২০১৫ সাল—লিভারপুলের শিরোপা ক্যাবিনেটে তখন ধুলার আস্তরণ। লিগ শিরোপা জেতার বয়স পেরিয়ে গেছে ২৫ বছর, চ্যাম্পিয়নস লিগ ১০ বছর। এমনকি এফএ কাপের না জেতার বয়সও তখন ৯। সাম্প্রতিক অতীতে জয় বলতে শুধুই ২০১১-১২ মৌসুমের লিগ কাপ। এর মাঝে কত কোচ এল গেল লিভারপুলের ক্যাবিনেট থেকে ধুলার আস্তরণটা কেউ আর সরাতে পারলেন না। অদৃশ্য এক অভিশাপই যেন বয়ে বেড়াচ্ছিল ক্লাবটি।
শাপ তাড়াতে লিভারপুল শরণাপন্ন হলো ইয়ুর্গেন ক্লপ নামের এক জার্মানের। বুন্দেসলিগায় ক্লপ তত দিনে বিপ্লবী এক নাম। মেইঞ্জ থেকে বরুসিয়া ডর্টমুন্ডে এসে তিনি যেন ফুটবলের দর্শনটাই যেন বদলে দিলেন। ‘হেভিমেটাল ফুটবল’র গগনবিদীর্ণ করা চিৎকারে ফুটবলপাড়ায় প্রতিপক্ষ শিবিরের জন্য ক্লপ রীতিমতো মূর্তিমান এক আতঙ্ক।
অ্যানফিল্ডের ভূত তাড়ানোর কাজটা পড়ল তাঁর কাঁধেই। আর আজ ক্লপের ১০০০তম ম্যাচের মাইলফলক স্পর্শ করার দিন। চেলসির বিপক্ষে ডাগআউটে দাঁড়ালেই নতুন এই উচ্চতা স্পর্শ করবেন এই কোচ।
লিভারপুলে ক্লপ নিজের কাজটা কতটা নিপুণভাবে করেছেন, সে প্রমাণ তো লিভারপুলের ট্রফি ক্যাবিনেটের দিকে তাকালেই পাওয়া যাবে। এই সময়ের মধ্যে সম্ভাব্য সবগুলো ট্রফিই লিভারপুলকে জিতিয়েছেন। ৩০ বছর পর লিভারপুল উদ্ধার করেছে লিগ শিরোপা।
তিনবার চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল খেলে জিতেছেন একবার। এ ছাড়া এফএ কাপ, লিগ কাপ, কমিউনিটি শিল্ড, উয়েফা সুপার কাপ এবং ক্লাব বিশ্বকাপও জিতেছে ‘অল রেড’রা। দায়িত্ব নেওয়ার ৭ বছরের মধ্যে শিরোপা জয়ের বৃত্ত পূরণ করেছেন ৫৫ বছর বয়সী এই জার্মান।
৩৩ বছর বয়সে যখন পায়ে ফুটবল থাকার কথা, তখনই পেশাদার কোচ হিসেবে ডাগআউটে দাঁড়ানো শুরু করেন ক্লপ। ২০০১ সালে পেশাদার ফুটবলারের জীবনকে বিদায় জানান ক্লপ। কদিন আগেও যে ক্লাবটির হয়ে খেলেছেন, সে ক্লাবটির কোচ হিসেবে শুরু করেন নতুন যাত্রা। সেখান থেকেই শুরু হয় ফুটবলকে বদলে দেওয়া এক দার্শনিকের যাত্রারও। যদিও ফুটবলীয় এই দার্শনিক ভাবনার জনক কিন্তু ক্লপ ছিলেন না। তিনি মূলত ‘গড ফাদার অব গেগেনপ্রেসিং’খ্যাত রালফ রাংনিকের ফুটবলীয় দর্শনের সঙ্গে নিজের ভাবনটাকে জুড়ে দেন, যা কিনা প্রায় দুই দশক ধরে ফুটবলের অন্যতম এক আবিষ্কার হয়ে আছে।
যদিও মেইঞ্জে নিজের পরীক্ষা-নীরিক্ষাগুলো সেভাবে করার সুযোগটা পাননি ক্লপ। তাঁর আসল জাদু দেখা যায় ডর্টমুন্ডের কোচ হওয়ার পর। স্বল্প বাজেট ও তরুণ প্রতিভাদের খুঁজে নিয়ে এসে ‘গেগেগনপ্রেসিং’য়ের পসরা সাজিয়ে বসেন ক্লপ।
প্রেসিংয়ের চাপে প্রতিপক্ষ পিষ্ট করে ফুটবলে তিনি নতুন গতিই শুধু আনেননি, তাঁর এই দর্শন একই সঙ্গে ফলদায়ীও ছিল। ডর্টমুন্ডের হয়ে পরপর দুই মৌসুমে শিরোপা জয় এবং চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনাল খেলা সেই প্রমাণই দেয়। ক্লপের ফুটবল দর্শন চূড়ান্ত উৎকর্ষ লাভ করে লিভারপুলে। ধুঁকতে থাকা দলটিকে খাদের কিনারা থেকে টেনে তোলেন এই জার্মান কোচ।
অ্যানফিল্ডেও তিনি খুঁজে নিয়ে আসেন একঝাঁক তরুণ প্রতিভা। মোহম্মদ সালাহ, সাদিও মানে, ভার্জিল ফন ডাইকদের মতো তারকাদের নিজ হাতে তৈরি করেছেন ক্লপ। ২০১৫ সালের পর থেকে ক্লপের হাত ধরে এই ফুটবলাররা দাপুটে লিভারপুলকে দাপুটে সময় উপহার দেন।
ক্লপের সময়ে ম্যানচেস্টার সিটি, চেলসির মতো বড় বাজেটের দলের সঙ্গে লড়ে লিভারপুল পেয়েছে দারুণ সব সাফল্যও। এর মাঝে মানে, উইনালদাম, অরিগির মতো তারকার যেমন দল ছেড়ে গেছেন, তেমনি এসেছেন দিয়েগো জোতা, লুইস দিয়াজ, দারউইন নুনিয়েজের মতো তরুণেরা। যাঁদের দিয়েই সাফল্যের যাত্রাটা ধরে রাখতে চান ক্লপ।
তবে হ্যাঁ, বাস্তবতা হচ্ছে এ মৌসুমে ক্লপের জাদুর ছড়ি যেন শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। মিডফিল্ড দুর্বলতা, অপরিকল্পিত দলবদল এবং চোট সমস্যা লিভারপুলকে কোণঠাসা করে ফেলেছে। তবে ক্লপ তো জানেনই কীভাবে ঘুরে দাঁড়াতে হয়। যার শুরুটা হতে পারে আজ, চেলসির বিপক্ষে নিজের হাজারতম ম্যাচ দিয়েই।
সংখ্যায় ক্লপের ১০০০
১০০০
৯৯৯ ম্যাচে ডাগআউটে দাঁড়িয়ে ক্লপ জিতেছে ৫৩৮ ম্যাচে, ড্র করেছেন ২৩৯ ম্যাচ এবং হেরেছেন ২২২ ম্যাচ। তাঁর দল গোল করেছে ১৮১৮টি এবং হজম করেছে ১০৮১টি।
৪১০
৪১০ ম্যাচে লিভারপুলের ডাগআউটে দাঁড়িয়েছন ক্লপ।
৩৪১
ক্লপের অধীনে সবচেয়ে বেশি ৩৪১টি ম্যাচ খেলেছেন লিভারপুলের ব্রাজিলিয়ান ফরোয়ার্ড রবার্তো ফিরমিনো।
১৭৩
ক্লপের অধীনে ২৮২ ম্যাচে সর্বোচ্চ ১৭৩টি গোল করেছেন মোহাম্মদ সালাহ।
৯৭
২০১৮-১৯ মৌসুমে ৯৭ পয়েন্ট নিয়েও শেষ পর্যন্ত লিগ জিততে পারেনি ক্লপের লিভারপুল। সেবার লিগ জেতে ম্যানচেস্টার সিটি।
২৭
পেপ গার্দিওলার সঙ্গে ক্লপের আইকনিক দ্বৈরথের শুরুটা হয় ২০১৩ সাল থেকে। ডাগআউটে দাঁড়িয়ে দুজন একে অপরের বিপক্ষে লড়েছেন ২৭ ম্যাচে। যেখানে ১১টি জয়ের বিপরীতে আছে ৯টি হার ও ৭টি ড্র।
১৬
কোচ হিসেবে ক্লপ সবচেয়ে বেশি হেরেছেন বায়ার্ন মিউনিখের কাছে।