সোনা জয়ের পর ফ্রান্স ভলিবল দলের উচ্ছ্বাস
সোনা জয়ের পর ফ্রান্স ভলিবল দলের উচ্ছ্বাস

প্যারিস অলিম্পিক থেকে উৎপল শুভ্র

ফ্রান্স এখন ভলিবলেরও পরাশক্তি

সাউথ প্যারিস অ্যারেনার ভলিবল কোর্ট থেকে যে আওয়াজটা উঠল, প্রায় ১৪ মাইল দূরে প্যারিসের প্রাণকেন্দ্র থেকেও তা শোনা যাওয়ার কথা। বড় পর্দায় ‘গোল্ড মেডেল পয়েন্ট’ ভেসে উঠতেই দাঁড়িয়ে গেছে গ্যালারি। হাতে হাতে দুলছে তেরঙা জাতীয় পতাকা। গলা ছেড়ে গান গাইতে শুরু করেছেন সবাই। ফ্রান্স জিতে যাওয়ার মুহূর্তে যা বদলে গেল গগনবিদারী আওয়াজে।

স্বাগতিক দেশের সাফল্য দেখার অন্য একটা মজা আছে। বিশেষ করে দলীয় খেলায়। এই আবেগ, এই আনন্দের সাক্ষী হয়ে থাকাটাও দারুণ একটা অভিজ্ঞতা। ২০১৬ রিও অলিম্পিকে ছেলেদের ফুটবল আর ভলিবলে ব্রাজিলের সোনা জয়ের মুহূর্তটা যেমন এখনো পরিষ্কার মনে করতে পারি। সেখানে ছিল ‘ব্রা-জিল’ ‘ব্রা-জিল’ বলে গর্জন। এখানে অবশ্য ফ্রান্স-ফ্রান্স একবারও নয়। শুধুই করতালি আর গান। শেষে ওই সমবেত উল্লাসধ্বনি।

আগের দিন সাউথ প্যারিস অ্যারেনার কাছেই পার্ক দু প্রিন্সেসে ফুটবল ফাইনালে ফ্রান্স হেরে গেছে স্পেনের কাছে। পরদিন মানে গতকাল ‘বল’ দিয়ে শেষ হয়, এমন আরও তিন-তিনটি খেলার ফাইনালে ফ্রান্স। বাস্কেটবলের দুটি ফাইনালেই ফ্রান্স বনাম যুক্তরাষ্ট্র। ছেলেদের ফাইনালটা এদিন (গতকাল) রাতেই। এই সাউথ প্যারিস অ্যারেনারই অন্য একটা হলে মেয়েদের হ্যান্ডবল ফাইনাল শুরু হয়ে গেল ভলিবলের ফাইনাল শেষ হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই। যেটিতে নরওয়ের কাছে হেরে যাওয়ায় ভলিবলে ফ্রান্সের সাফল্যটা আরও মধুর হয়ে উঠল। ফুটবলের দুঃখে তো একটু  প্রলেপ দেওয়ার কাজটা ভলিবল আগেই করেছে।

সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের পর তৃতীয় দেশ হিসেবে অলিম্পিকে টানা দুবার সোনা জিতল ফরাসিরা

ভলিবল ফাইনালে পাশেই বসেছেন যে ফরাসি তরুণ, আগের দিন পার্ক দু প্রিন্সেসে ফুটবল ফাইনালেও তিনি ছিলেন। খেলা শুরুর আগেই বললেন, ‘এটাতেও হেরে গেলে দুঃখের কোনো সীমা থাকবে না।’ খেলা শেষ হওয়ার পর তাঁর আনন্দের কোনো সীমা থাকল না। মুখে বিচিত্র একটা আওয়াজ তুলে ঘুরে ঘুরে নাচতে শুরু করলেন।

যে দাপট দেখিয়ে ফ্রান্সের ভলিবলে সোনা, তা অবশ্য সমর্থকদের আনন্দে নাচানোর মতোই। সেমিফাইনালে সামনে পড়েছিল বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইতালি। ৩-০ সেটে উড়ে গেছে। ফাইনালের প্রতিপক্ষ পোল্যান্ড আবার র‍্যাঙ্কিংয়ে এক নম্বর। এখানেও ফ্রান্সের জয় সরাসরি সেটে। কোনো সেটেই বলার মতো প্রতিদ্বন্দ্বিতাও হয়নি। ২৫-১৯, ২৫-২০, ২৫-২৩ স্কোরলাইনই যার প্রমাণ। শেষ সেটটাকে ক্লোজ মনে হলেও পোল্যান্ডের শেষ ২ পয়েন্ট তো ফ্রান্স গোল্ড মেডেল পয়েন্টে চলে যাওয়ার পর।

জার্মানির বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালে ২-০ সেটে পিছিয়ে পড়ার পরও ফিরে আসার আত্মবিশ্বাসটাই হয়তো সেমিফাইনাল ও ফাইনালে ফ্রান্সের এমন অপ্রতিরোধ্য রূপে দেখা দেওয়ার মূলে। গত ৮টি অলিম্পিকে যা কেউ পারেনি, সেটাই করে ফ্রান্স এখন পুরুষদের অলিম্পিক ভলিবলে সোভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রাজিল ও যুক্তরাষ্ট্রের কাতারে। এত দিন শুধু এই তিনটি দেশেরই পুরুষ ভলিবলে একাধিক অলিম্পিক সোনা জয়ের কৃতিত্ব ছিল। তিন বছর আগে টোকিওতেও ভলিবলে সোনা জিতেছিল ফ্রান্স। টানা দুই অলিম্পিকে সোনা জয়ের কীর্তিতে ফ্রান্সের সঙ্গী শুধু সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র। সর্বশেষ যুক্তরাষ্ট্র টানা দুটি সোনা জিতেছিল ১৯৮৪ ও ১৯৮৮ অলিম্পিকে। মাঝের ৮টি অলিম্পিকে আর কোনো দল সোনা ধরে রাখার আনন্দে ভাসতে পারেনি।

টোকিওর পর প্যারিসেও পুরুষ ভলিবলে সোনা জিতল ফ্রান্স

ভলিবলের সবচেয়ে বড় পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন দেশটাই আর নেই। ১৯৬৪ সালে অলিম্পিকে ভলিবল শুরুর পর প্রথম চারটিরই ফাইনাল খেলে তিনবার জিতেছে ভেঙে টুকরা টুকরা হয়ে যাওয়া এই দেশ। টানা চারবার জিততে পারেনি যাদের কারণে, সেই পোল্যান্ড ৪৮ বছর পর এই প্রথম ফাইনালে। ১৯৭৬ মন্ট্রিয়ল অলিম্পিকে সোনাজয়ী দেশটার জন্য এমনই বড় উপলক্ষ যে প্রেসিডেন্ট আন্দ্রে দুদা পর্যন্ত খেলা দেখতে ছুটে এসেছেন। ফরাসিময় গ্যালারির ফাঁকেফোকে কিছু পোলিশ দর্শকও ছিলেন। বেচারারা বলতে গেলে আনন্দ করার কোনো উপলক্ষই পেলেন না।

টানা দুই অলিম্পিকে ফ্রান্সের সোনা জয় ভলিবলের আন্তর্জাতিক মানচিত্র বদলে দেওয়ার মতোই ঘটনা। এই লেখায় বাকি যে দেশগুলোর নাম এসেছে, প্রতিটিই ভলিবলের ঐতিহ্যবাহী শক্তি। ফ্রান্স মোটেই তা নয়। টোকিও ২০২০-এর আগে অলিম্পিকে কোনো পদকই নেই। ভলিবলের সবচেয়ে বড় দুটি টুর্নামেন্ট বিশ্বকাপ আর বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপও জেতেনি কখনো। অলিম্পিকের বাইরে আন্তর্জাতিক সাফল্য বলতে ২০১৫ সালে ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন হওয়া।

সেই ফ্রান্স এখন ফুটবলের মতো ভলিবলেরও পরাশক্তি।