হুলিয়ান আলভারেজের প্রতিভা নিয়ে কারও মনে সন্দেহ থাকার কথা নয়। কিন্তু আলভারেজ তো শুধু প্রতিভাবান নন, সৌভাগ্যের পরশপাথরও! ফুটবল ক্যারিয়ারে যাঁদের অপ্রাপ্তির শেষ নেই, যাঁদের শিরোপা–খরা কিছুতেই ঘুচছে না, তাঁরা ম্যানচেস্টার সিটির এই আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ডের সঙ্গে কপাল ঘষতে পারেন।
বয়স মাত্র ২৪। আলভারেজ এরই মধ্যে জিতে ফেলেছেন বিশ্বের সব প্রধান ফুটবল প্রতিযোগিতার শিরোপা। এবার তাঁর সামনে আর্জেন্টিনার হয়ে অলিম্পিকে সোনার পদক জয়ের সুযোগ।
অথচ কত রথী–মহারথীকে অপূর্ণতা নিয়েই খেলোয়াড়ি জীবনকে বিদায় জানাতে হয়েছে। যাঁরা সব জিততে পেরেছেন, তাঁদেরকেও অপেক্ষা করতে হয়েছে ক্যারিয়ারের সায়াহ্ন পর্যন্ত। আলভারেজের আদর্শ লিওনেল মেসিকেই দেখুন না। কাতার বিশ্বকাপ জিতে যখন বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারটাকে পূর্ণতা দিলেন, তখন তাঁর বয়স ৩৫ বছর ১৭৭ দিন।
প্যারিস অলিম্পিক ফুটবলে সোনা জিততে আর্জেন্টিনাকে পেরোতে হবে আরও চার ধাপ। ‘বি’ গ্রুপের ম্যাচে মরক্কোর কাছে নাটকীয়ভাবে ২–১ গোলে হেরে আসর শুরু করা আর্জেন্টিনা সর্বশেষ ম্যাচে ইরাককে ৩–১ ব্যবধানে হারিয়ে দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
এই গ্রুপের পয়েন্ট তালিকাও বেশ রোমাঞ্চ ছড়াচ্ছে। একটি করে জয় ও হারে চার দলেরই পয়েন্ট সমান ৩ করে। তবে গোলপার্থক্যে এগিয়ে থাকায় আর্জেন্টিনা আছে শীর্ষে। ইউক্রেনের বিপক্ষে আজ রাতে হাভিয়ের মাচেরানোর দলকে তাই ড্র করলেই চলবে। এরপর তাদের তিনটি বড় পরীক্ষা—কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমিফাইনাল ও ফাইনাল।
কাজটা খুব কঠিন হলেও আর্জেন্টিনা ১৬ বছর পর অলিম্পিক ফুটবলে ‘সোনালি স্বপ্ন’ দেখতে পারে আলভারেজের কারণেই। শীর্ষ পর্যায়ের ফুটবলে এখন পর্যন্ত যে টুর্নামেন্টে আলভারেজের অভিষেক হয়েছে, এর বেশির ভাগেই তাঁর দল চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। অলিম্পিকেও তিনি প্রথমবারের মতো খেলছেন। এবারও তাঁকে সৌভাগ্যের দূত ভাবাই যায়।
স্বদেশি ক্লাব রিভার প্লেটের হয়ে ২০১৮ সালে শীর্ষ পর্যায়ের ফুটবলে অভিষেক হয় আলভারেজের। সে বছরই দলটির হয়ে জেতেন দক্ষিণ আমেরিকান ক্লাব ফুটবলের সর্বোচ্চ প্রতিযোগিতা কোপা লিবের্তাদোরেস। তখন থেকে এখন পর্যন্ত প্রতিবছরই কোনো না কোনো ট্রফি জিতেছেন আলভারেজ। প্যারিস অলিম্পিকে খেলতে যাওয়ার কদিন আগেই আর্জেন্টিনার হয়ে দ্বিতীয়বার কোপা আমেরিকায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। তাঁর অর্জনগুলো ডাগআউটে বসে বেঞ্চ গরম করতে করতে আসেনি। যখনই সুযোগ পেয়েছেন, দুহাত ভরে লুফে নিয়েছেন। ট্রফি জয়ের পথে বেশ কয়েকটি বড় ম্যাচে গোল করে অথবা সতীর্থদের দিয়ে করিয়ে অবদান রেখেছেন।
রিভার প্লেটের হয়ে আলভারেজের ২০১৯ সালটা ছিল আরও রঙিন। সে বছর জেতেন তিনটি ট্রফি—কোপা আর্জেন্টিনা, সুপারকোপা আর্জেন্টিনা ও রেকোপা সুদামেরিকানা। ২০২০ সালে করোনা মহামারির বছরে ক্লাবের হয়ে কিছু জেতা হয়নি। তবে সে বছর আর্জেন্টিনা অনূর্ধ্ব-২৩ দলের হয়ে কনমেবল প্রাক্-অলিম্পিক টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হন। ক্লাবটির হয়ে লিগ জয়ের অপেক্ষা ফুরায় ২০২১ সালে, একই বছর জেতেন ট্রফেও দে কাম্পেওনেসও।
খেললেই যাঁর দল চ্যাম্পিয়ন হয়, তাঁর দিকে ইউরোপের শক্তিধর ক্লাবগুলোর চোখ পড়বে, এটাই স্বাভাবিক। ২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি নিজের ২২তম জন্মদিনে সুখবরটা আলভারেজ নিজেই জানান। ২ কোটি ইউরোয় তাঁকে দলে ভেড়ায় ইংলিশ ক্লাব ম্যানচেস্টার সিটি। এর পর থেকে আরও মধুর সময় ধরা দেয় তাঁর জীবনে। সিটিতে ভালো খেলার পুরস্কার হিসেবে জায়গা পান কাতার বিশ্বকাপের আর্জেন্টিনা দলে। সে বছরের ডিসেম্বরে হয়ে যান বিশ্বকাপজয়ী খেলোয়াড়। এরপর সিটির হয়ে একে একে জেতেন প্রিমিয়ার লিগ ও এফএ কাপ, উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ, উয়েফা সুপার কাপ ও ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপের শিরোপা।
২০২২-২৩ মৌসুমে তো অনন্য কীর্তিই গড়ে ফেলেন আলভারেজ। একই মৌসুমে ট্রেবলের সঙ্গে বিশ্বকাপ ইতিহাসের প্রথম ফুটবলার হিসেবে এই চার ট্রফি জেতেন। সব অর্জনই টুর্নামেন্টের অভিষেকে! গত বছর ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপে গড়েন আরেকটি বিশ্ব রেকর্ড। সৌদি আরবের জেদ্দায় ব্রাজিলিয়ান ক্লাব ফ্লুমিনেন্সের বিপক্ষে ফাইনালের মাত্র ৪০ সেকেন্ডেই করেন গোল। সেটি ক্লাব বিশ্বকাপ তো বটেই, যেকোনো মহাদেশীয় ও বৈশ্বিক আসরের ফাইনালে দ্রুততম গোলের রেকর্ড। সে রাতে তাঁর দ্রুততম গোলের পর ধারাভাষ্যকার তো বলেই ফেলেন, ‘আলভারেজ, অ্যাহেড অব দ্য ওয়ার্ল্ড!’
ম্যানচেস্টার সিটির হয়ে অবশ্য এখনো এফএ কমিউনিটি শিল্ড ছুঁয়ে দেখা হয়নি আলভারেজের। তবে কমিউনিটি শিল্ডকে প্রধান শিরোপা হিসেবে বিবেচনা করা হয় না বলে এটি জিততে না পারা নিয়ে তাঁর আক্ষেপ থাকার কথা নয়। ইংল্যান্ড ছেড়ে গেলে হয়তো এই ট্রফি জেতাও হবে না।
গুঞ্জন আছে, এবারের গ্রীষ্মকালীন দলবদলেই ম্যানচেস্টার সিটি ছাড়তে চান আলভারেজ। ক্রীড়াবিষয়ক ওয়েবসাইট দ্য অ্যাথলেটিক এক বিশেষ প্রতিবেদনে জানিয়ছে, কোচ পেপ গার্দিওলা তাঁকে যথেষ্ট সময় খেলার সুযোগ না দেওয়ায় সিটি ছাড়তে পারেন।
শেষ পর্যন্ত আলভারেজ সিটিতে থাকুন কিংবা অন্য ক্লাবে নাম লেখান, একজন অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন হয়েই সিদ্ধান্তটা নিতে চাইবেন। আর্জেন্টিনাকে ১৬ বছর পর অলিম্পিক ফুটবলে সোনার পদক এনে দিতে পারলে তাঁর প্রাপ্তির চক্রটাও তো পূরণ হয়। সেটা হলে তাঁর আদর্শ মেসির সঙ্গে চক্রপূরণের ব্যাপারটা উল্টোভাবে হবে। মেসির ফুটবল ক্যারিয়ারকে পূর্ণতা দেওয়ার শুরুটা হয়েছিল অলিম্পিক জিতে, আলভারেজের ক্ষেত্রে শেষটা হবে অলিম্পিক জিতে!