ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে আর্লিং হলান্ডের মধুচন্দ্রিমা কি তবে শেষ হলো? সঠিক উত্তরটা পেতে হয়তো আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। তবে সুদিন যে হলান্ডের কাছ থেকে আপাতত কিছুটা হলেও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, তা বলাই যায়। ম্যানচেস্টার সিটির জার্সিতে নরওয়েজিয়ান এই স্ট্রাইকারের যাত্রাটা ছিল অবিশ্বাস্য।
গোলের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য এক বন্ধন গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর পায়ে বল মানেই সেটির গন্তব্য প্রতিপক্ষের জাল। সিটির জার্সিতে প্রথম মাসের মধ্যে একাধিক রেকর্ড ভেঙে তছনছ করে দেন এই নরওয়েজীয় তারকা।
সময় যতই গড়াচ্ছিল তাঁর সামনে সব রেকর্ডকে মনে হচ্ছিল সমুদ্রতীরে বসে বানানো বালুর ঘর। হলান্ডের একটা টোকাতেই যেন সব হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ছিল। সেই হলান্ডকেই এখন অচেনা লাগছে। প্রথম ১৯ ম্যাচে ২৫ গোল করেছিলেন, সর্বশেষ চার ম্যাচে করেছেন মাত্র ১ গোল। এমন গোলপ্রসবা শুরুর পর গোলখরায় ভোগা তো আলোচনায় আসছেই, তার চেয়েও বেশি হলান্ড ও সিটির খেলার ধরন এবং তাঁকে নিয়ে প্রতিপক্ষের কৌশল।
সর্বশেষ গতকালের নটিংহাম ফরেস্ট ম্যাচের কথাই ধরা যাক। এই ম্যাচ জিতলে শীর্ষস্থানটা ধরে রাখার সুযোগ থাকত সিটির। গত সেপ্টেম্বরে প্রথম লেগের ম্যাচে প্রথমার্ধেই হ্যাটট্রিক করে বসেছিলেন হলান্ড। তাঁর হ্যাটট্রিকে সেদিন নটিংহামকে ৬–০ গোলে উড়িয়ে দিয়েছিল সিটি।
গতকাল সেই একই প্রতিপক্ষের বিপক্ষে হলান্ডকে হাঁসফাঁস করতে দেখা গেল। এমনকি নিশ্চিত গোলের সুযোগও নষ্ট করেছেন এই স্ট্রাইকার। প্রশ্ন হচ্ছে, চলতি মৌসুমে প্রতি ৬৮ মিনিটে একটি করে গোল করা হলান্ডের পায়ে এমন মরচে ধরার কারণ কী
বাস্তবতা হচ্ছে, এমন সময় হলান্ডের সামনে আসতই। আধুনিক ফুটবলে রহস্য গোপন রেখে একজন ফুটবলারের দিনের পর দিন একই রকমভাবে খেলে যাওয়া কঠিন। এ ক্ষেত্রে কেউ চাইলে অবশ্য লিওনেল মেসি ও ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর কথা বলতে পারেন, যারা লম্বা সময় ধরে নিজেদের পারফরম্যান্স ধরে রেখেছিলেন। এ দুজন ব্যতিক্রম।
আর সৃষ্টিশীলতার দিক থেকেও তাঁরা হলান্ডের চেয়ে অনেক এগিয়ে। মাঠের বিভিন্ন পজিশনে নিজেদের মানিয়ে নিতে অভ্যস্ত তাঁরা। যখনই খারাপ সময় এসেছে, নানা কৌশলে নিজেদের সেই পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছেন, যা নির্ভেজাল একজন স্ট্রাইকারের জন্য বেশ কঠিন।
হলান্ড মূলত খেলেন পেনাল্টি–বক্স স্ট্রাইকার হিসেবে। বক্সের ভেতর বল পায়ে তাঁর চেয়ে বড় হুমকি এ মুহূর্তে ইউরোপীয় ফুটবলে আর কেউ নেই। পরিসংখ্যান অন্তত সেটাই বলছে। প্রিমিয়ার লিগের মাঝ মৌসুমেই লিগের রেকর্ড গোলসংখ্যাকে চোখরাঙানি দেওয়া নিশ্চয় সহজ কথা নয়। কিন্তু নিজের এই গুণ যে হলান্ডের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হতে পারে, সে আশঙ্কা অনেক আগে থেকে করা হচ্ছিল। এখন সম্ভবত সেই ফাঁদে পড়েছেন হলান্ড।
হলান্ড আসার আগে গার্দিওলার সিটি স্ট্রাইকার–নির্ভর হয়ে খেলার বদলে ফলস নাইন খেলাতে বেশি পছন্দ করত। ধারণা করা হচ্ছিল, হলান্ডও সেই ধারার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেবেন। তবে এখন পর্যন্ত বাস্তবতা হচ্ছে, হলান্ড তা করেননি।
বক্সের বাইরের খেলায় তাঁর অংশগ্রহণ তুলনামূলকভাবে অনেক কম। গত ১২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত করা এক হিসাব বলছে, বরুসিয়া ডর্টমুন্ডের তুলনায় সিটিতে প্রতি ম্যাচে তার পাসের সংখ্যা ১৫.৬ থেকে ১১.৭–তে নেমে এসেছে। এমনকি বল স্পর্শ করা এবং বল নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার হারও অনেক কমে গেছে।
হলান্ডের খেলার ধরন না বদলালেও তাঁর কারণে সিটির খেলাতে অবশ্য কিছু পরিবর্তন এসেছে। এ মৌসুমে সিটি তাদের গতি এবং বৈচিত্র্য হারিয়েছে। আক্রমণ তৈরির জন্য মাঝমাঠ ব্যবহার করতে গিয়ে প্রতিপক্ষের উইং ব্যবহার কমাতে হয়েছে।
একে শুধু নিছক খেলার ধরনেরই পরিবর্তন নয়, পাশাপাশি গার্দিওলার কৌশলগত সমঝোতাও বলা যায়। এমনকি আর্সেনালের বিপক্ষে ৩–১ গোলে জেতা ম্যাচে নিজের কোচিং ক্যারিয়ারের সবচেয়ে কম পজেশন রেখে দলকে খেলিয়েছেন গার্দিওলা। সেই ম্যাচে সিটির বল পজেশন ছিল মাত্র ৩৬ শতাংশ।
গার্দিওলার এই বদলের কারণে চিরায়ত পাসিং ফুটবলের যে সৌন্দর্য দেখা যেত, তা এবার অনেকটাই অনুপস্থিত। সে সঙ্গে মাঝমাঠে দখল হারানোর বিষয়টি তো আছেই। পরিসংখ্যান বলছে, সিটির বল পায়ে গতি গত মৌসুমের তুলনায় কমেছে। কমেছে বল নিয়ে সামনে এগোনোর হারও, সেটিও ৩৩ শতাংশ। যার অর্থ, হলান্ডের উপস্থিতি শুধু সিটির গতিই কমিয়ে দেয়নি, এটি প্রতিপক্ষকে চড়াও হওয়ার সুযোগও করে দিয়েছে।
হলান্ডকে ঘিরে গড়ে তোলা এই কৌশলে বড় হুমকিও লুকিয়ে ছিল, যা এখন সত্যি হতে শুরু করেছে। যেহেতু হলান্ড–নির্ভর কৌশল, তাই এই স্ট্রাইকার ছন্দ হারালে গার্দিওলা কী করেন, তা দেখার জন্য সবার কৌতূহল ছিল। পাশাপাশি সিটির মিডফিল্ডকে যদি প্রতিপক্ষ নিষ্ক্রিয় করে রাখতে পারে, তখন হলান্ড কী করতে পারবেন, সেটিও ছিল দেখার বিষয়। এ ক্ষেত্রে খুব ভালো উদাহরণ হতে পারে ম্যানচেস্টার ডার্বি।
সেদিন হলান্ডের সঙ্গে মিডফিল্ডের সংযোগ একরকম বন্ধই করে দিয়েছিল ইউনাইটেড। বল পেতেই হিমশিম খেয়েছেন এই নরওয়েজীয় তরুণ। আর এমন কড়া নজরদারির প্রভাব পড়েছে হলান্ডের নিজের খেলাতেও। এসব নিয়ে কথাবার্তা হওয়াতেই কিনা আর্সেনালের বিপক্ষে গোল করার পর একটু ব্যঙ্গভরেই বলেছিলেন, ‘সর্বশেষ গোলটাও করেছি ২০ মিনিট হয়ে গেল, সুতরাং আমার আরও পরিশ্রম করে যেতে হবে।’ তবে এ কথায় প্রতি ম্যাচ গোল করার যে চাপ, সেটাও কিন্তু ফুটে উঠেছে।
সর্বশেষ নটিংহামের বিপক্ষে যে গোল মিস করেছেন, তা হলান্ডের সঙ্গে রীতিমতো বেমানান। সব মিলিয়ে প্রশ্ন উঠে যাচ্ছে, হলান্ড কি পারবেন এই জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে। আর বদলে যাওয়া পরিস্থিতিতে গার্দিওলার কৌশলই–বা কী হবে? প্রশ্নগুলো শুধু হলান্ডকেন্দ্রিক নয়, এগুলোর উত্তরে লুকিয়ে আছে এ মৌসুমে সিটির সাফল্য ও ব্যর্থতাও।