মায়োর্কা, রিয়াল ভায়াদোলিদ, আতলেতিকো মাদ্রিদ, বার্সেলোনার পর ভ্যালেন্সিয়া—লা লিগার এবারের মৌসুমে পাঁচবার প্রতিপক্ষের মাঠে বর্ণবাদী আক্রমণের শিকার হয়েছেন ভিনিসিয়ুস জুনিয়র। তবে পরশু রাতে ভ্যালেন্সিয়ার মাঠ মেস্তায়া স্টেডিয়ামে বর্ণবাদের শিকার হওয়ার ঘটনায় ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে ভিনিসিয়ুসের। বারবার প্রতিকার চেয়েও সুরাহা না হওয়ায় স্প্যানিশ ফুটবল ফেডারেশন ও লা লিগা কর্তৃপক্ষকে সরাসরি দোষারোপ করেছেন রিয়াল মাদ্রিদের ব্রাজিলিয়ান উইঙ্গার।
তবে বর্ণবাদী আক্রমণ নিয়ে উল্টো ভিনিসিয়ুসকেই কাঠগড়ায় তুলেছেন হাভিয়ের তেবাস। লা লিগা সভাপতির এমন আচরণে রীতিমতো ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটেছে। জাপানে জি-৭ সম্মেলনে গিয়েও ভিনিসিয়ুসকে সমর্থন জানিয়ে ফুটবল মাঠে বর্ণবাদ বন্ধে ফিফাকে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা দা সিলভা। ফিফা সভাপতি জিয়ান্নি ইনফান্তিনোও তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় পূর্ণ সংহতি প্রকাশ করেছেন। পাশে দাঁড়িয়েছেন রোনালদো নাজারিওর মতো কিংবদন্তি আর কিলিয়ান এমবাপ্পে, নেইমার, রিচার্লিসনদের মতো তারকাও।
এত কিছুর পরও লা লিগা কর্তৃপক্ষ ঠুঁটো জগন্নাথের মতো ‘যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার’ দায়সারা বিবৃতি দিয়েছে শুধু। তবে স্প্যানিশ কর্তৃপক্ষ অবশেষে বর্ণবাদী আচরণ ও ঘৃণা থেকে উদ্ভূত অপরাধ নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে। তদন্তের ভার দেওয়া হয়েছে স্পেনের রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিদের। ভ্যালেন্সিয়ার বিচারিক আদালতের একটি সূত্র বার্তা সংস্থা এএফপিকে বিষয়টি জানিয়েছে। এর আগে রিয়ালের আইনজীবী এটিকে ঘৃণা থেকে উদ্ভূত অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে অভিযোগ দায়ের করেছিলেন।
এর আগে এই বছর জানুয়ারিতে ভিনিসিয়ুসের সঙ্গে এমনই এক বর্ণবাদী আচরণের ঘটনায় তদন্ত শুরু হয়েছিল। সে ঘটনার এতদিন পরে আজ চারজনকে আটক করেছে স্প্যানিশ পুলিশ। জানুয়ারিতে রিয়াল মাদ্রিদের অনুশীলন মাঠের সামনে এক ব্রিজে ভিনিসিয়ুসের জার্সি পরা পুতুলের গলায় ফাঁস দিয়ে ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন কিছু লোক। সঙ্গে রিয়াল মাদ্রিদের নগর প্রতিদ্বন্দ্বী আতলেতিকো মাদ্রিদের জার্সির রঙয়ের একটা ব্যানার টানিয়ে লেখা হয়েছিল, 'মাদ্রিদ রিয়ালকে ঘৃনা করে'। ওই ঘটনায় আজ যে চারজনকে আটক করা হয়েছে, পুলিশ বলছে, তাঁদের মধ্যে তিনজন 'মাদ্রিদের একটি ক্লাবের উগ্র সমর্থক'।
এর আগে পরশু ইনস্টাগ্রামে প্রতিবাদবার্তায় ভিনিসিয়ুস লিখেছিলেন, ‘স্পেনকে এখন বর্ণবাদীদের দেশ মনে করে ব্রাজিল।’ তাঁর কথা যে অমূলক নয়, সেটা রাস্তায় নেমে বুঝিয়ে দিয়েছে ব্রাজিলিয়ানরা। ভিনিসিয়ুসকে বর্ণবাদী আক্রমণের ঘটনায় স্পেনে তদন্ত শুরু হলেও প্রতিবাদে ফুঁসছে তাঁর দেশ। দেশটির বৃহত্তম শহর রিও ডি জেনিরোর প্রতীক হিসেবে পরিচিত ক্রাইস্ট দ্য রিডিমারের আলো এক ঘণ্টা বন্ধ রেখে ভিনির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করা হয়। আজ ভোরে টুইটারে সেই মুহূর্তের ছবি পোস্ট করে ভিনি লিখেছেন, ‘আঁধার এবং আরোপিত। তবে আমাদের এ লড়াইকে অনুপ্রাণিত করতে আরও আলো জ্বালাতে হবে।’
শুধু তা–ই নয়, ব্রাজিলে অবস্থিত স্প্যানিশ দূতাবাসের সামনেও প্রতিবাদ সমাবেশ করেছেন ব্রাজিলিয়ানরা। মাদ্রিদে ব্রাজিলের রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক অভিযোগও দেবেন তাঁরা। এ ব্যাপারে ব্রাজিলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র এএফপিকে বলেছেন, ‘স্প্যানিশ রাষ্ট্রদূত এই মুহূর্তে ব্রাসিলিয়া (ব্রাজিলের রাজধানী) থেকে দূরে আছেন। তবে আমরা টেলিফোনে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেছি এবং আমাদের খেলোয়াড়কে (ভিনিসিয়ুস) বারবার বর্ণবাদী আক্রমণ করায় অসন্তুষ্টির বিষয়টি জানিয়েছি।’
পরশু রাতে ভ্যালেন্সিয়ার বিপক্ষে রিয়ালের ম্যাচ চলাকালে ভিনিসিয়ুসের উদ্দেশে কিছু একটা বলতে থাকেন এক দর্শক। সেদিকে তেড়ে গিয়ে জবাব দেন ভিনি। তাতে খেলা বন্ধ থাকে প্রায় ১০ মিনিট। সব মিলিয়ে ম্যাচের স্থায়িত্ব ছিল ১০৭ মিনিট! একপর্যায়ে রেফারি রিকার্দো দি বুরগোস বর্ণবাদবিরোধী ‘প্রোটোকল’ সক্রিয় করতে বাধ্য হন। খেলা বন্ধ থাকার সময় তিনি দর্শকদের এই বলে সতর্ক করে দেন যে আর কেউ বর্ণবাদী মন্তব্য করলে ম্যাচ স্থগিত করা হবে। বর্ণবাদী আক্রমণে অতিষ্ঠ ভিনিসিয়ুসও খেলা চালিয়ে যেতে চাননি। পরে কোচ কার্লো আনচেলত্তির সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত পাল্টে মাঠে থেকে যান।
স্পেনের জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ওই দিন মেস্তায়া স্টেডিয়ামের গ্যালারির সব ছবি নিয়ে বিশ্লেষণ করছে এবং দায়ী ব্যক্তিকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে। এর আগে বর্ণবাদের সঙ্গে জড়িত স্টেডিয়ামকে এক বছর নিষিদ্ধ ও জড়িতদের প্রত্যেককে ৪ হাজার ইউরো (বাংলাদেশি মুদ্রায় ৪ লাখ ৬৬ হাজার টাকা) জরিমানার বিধান করার প্রস্তাব দিয়েছিল দেশটির ক্রীড়া পরিষদ।
ভুক্তভোগী ভিনিকেই লা লিগা সভাপতি তেবাস উল্টো অপরাধী বানানোর চেষ্টা করলেও স্প্যানিশ ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি লুইস রুবিয়ালেস স্বীকার করেছেন, তাঁর দেশের ফুটবলে বর্ণবাদ একটি সমস্যায় পরিণত হয়েছে। রুবিয়ালেস বলেছেন, ‘একজন দর্শক হোক কিংবা পুরো একটা গ্রুপ, যৌনতা ও গায়ের রং নিয়ে কাউকে অপমান করা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এটা আমাদের গুরুতর সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
পরশু ম্যাচের শেষ দিকে মেজাজ হারিয়ে ভ্যালেন্সিয়া খেলোয়াড়দের সঙ্গে হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়েন ভিনিসিয়ুস। এ ঘটনায় লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়তে হয় তাঁকে। তবে রিয়ালের দাবি, রেফারি অসম্পূর্ণ ছবির ওপর ভিত্তি করে ভিনিসিয়ুসকে শাস্তি দিয়েছেন। লাল কার্ড দেখিয়েও ভিনির প্রতি অন্যায় করা হয়েছে বলে মনে করে রিয়াল।