সাক্ষাৎকারে মেসি

‘স্কুলে ভালো বাচ্চাই ছিলাম, তবে অলস’

তাঁকে বলা হয় ‘ফুটবলের দার্শনিক’। আর্জেন্টিনার সর্বশেষ যে বার বিশ্বকাপ জিতেছিল, সেই ফাইনালে তিনি গোল করেছিলেন। সেই হোর্হে ভালদানোর মুখোমুখি এবার লিওনেল মেসি। ভালদানোর টেলিভিশন শো ‘ইউনিভার্সো ভালদানো’তে বিশ্বকাপ সামনে রেখে মেসি কথা বলেছেন দীর্ঘ সময়। আলোচনা অবশ্য শুধু বিশ্বকাপকেন্দ্রিক ছিল না, উঠে এসেছে মেসির পুরো ক্যারিয়ারের গল্পই—

মা–বাবা চেয়েছিলেন মেয়ে

আমার মেয়ে হওয়ার ব্যাপারে বাবা তো প্রায় নিশ্চিতই ছিলেন। বাবা-মা নামও ঠিক করে রেখেছিলেন সেভাবেই। প্রিমেরা ডিভিশনে চার বা পাঁচ বছর বয়সে যাওয়ার সময়ও আমার ফুটবল একই রকম ছিল। আমার যা আছে, ঈশ্বরই দিয়েছেন। সেটিকেই আরও ভালো ও শক্তিশালী করেছি। স্কুলে ভালো বাচ্চাই ছিলাম, তবে নিশ্চিতভাবেই অলস। ফুটবল খেলতে না দিয়ে তাঁরা আমাকে শাস্তি দিতেন। ব্যক্তিগতভাবে বার্সেলোনায় আসাটা অবশ্য বড় একটা পরিবর্তন ছিল।

বার্সেলোনায় নিঃসঙ্গ

ট্রায়ালের জন্য বার্সেলোনায় ১৫ দিন ছিলাম, শেষ দিনে সিনিয়র একটা দলের সঙ্গে খেলেছিলাম। বার্সেলোনায় সবকিছুই চমৎকার লাগত। জার্সি, বুট, মাঠ—সব পেয়েছিলাম। তবে বছরটা কঠিন ছিল। ছয় মাস খেলা ছাড়াই ছিলাম, ফিরে আবার চোটে পড়লাম। আমার ভাই আর্জেন্টিনা চলে গেল। ছোট বোনের বয়স তখন ছয়-সাত, সে মানিয়ে নিতে পারেনি। আমার পরিবার বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। বাবা আর্জেন্টিনা ফিরে যেতে বলেছিলেন, তবে আমি বার্সেলোনায় মানিয়ে নেওয়ার কঠিন কাজটা তত দিনে করে ফেলেছি। পরিবার আমার কারণে আলাদা হয়ে গেছে, এমন মনে হতো। তবে ফুটবল খেলা ছাড়া কিছু ভাবতে পারতাম না।

রোনালদিনিও-পুয়োলদের সঙ্গে

গ্যাম্পার ট্রফির আগে চীন বা জাপানে প্রাক্‌–মৌসুমে গিয়েছিলাম। সে সময় মার্কেজ, রোনালদিনিও, ইতো ছিল দলে। তবে জুভেন্টাসের সঙ্গে গ্যাম্পার ট্রফির ওই ম্যাচের পর আমাকে নিয়ে ক্লাবের ধারণা বদলে গেল। রোনালদিনিও, ডেকো, মোতা, সিলভিনিও, জাভি, পুয়োল—সবাই শুরু থেকেই আমাকে দারুণভাবে গ্রহণ করেছিল। এমন একটা ড্রেসিংরুমে ঢোকা সহজ হওয়ার কথা ছিল না, কিন্তু তারা খুব স্বাভাবিকভাবে নিয়েছিল আমাকে।

আমার যা আছে, ঈশ্বরই দিয়েছেন। সেটিকেই আরও ভালো ও শক্তিশালী করেছি।
লিওনেল মেসি

আর্জেন্টিনাকেও ভুলিনি

বাবাকে বলেছিলাম, আর্জেন্টিনার জন্য এমন কিছু করতে হবে যাতে লোকে জানে আমি আছি। জাতীয় যুব দলের হয়ে দুটি প্রীতি ম্যাচ খেলেছিলাম। অনূর্ধ্ব-২০ জিতেছিলাম। জাতীয় দলে সব সময়ই মানুষের ভালোবাসা টের পেয়েছি। তবে একটা অংশ সব সময়ই আমার সমালোচনা করেছে। আমার সবকিছু নিয়েই তাদের ভিন্নমত ছিল।

কাতার বিশ্বকাপকে সামনে রেখে আবুধাবিতে অনুশীলন করছে আর্জেন্টিনা। সেখানেই লিওনেল মেসিকে দেখা গেল এভাবে।

গার্দিওয়ালা ‘ক্ষতিকর’

বার্সেলোনায় গার্দিওয়ালার সময়টা অসাধারণ ছিল। যার বিপক্ষে যেখানেই খেলা হোক না কেন, জানতাম, আমরাই জিতব। মাঝেমধে৵ ওই সময়টা আরও উপভোগ করতে না পেরে আক্ষেপ হয়। সবকিছু এত সহজেই হয়ে যেত, আমরা বুঝতামই না কী করছি। সময় গড়ানোর সঙ্গে বুঝি, সেটি অনন্য কিছু ছিল। গার্দিওয়ালা আসলে ফুটবলের ক্ষতি করেছে। কত সহজ মনে হতো সব, সবাই তাকে অনুকরণ করতে চাইত। সে নিঃসন্দেহে সেরা কোচ। তার বিশেষ কিছু আছে—যেভাবে খেলাটি দেখে, প্রস্তুত করে দলকে এবং তাদের সঙ্গে কথা বলে।

হোর্হে ভালদানোর টেলিভিশন শো ‘ইউনিভার্সো ভালদানো’তে বিশ্বকাপ সামনে রেখে মেসি কথা বলেছেন দীর্ঘ সময়

এনরিকেও গার্দিওয়ালার মতোই

গার্দিওয়ালার বিশেষ কিছু ছিল। খেলা বোঝা ও প্রস্তুতির দিক দিয়ে লুইস এনরিকেও একই। সে গ্যাপ বের করে প্রতিপক্ষকে আঘাত করে। তার দর্শনও একই। জাতীয় দলটা এখন তার, সহজেই বোঝা যায়। আমি জানি, তার সঙ্গে কাজ করতে কেমন লাগে। সে এই জাতীয় দলটাই চায়।

নিজেকে সামলাতে পারি না

একবার আর্জেন্টিনায় ছুটি কাটিয়ে ফেরার পর জানুয়ারির শুরুতে বেঞ্চে বসে ছিলাম। একটু কথা কাটাকাটিও হয়েছিল (এনরিকের সঙ্গে)। আমি এমনই, প্রতিক্রিয়া দেখাই, কিছুই সামলাতে পারি না। তবে সেকেন্ডের ভগ্নাংশ পরই আরেকটু না ভেবে প্রতিক্রিয়া দেখানো নিয়ে আক্ষেপ হয়। আমি কখনো ভান করিনি। যা ভেবেছি, ভাবি, তাই বলেছি। হাজারবার ভুল করেছি, তবে এটিই করতে থাকব। শেষ দিন পর্যন্ত এনরিকের সঙ্গে আমার দুর্দান্ত সম্পর্ক ছিল, আমার ক্যারিয়ারে গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ সে।

ভেতরের মেসি

মেসি হওয়ার খারাপ দিকও আছে। সবার অগোচরে অনেক কিছু করতে পছন্দ করি। পরিবার ও বাচ্চাদের সঙ্গে থাকাটা আমাকে (বাইরের জীবন থেকে) মুক্তি দেয়। সাত-আট বছর বয়স থেকে আমার স্ত্রীকে জানি আমি। পরিবার ও স্ত্রীর কাছ থেকে পরামর্শ নিই, তারা দরকার পড়লে আমাকে বলে কোন ব্যাপারটি কী। পরিবার বা বন্ধুদের সঙ্গে আমি মেসি নই, আরেকজন মানুষ। জীবন উপভোগ করার ভিন্ন একটা পদ্ধতি শিখেছি আমি। বয়স হচ্ছে, সময় বয়ে যাচ্ছে। এখন আমি সবকিছুই অনেক বেশি উপভোগ করি, প্রতিদিনের জীবন থেকে জাতীয় দল পর্যন্ত।

আর্জেন্টিনা দল কেমন

ব্রাজিলে কোপা আমেরিকা জেতার সময় থেকেই আমাদের দলটা দারুণ। লিওনেল স্কালোনির ব্যক্তি হিসেবে বিশেষ কিছু। সে দারুণ এক জন কোচ। খেলোয়াড়দের ওপর আস্থা রাখে, যেটি গুরুত্বপূর্ণ। লোকে কী বলল, তাতে কিছু যায় আসে না তার। আর এখন লোকে শুধু হারজিতকেই মূল্য দেয় না। এটাও গুরুত্বপূর্ণ।

কারা ফেবারিট

প্রতিটি জাতীয় দলই কঠিন। ইউরোপিয়ান দলগুলোর বিপক্ষে খুব বেশি খেলিওনি। আপনাকে ম্যাচ ধরে ধরে এগোতে হবে, বাস্তববাদী হতে হবে। চোট থাকার পরও ফ্রান্সের ভালো সম্ভাবনা আছে। তাদের অনেক ভালো খেলোয়াড় আছে, তাদের ম্যানেজারও দলের সঙ্গে দীর্ঘদিন আছে। ব্রাজিলের অনেক মানসম্মত ও বিপজ্জনক খেলোয়াড় আছে। তাদের নেইমার আছে। আমার মনে হয় আমাদের দলটিও ভালো। জিওর চোট দুর্ভাগ্য। তবে আমরা লড়াই করব। এটিই ভেবেই যাচ্ছি।