আজ বার্সেলোনা–নাপোলির ‘ম্যারাডোনা ডার্বি’
আজ বার্সেলোনা–নাপোলির ‘ম্যারাডোনা ডার্বি’

চ্যাম্পিয়নস লিগে আজ ‘ম্যারাডোনা ডার্বি’

ফ্রাস্ট্রেশন (হতাশা) ও রেজারেকশন (পুনরুত্থান)—ডিয়েগো ম্যারাডোনার আত্মজীবনী ‘এল ডিয়েগো’র পরপর দুটি অধ্যায়ের নাম। প্রথমটিতে ম্যারাডোনা লিখেছেন বার্সেলোনায় তাঁর কাটানো হতাশাজনক সময়ের বৃত্তান্ত। আর দ্বিতীয়টিতে লিখেছেন নাপোলিতে গিয়ে ইতিহাস গড়ার সেই সময়ের কথা। দুই বিপরীত অভিজ্ঞতার ছাপ পাওয়া যায় ম্যারাডোনাকে নিয়ে দুই পক্ষের উন্মাদনার দিকে তাকালেও।

বার্সেলোনায় ম্যারাডোনা শুধুই একজন কিংবদন্তি খেলোয়াড়, যিনি তাদের ক্লাবে খেলে গেছেন। বিপরীতে নাপোলিতে ম্যারাডোনা পেয়েছেন ঈশ্বরের মর্যাদা। হ্যাঁ, নাপোলিতেও ম্যারাডোনার শেষটা সুখকর হয়নি। তবু ম্যারাডোনাকে রীতিমতো দেবতাজ্ঞান করে ইতালির ক্লাবটি। আর্জেন্টাইন মহাতারকাকে এখনো হৃদয়ে ধারণ করে রেখেছে তারা। এমনকি তাদের মাঠের নামও রাখা হয়েছে ম্যারাডোনার নামেই। ম্যারাডোনার মৃত্যুর পর বুয়েনস এইরেসের মতোই শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েছিল ইতালিয়ান শহর নেপলসও

তবে ভিন্ন অভিজ্ঞতা হওয়ার পরও বার্সেলোনা-নাপোলির লড়াইয়ে সব সময় উঠে এসেছে ম্যারাডোনার নাম। এ দুই দলের লড়াইকে অনেকে নাম দিয়েছেন ‘ম্যারাডোনা-ডার্বি’। আজ চ্যাম্পিয়নস লিগের শেষ ষোলোর প্রথম লেগের লড়াইয়ে তেমনই এক ডার্বিতে মুখোমুখি হবে এ দুই দল। যথারীতি এবারও দুই দলের লড়াইয়ের আগে বারবার সামনে আসছে ম্যারাডোনার নাম। এই উপলক্ষ সামনে রেখে দেখে নেওয়া যাক কেমন ছিল এ দুই ক্লাবে ম্যারাডোনার অভিজ্ঞতা।

১৯৮২ সালের জুনে সে সময়ের বিশ্ব রেকর্ড গড়ে ৫০ লাখ পাউন্ডে বোকা জুনিয়র্স থেকে বার্সেলোনায় যোগ দেন ম্যারাডোনা। বার্সায় গিয়ে সিজার লুইস মেনোত্তির অধীনে রিয়াল মাদ্রিদকে হারিয়ে কোপা দেল রের শিরোপা জেতেন ম্যারাডোনা। জেতেন কোপা দে লা লিগা এবং সুপারকোপার শিরোপাও। ১৯৮৩ সালের জুনে এল ক্লাসিকোতে রিয়ালের মাঠে গিয়ে গোল করে বার্সাকে জয় এনে দেন ম্যারাডোনা।

নাপোলির অনুশীলনে ভিক্টর ওসিমেন

সেদিন রিয়ালের দর্শকেরাও শত্রুতা ভুলে অভিবাদন জানিয়েছিল বাঁ পায়ের এ জাদুকরকে। ২০০৫ সালে রোনালদিনিওর আগে ম্যারাডোনাই ছিলেন একমাত্র বার্সা খেলোয়াড়, যিনি রিয়ালের মাঠে গিয়ে অভিবাদন পেয়েছিলেন।

এরপরও বার্সায় ম্যারাডোনার সময়টা মোটেই সুখকর হয়নি। কাতালানদের ‘অদ্ভুতদর্শন’ আচার-আচরণকে কখনোই পছন্দ হয়নি তাঁর। তবে বার্সায় ম্যারাডোনার সবচেয়ে বড় সমস্যার নাম ছিলেন সে সময়ের ক্লাব সভাপতি জোসে লুইস নুনিয়েজ। আত্মজীবনীতে যাঁকে ম্যারাডোনা সম্বোধন করেছেন, ‘প্রচারসর্বস্ব’ মানুষ বলে।

লিখেছেন, ‘সংবাদমাধ্যমে মুখ দেখানোর জন্য তিনি যেকোনো কিছু করতে পারতেন।’ সম্পর্কের এই টানাপোড়েনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল অসুস্থতা, চোট এবং বিতর্ক। যার ফলে মাত্র দুই বছরের মাথায় শেষ হয়ে যায় ম্যারাডোনার বার্সেলোনা-অধ্যায়। হতাশা নিয়েই শেষ পর্যন্ত দলবদলের আরেকটি নতুন রেকর্ড গড়ে (৬০ লাখ ৯০ হাজার পাউন্ড) নাপোলিতে যোগ দেন ম্যারাডোনা।

ম্যারাডোনা আসার আগে নেপলস শহরটি পরিচিত ছিল মাফিয়া ও সন্ত্রাসীদের আস্তানা হিসেবে। কিন্তু জাদুর ছোঁয়ায় পুরো ক্লাবটিকে একাই বদলে দিয়েছিলেন আর্জেন্টাইন জাদুকর। তিনি এসেই ঘোষণা দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি নেপলসের শিশুদের আদর্শ হতে চাই। কারণ, তারাও আমার মতো।’ নিজের সেই কথা রেখেছিলেন ম্যারাডোনা। এদুয়ার্দো গালিয়ানো তাঁর বিখ্যাত বই ‘সকার ইন সান অ্যান্ড শ্যাডো’র ‘ম্যারাডোনা’ অধ্যায়ে লিখেছিলেন, ‘নেপলসে ম্যারাডোনা হয়ে ওঠেন সন্ত ম্যারাডোনা।

নেপলস যাওয়ার পথে বার্সা তারকা রবার্ট লেভানডফস্কি

কেবল তা-ই নয়, সত্যিকারের সন্ত সান গিন্নারোর ম্যারাডোনায়ন করে ছাড়েন নেপলসবাসীরা।’ গালিয়ানোর ভাষায়, ‘সন্ত গিন্নারো হন সন্ত গিন্নারমান্দো। রাস্তায় তাঁরা এই হাফপ্যান্ট পরা দেবতার (ম্যারাডোনা) ছবি বিক্রি করতেন, আর সেই সব ছবিতে ম্যারাডোনার অলৌকিক ক্ষমতা বোঝাতে মাতা মেরির মতো আলোর বলয় এঁকে রাখত তারা।’

ম্যারাডোনাকে ঘিরে তৈরি হওয়া এ উন্মাদনার মূলে ছিল নাপোলির অবিশ্বাস্য পারফরম্যান্স। ম্যারাডোনার হাত ধরেই ১৯৮৬-৮৭ ও ১৯৮৯-৯০ মৌসুমে লিগ শিরোপা জেতে নাপোলি। এ ছাড়া ১৯৮৮-৮৯ মৌসুমে প্রথম এবং এখন পর্যন্ত শেষবারের মতো ইউরোপিয়ান সাফল্য পায় নাপোলি। জিতে নেয় উয়েফা কাপের শিরোপা। এরপর ১৯৯১ সালে কিছুটা তিক্ততা নিয়ে শেষ হয় ম্যারাডোনার নাপোলি অধ্যায়।

তবে এরপরও নেপলসবাসীর মনে নিজের জায়গা ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের’ মতো খোদাই করে নেন ম্যারাডোনা। আজও কোণঠাসা নাপোলি যখন বার্সেলোনার মুখোমুখি হতে যাবে, তখন তাদের চারপাশে আলোর বলয় হয়ে থাকবেন সেই ম্যারাডোনাই। নাপোলির মতো বার্সাও চাইলে অনুপ্রেরণা নিতে পারে ম্যারাডোনার কাছ থেকে। তাদের সঙ্গেও যে জড়িয়ে আছে এ নামটি।

৩৩ বছর পর গত মৌসুমে সিরি ‘আ’ শিরোপা জেতা নাপোলি এবার আছে দুঃসময়ের বৃত্তে। মৌসুম শুরুর আগেই ক্লাব ছাড়েন শিরোপা জেতানো কোচ লুসিয়ানো স্পালেত্তি। এরপর আরও দুজন কোচকে বরখাস্ত করেছে তারা। গত নভেম্বরে রুডি গার্সিয়ার পর গতকাল তারা ছাঁটাই করেছে ওয়াল্টার মাজ্জারিকেও।

ম্যারাডোনার দেয়ালচিত্রের সামনে নাপোলি ও বার্সার জার্সি

সিরি ‘আ’র পয়েন্ট তালিকার নয়ে নেমে যাওয়ার খেসারত দিতে হয়েছে এ কোচকে। আজ ডিয়েগো আরমান্ডো ম্যারাডোনা স্টেডিয়ামে নাপোলির ডাগআউটে দেখা যাবে নতুন কোচ ফ্রান্সেসকো কালজোনাকে। এই প্রথম সিরি ‘আ’র কোনো দলের নেতৃত্ব দেবেন এই কোচ। এ ছাড়া বার্সার বিপক্ষে ইতিহাসকেও পাশে পাচ্ছে না নাপোলি।

বার্সার বিপক্ষে এর আগের চার দেখায় কোনো জয় নেই দলটির। দুই হারের বিপরীতে আছে ২ ড্র। এরপরও নাপোলিতে এমন খেলোয়াড় আছেন, যাঁরা নিজেদের দিনে বদলে দিতে পারেন সব হিসাব-নিকাশ। আগামী মৌসুমে নাপোলি ছাড়ার পথে থাকা ভিক্টর ওসিমেনের সামনে সুযোগ বিদায়ের আগে দারুণ কিছু করে দেখানোর।

এ ছাড়া ম্যারাডোনা না থাকলেও অন্য এক ‘ম্যারাডোনা’কে আজ দলে পাচ্ছে তারা। জর্জিয়ান তারকা খিচা কাভারাস্কেইয়া গত মৌসুমে নাপোলির হয়ে দারুণ খেলে ‘নতুন ম্যারাডোনা’ বা ‘কাভারাডোনা’ নামে পরিচিতি পান। চলতি মৌসুমে নিজের নামের প্রতি সুবিচার করতে না পারলেও আজ তাঁর সামনে সুযোগ জ্বলে ওঠার। এমন উপলক্ষে নায়ক হয়ে ওঠার সুযোগ কে হারাতে চায়!

অন্যদিকে বার্সার জন্যও ম্যাচটি মহাগুরুত্বপূর্ণ। প্রায় হাত ফসকে গেছে লা লিগার শিরোপা। কোপা দেল রে জেতার সুযোগও শেষ। বিদায়বেলায় কোচ জাভি হার্নান্দেজের জন্য চ্যাম্পিয়নস লিগ হতে পারে অসামান্য এক উপহার। তবে পথটা মোটেই সহজ নয়। আজ নাপোলির মাঠে তাদের দিতে হবে প্রথম পরীক্ষা। এই পরীক্ষা উতরাতে জ্বলে উঠতে হবে রবার্ট লেভানডফস্কি-লামিনে ইয়ামাল-ইলকাই গুন্দোয়ানদের। তাঁরা কি পারবেন? পারা না-পারার উত্তরটা সময়ের কাছেই তোলা থাক!