মিরপুরের আহমদনগরের পাইকপাড়ায় ৩৬৮/১ নম্বর বাড়িটিতে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। এই বাড়ির প্রবীণ বাসিন্দার চিরবিদায়ে সবকিছুতেই বিষাদের ছায়া। যেন তাঁর জন্য কাঁদছে বাড়িটির ইটের দেয়াল থেকে শুরু করে টেবিল-চেয়ারও! কিন্তু তিনি এসবের ঊর্ধ্বে এখন। আজ সকাল সাতটায় না ফেরার দেশে চলে গেছেন পঞ্চাশের দশকের নামী ফুটবলার জহিরুল হক। বয়স হয়েছিল ৮৯ বছর।
বেলা তিনটার দিকে বাড়িটিতে গিয়ে দেখা যায়, বেদনাবিধুর এক পরিবেশ। স্ত্রী, চার ছেলে-মেয়ে শোকে পাথর। প্রতিবেশীরাও ব্যথিত প্রিয় মানুষটিকে হারিয়ে। বাড়ির উঠানে লাশবাহী গাড়ি। লোকজন মরদেহ দেখছেন। কিন্তু তাতে নেই ক্রীড়াঙ্গনের কেউ। যে মোহামেডান ক্লাবে টানা ১৬ বছর খেলে হয়েছেন ‘মোহামেডানের জহির’, নেই সেই ক্লাবেরও কেউ। ফুটবল-সতীর্থদের কাউকেই দেখা যায়নি তাঁর বাসভবনে। মনেই হয়নি তিনি এত বড় মাপের একজন ফুটবলার ছিলেন।
মোহামেডান ক্লাবে কেন নিলেন না মরদেহ? জহিরুল হকের চার সন্তানের একজন আজমল হক বললেন, ‘ফেসবুকে মোহামেডানের গ্রুপে নিউজটা দিয়েছিলাম। আসলে কেউ বলেনি ক্লাবে নিতে। উদ্যোগ নিলে নিশ্চয়ই নেওয়া যেত। সুস্থ থাকা পর্যন্ত তিনি প্রায়ই মোহামেডান ক্লাবে যেতেন। ক্লাবটাকে খুব ভালোবাসতেন।’
সন্ধ্যায় তাঁর দ্বিতীয় জানাজা হয় ফার্মগেটের মনিপুরিপাড়ার খেজুর বাগান মসজিদে, যে এলাকায় তিনি ৬০ বছর কাটিয়েছেন। সেখানে জানাজায় ছিলেন মোহামেডানের সাবেক চার ফুটবলার গোলাম সারোয়ার টিপু, শফিকুল ইসলাম মানিক, ইমতিয়াজ সুলতান জনি ও সৈয়দ রুম্মান বিন ওয়ালী সাব্বির। আর গেছেন মোহামেডানের একমাত্র পরিচালক আবু হাসান। কিন্তু মোহামেডান থেকে একটা ফুলের তোড়াও জোটেনি প্রয়াত জহিরুলের জন্য। বাফুফের মতো মোহামেডানও একটা শোকবার্তা দিয়ে দায় সেরেছে। কেন? আবু হাসান ব্যাখ্যা দেন এভাবে, ‘আগামীকাল নির্বাচন। সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত। তা ছাড়া কেউ উদ্যোগ নেয়নি ওনাকে সম্মান জানানোর।’
ফলে নীরব বিদায়ই হলো মোহামেডান কিংবদন্তির। তা নিয়ে অবশ্য আক্ষেপ নেই স্ত্রী সুরাইয়া হকের। স্বামীর জীবনের শেষ দিনগুলো নিয়ে স্মৃতিচারণা বলে যান, ‘গত ৩-৪ মাস হাঁটাচলা করতে পারেননি তিনি। স্মৃতিশক্তিও হারিয়ে ফেলেন অনেকটা। অনেক দিন পর দেখা আত্মীয় পরিচিতজনদের চিনতে পারতেন না। তিনি খুব শৃঙ্খলাপরায়ণ ছিলেন। খেলার জীবন নিয়ে অনেক গল্প করতেন। বলতেন, তাঁর খেলোয়াড়ি জীবন ছিল অনেক গ্ল্যামারাস।’
কাছ থেকে তা দেখেছেন সমকালীন খেলোয়াড়েরা। তাঁদেরই একজন প্রতাপ শংকর হাজরা, গ্রামের বাড়ি শ্রীনগর থেকে ফোনে ফিরে যান পেছনের দিনগুলোতে, ‘জহির ভাই মোহামেডানে আসেন ১৯৬০ সালে। আমার সঙ্গে তাঁর দেখা হয় ১৯৬৩ সালে। নিজের ছোট ভাই থাকলেও তাঁর কাছে এত প্রিয় হতো না, যতটা হয়েছি আমি। উনি অনুশীলনে সব সময় সিরিয়াস ছিলেন। অনুশীলন করলে সিরিয়াসলি করব, নইলে করব না—এই শিক্ষাটা ওনার কাছেই পেয়েছি আমি। দল ও সতীর্থদের জন্য তাঁর অনুভূতি ছিল অতুলনীয়। রাইট আউটে আমি বেশি দৌড়ালে বলতেন, “তুমি পেছনে থাকো।” উনি আমার দায়িত্ব পালন করতেন।’
জহিরুল হকের প্রয়াণে একটু বেশিই ব্যথিত গোলাম সারোয়ার টিপু। মোহামেডানে তাঁর শুরু যে জহিরুল হকের হাত ধরেই। ১৯৬৪ সালে ঢাকার ফুটবলে ক্যারিয়ার শুরু করা সাবেক এই ফুটবলার বলেন, ‘ষাটের দশকে আমি থাকতাম ফার্মগেটে। আর পাশেই মনিপুরিপাড়ায় থাকতেন জহির ভাই। মোহামেডানে তিনিই আমাকে নিয়ে যান। একদিন ভেসপা নিয়ে এসে বলেন, “টিপু, চল মোহামেডানে।” নবীনগরে তাঁর আর আমার বাড়ি এক মাইলের মধ্যে। নানাভাবে সহায়তা করেন আমাকে। বাংলাদেশের ফুটবলে তাঁর অবদান কখনো ভোলার নয়।’
মোহামেডানের জন্য একটু বেশিই অবদান রাখেন জহিরুল হক। ১৯৬০ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত সাদা-কালো শিবিরে কাটিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন মোহামেডানের ঘরের ছেলে, ঐতিহ্যবাহী ক্লাবটির কিংবদন্তি ফুটবলারদের একজন। মোহামেডানের অধিনায়ক ছিলেন অনেক বছর। তাঁকে ‘মোহামেডানের জহির ভাই’ বলেই বেশি ডাকতেন সমকালীন ফুটবলাররা। রাইটব্যাকে তাঁর মতো ফুটবলার কমই এসেছেন এই ভূখণ্ডে।
বশীর আহমেদ মোহামেডানে খেলেন ১৯৬৩ থেকে ’৬৭ পর্যন্ত। জহিরুল হকের সঙ্গে খেলার স্মৃতি তাঁরও অনেক। সেসব নিয়ে বলেন, ‘খেলোয়াড় হিসেবে জহির ভাই মাঠে কোনো ছাড় দিতেন না। ফরোয়ার্ডকে যেকোনো উপায়ে আটকাতে হবে, এই ছিল তাঁর মানসিকতা। মানুষ হিসেবে ছিলেন সহজ–সরল। ধর্মকর্ম করতেন। নিজের জীবনেই ব্যস্ত থাকতেন। অপ্রয়োজনে ঘোরাফেরা করতেন না।’
ছোট ছেলে রেজওয়ানুল হক জানিয়েছেন, হৃদ্যন্ত্রের সমস্যা নিয়ে ৪ জানুয়ারি জহিরুল হককে ইবনে সিনা হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানেই শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। ৫ জানুয়ারি ছিল তাঁর জন্মদিন। আর সেদিন রাত ১০টার দিকে কোমায় চলে যান। ১৯৩৫ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগরে জন্ম নেওয়া জহিরুল হক ১৯৫৪ সালে তেজগাঁও ফ্রেন্ডস ইউনিয়ন ক্লাব দিয়ে ঢাকার ফুটবলে যাত্রা করেন। ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত এই ক্লাবে খেলে পরের দুই বছর খেলেন সেন্ট্রাল প্রিন্টিং অ্যান্ড স্টেশনারিতে। পুলিশ দলে খেলেন ১৯৫৯ সালে।
পাকিস্তান জাতীয় দলে খেলেছেন। ১৯৬১ সালে ঢাকা ও চট্টগ্রামে বার্মার সঙ্গে দুটি ম্যাচ, ১৯৬২ সালে মারদেকা কাপ, জাকার্তা এশিয়ান গেমস, ১৯৬৪ সালে চীনের পিকিংয়ে (এখন বেইজিং) দেশটির স্বাধীনতা দিবস টুর্নামেন্টে তিনি ছিলেন পাকিস্তান দলে পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র খেলোয়াড়। ’৬৫ সালে রাশিয়ার বাকু ওয়েল মিল দলের বিপক্ষে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও করাচিতে খেলেছেন। পূর্ব পাকিস্তান দলে খেলেন ১৯৫৭ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত। ’৬০ সালে ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান দলের অধিনায়ক। পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস ফুটবলের ১৩টি ফাইনাল খেলা ফুটবলার তিনি। চারবার আগা খান গোল্ডকাপে ফাইনাল খেলেছেন। মোহামেডানের হয়ে দুবার তাতে চ্যাম্পিয়ন।
১৯৬৪ সালে ক্রীড়া লেখক সমিতির বর্ষসেরা ফুটবলারের পুরস্কার পেয়েছেন। ২০০১ সালে পেয়েছেন জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার। প্রথম আলো ক্রীড়া পুরস্কারে ২০১২ সালে পান আজীবন সম্মাননা। ২২টি ব্লেজার পেয়েছেন দীর্ঘ জীবনে, যেগুলো খুব গর্ব নিয়ে দেখাতেন বাসায় আগত অতিথিদের। সবই এখন স্মৃতি।
আজই সন্ধ্যার পর বনানী কবরস্থানে মরদেহ নেওয়া হয়েছে, বাবা নুরুল হকের কবরে শেষ শয্যা নিয়েছেন নামী এই ফুটবলার।