিকেও খেলনা–বাটি গুটিয়ে নিয়ে বাড়িতে ফিরতে হয়। সেই বাস্তবতা না বুঝলেন রোনালদো, না মার্তিনেজ।

ফ্রান্সের বিপক্ষে গতকালকের ম্যাচটার কথাই ধরা যাক। ১২০ মিনিট মাঠে থেকে শট নিয়েছেন মাত্র ৩টি। বল স্পর্শ করেছেন মাত্র ৪০ বার। কোনো সুযোগ তৈরি করতে না পারলেও মিস করেছেন দারুণ একটি সুযোগ। পর্তুগালের আক্রমণভাগে গতি সঞ্চার করতে পারেননি রোনালদো, পারেননি ফ্রান্সের অ্যাটাকিং থার্ডে কোনো হুমকি তৈরি করতেও। অথচ রোনালদো যখন মাঠে সংগ্রাম করছিলেন, তখন দিয়েগো জোতা কিংবা গনসালো রামোসরা বেঞ্চ গরম করেই কাটিয়ে দিলেন।

বিশেষ করে জোতার কথা আলাদা করেই বলতে হয়। ফিট জোতা যেকোনো সময় দলের ভাগ্য বদলে দিতে পারেন। দলের প্রয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে বের করে আনতে পারেন গোলও। অথচ কোয়ার্টার ফাইনালে এক মিনিটও খেলার সুযোগ পাননি এই লিভারপুল তারকা। আর গনসালো রামোস বিশ্বকাপের শেষ ষোলোয় রোনালদোর জায়গায় সুযোগ পেয়ে সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করেছিলেন।

তাই ইউরোতে রোনালদোর সময়–ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলাদা করে পরিকল্পনা করা উচিত ছিল মার্তিনেজের। তাঁকে বাদ দিয়ে নয়, বরং কীভাবে খেলালে রোনালদোর সেরাটুকু বের করে আনা যাবে, সেটা নিয়েই ভাবা উচিত ছিল কোচের। হ্যাঁ, রাফায়েল লেয়াও, ব্রুনো ফার্নান্দেজদের দিয়ে একটা কাঠামো তৈরি করেই রোনালদোকে খেলিয়েছেন মার্তিনেজ, যা বাছাইপর্বে কাজেও দিয়েছিল। কিন্তু এই পরিকল্পনা কাজে না লাগলে কী করতে হবে, সেই ‘প্ল্যান বি’ ছিল না কোচের, যার মূল্য পর্তুগালকে দিতে হয়েছে বিদায় নিয়ে।

তবে এককভাবে রোনালদোকেও দোষ দেওয়ার সুযোগ নেই। সেমিফাইনালে পর্তুগালের তরি না ভেড়ার অনেকগুলো কারণের একটি মূলত রোনালদোর ব্যর্থতা বা তাঁকে ঠিকঠাক ব্যবহার করতে না পারা। নয়তো জোয়াও ফেলিক্স যদি পেনাল্টি মিস না করতেন কিংবা রাফায়েল লেয়াও, ব্রুনো ফার্নান্দেজ এবং ভিতিনিয়ারা যদি সামনে আসা সুযোগগুলো কাজে লাগাতেন, তবে ফ্রান্সকে বিদায় করে পর্তুগাল ঠিকই ফাইনালে যেতে পারত। তবে যেহেতু নামটা রোনালদো, ব্যর্থতার দায়টা তাঁকে যে একটু বেশিই নিতে হবে।