নাপোলিকে এখনই সিরি ‘আ’র শিরোপাটা দিয়ে দেওয়া যায় না?
২৩ ম্যাচ শেষে শীর্ষে থাকা দলটি যখন দ্বিতীয় দলের চেয়ে ১৫ পয়েন্ট ব্যবধানে এগিয়ে থাকে, তখন এই প্রশ্ন তোলা মোটেও বাড়াবাড়ি হয় না। অতিনাটকীয় কিছু না ঘটলে এখান থেকে নাপোলির শিরোপা হাতছাড়া করা শুধু কঠিনই নয়, অসম্ভবও। কোন শক্তিতে এভাবে জেগে উঠল নাপোলি?
ডিয়েগো ম্যারাডোনা নয়তো! উত্তরটা একটু হাস্যকর মনে হতে পারে। কিংবদন্তি ম্যারাডোনার মৃত্যুর দুই বছর পেরিয়ে গেছে। এখন তিনি কীভাবে কোনো দলকে শক্তি জোগাতে পারেন? তবে সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা কিন্তু তেমন ইঙ্গিত দিচ্ছে—যেখানে একবিন্দুতে এসে মিলছে আর্জেন্টিনা, ম্যারাডোনা ও নাপোলি। সেটা কেমন?
উত্তর পেতে ফিরে যেতে হবে সেই ১৯৮০–এর দশকে। ১৯৮৪ সালে সবাইকে চমকে দিয়ে বার্সেলোনা ছেড়ে নাপোলিতে যান ম্যারাডোনা। সন্ত্রাসী ও মাফিয়াদের আস্তানা হিসেবে পরিচিত ইতালির দক্ষিণ অঞ্চলের শহরটিতে কেউ ঘুরতে যাওয়ার সাহসও পেত না। ফুটবলেও তাদের কোনো সাফল্যও ছিল না।
নাপোলিতে যাওয়ার কারণ হিসেবে ম্যারাডোনা বলেছিলেন, ‘আমি নেপলসের শিশুদের আদর্শ হতে চাই। কারণ তারাও আমার মতো।’ ম্যারাডোনা যেমন নোংরা এবং অবহেলিত নাপোলিকেও জাগিয়ে তুলেছিলেন, তেমনি ম্যারাডোনা নিজেও কি পিছিয়ে পড়া এই ইতালিয়ান শহর থেকে প্রেরণা নেননি!
নেপলসে আসার দুই বছর পর মেক্সিকোতে ’৮৬ বিশ্বকাপে একক কৃতিত্বে আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ এনে দেন জাদুকর ম্যারাডোনা। শুধু কি বিশ্বকাপ জয়, একের পর এক স্মরণীয় ঘটনার জন্ম দিয়ে আসরটাকেই যেন চিরকালীন অমরত্ব দিয়ে গেছেন ‘কিং ডিয়েগো’। বিশ্বকাপ জয়ের পর ম্যারাডোনা তখন মহানায়ক। ফুটবল–দুনিয়াও তখন মজে ছিল ম্যারাডোনা–রূপকথায়।
জাতীয় দলের বিশ্বকাপ জেতার বছরই নাপোলিকে এনে দিয়েছিলেন তাদের ইতিহাসের প্রথম লিগ শিরোপা। পরেরটা জিতলেন ১৯৮৯–৯০ সালে। এর মাঝে ১৯৮৮–৮৯ সালে নাপোলিকে এনে দেন উয়েফা কাপের শিরোপা। আর্জেন্টিনা ও নাপোলির হয়ে ম্যারাডোনার গল্পের নটে গাছটি এখানেই মুড়োল।
ধান ভানতে ওপরে যে শিবের গীত গাওয়া হলো, সেখান থেকে নিশ্চয় এই লেখার মূল উদ্দেশ্যটা খুঁজে পাওয়া যাবে। ১৯৮৬ থেকে ২০২২ এবং ১৯৮৬–২০২৩—ম্যারাডোনার হাত ধরে শিরোপা ঘরে তোলার পর আরেকটি বিশ্বকাপ এবং লিগ শিরোপার জন্য আর্জেন্টিনা–নাপোলির অপেক্ষাটা ছিল এতটাই দীর্ঘ।
গত ১৮ ডিসেম্বরের আগপর্যন্ত তাই একই সমতলে ছিল এই দুই দল। অপেক্ষার পালা শুধু দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে, কাঙ্ক্ষিত শিরোপাটি আর ধরা দেয়নি। এই দুই দলকে শিরোপা জিততে দেখার অপেক্ষায় থাকা ম্যারাডোনাও পৃথিবী থেকে বিদায় নেন দুই বছর আগে। কে জানে বেঁচে থাকতে ম্যারাডোনার যে স্বপ্ন পূরণ হয়নি অন্য লোকে গিয়ে সেটি পূরণে কোনো কলকাঠি নাড়ছেন কি না!
কদিন আগে নিজেদের দাপুটে পারফরম্যান্সের পেছনে ম্যারাডোনার প্রভাবের কথা বলেছেন নাপোলির কোচ লুসিয়ানো স্পালেত্তিও। তিনি বলেছেন, ‘সে আমাদের সঙ্গে আছে। লকার রুমে ম্যারাডোনার ভাস্কর্য আছে, অনেকেই সেটি স্পর্শ করতে যায়। মাঠের নামার সময় আমিও স্পর্শ করে নামি। আমরা তার (খেলার) মানটাকে ক্লাবে দেখতে চাই। সে এমন একজন ছিল, যে তার যোগ্যতা দিয়ে জিতেছে। আমরা যতটা সম্ভব সেই পথটাই অনুকরণ করার চেষ্টা করছি। তার কাছ থেকে পাওয়া শিক্ষাকে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি।’
নাপোলির বদলে যাওয়ার আভাস অবশ্য কয়েক মৌসুম ধরেই পাওয়া যাচ্ছিল। মূলত স্পালেত্তি নামের এক জাদুকরের হাত ধরে বদলে গেছে নাপোলি। ২০২১ সালে দায়িত্ব নেওয়ার পর দলটির খোলনলচে বদলে দিয়েছেন এই ফুটবল–মস্তিষ্ক। শুধু এটুকুই নয়, ম্যারাডোনা–শক্তিতে দলকে উজ্জীবিত করতে নতুন ম্যারাডোনাও দলে নিয়ে এসেছেন স্পালেত্তি।
নাপোলির এই নতুন ম্যারাডোনার নাম খিচা কাভারাস্কেইয়া। জর্জিয়ান এই ফুটবল তারকাকে এখন সবাই চেনে ‘ক্যাভারাডোনা’ নামে। চলতি মৌসুমে দুর্দান্ত ফুটবল শৈলী দেখানোর সঙ্গে করেছেন ১২ গোল ও ১৪ অ্যাসিস্ট। অন্যদের মধ্যে পিওতর ইয়েলনেস্কি কিংবা ভিক্তর ওসিমেনদের মতো তারকাদের মধ্য দিয়ে নতুন করে স্বপ্ন দেখছে নাপোলির অধিবাসীরা। যেখানে ৩৩ বছর পর আবার শিরোপাস্বপ্নটা এখন সময়ের ব্যাপারই বলা যায়।
নাপোলির বদলে যাওয়ার আভাসটা আগের মৌসুমগুলোতেই পাওয়া গিয়েছিল। সেবার অবশ্য দুই মিলানের চেয়ে পিছিয়ে থেকে তৃতীয় হয়ে লিগ শেষ করতে হয়েছিল নাপোলিকে। এবার শুরু থেকেই দাপট ধরে রেখে এগিয়ে চলেছে নাপোলি। ২৩ ম্যাচ শেষে ২০ জয়, ২ ড্র ও ১ হারে তাদের পয়েন্ট ৬২। তালিকার দ্বিতীয় স্থানে থাকা ইন্টার মিলানের চেয়ে ১৫ পয়েন্টে এগিয়ে আছে স্পালেত্তির দল। সর্বশেষ পরশু রাতে সাসুলোকে তাদের মাঠে নাপোলি হারিয়েছে ২–০ গোলের ব্যবধানে।
এখন স্পালেত্তির লক্ষ্য নিজেদের ছন্দটা ধরে রেখে শুধুই এগিয়ে যাওয়ার। গতকালের ম্যাচ শেষে নাপোলি কোচ বলেছেন, ‘এ মুহূর্তে আমরা যা করতে পারি তা হলো, ভালো কাজটাকে ধরে রেখে এগিয়ে যাওয়া।’ হ্যাঁ, এই ছন্দে ধরে এগিয়ে যেতে পারলে শুধু লিগ শিরোপায় নয়, মৌসুম শেষে আরও অনেক অর্জন লুটোপুটি খাবে নাপোলির পায়ে।