বাংলাদেশের শীর্ষ ফুটবলাররা ক্লাব পর্যায়ে কেন গড়পড়তা ৭০-৮০ লাখ পান এক মৌসুমে? জাতীয় দল ভালো না করলেও কোনো কোনো ফুটবলারের পারিশ্রমিক কোটি টাকা পেরিয়েছে কেন?
অনেক দিন ধরেই প্রশ্নটা দেশের ফুটবল অন্দরে ঘোরাফেরা করছিল। কিন্তু পরশু শেষ হওয়া প্রিমিয়ার ফুটবল লিগের প্রাণহীন দলবদলের শেষ দৃশ্যটা মনে করলে উল্টো ফুটবলারদের জন্য মায়াই হবে। শীর্ষ স্তরের ফুটবলারদের অনেকে হন্যে হয়ে একটা দলে কোনোমতে ভিড়েছেন এবার। এক শীর্ষ ফুটবলারের ভাষায়, ‘পেটেভাতে’খেলতে হবে তাঁদের। পারিশ্রমিক নেমে এসেছে ৫-৭ লাখ টাকায়। অনেককে খেলতে হবে মাসে ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা বেতনে।
ফুটবলারদের এই অসহায় অবস্থায় ফেলে দিয়েছে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন–পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ। বঙ্গবন্ধুর দুই ছেলের নামে প্রতিষ্ঠিত শেখ জামাল ও শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্রের পাশ থেকে সরে গেছে স্পনসর প্রতিষ্ঠান বসুন্ধরা গ্রুপ। ফলে ৫ আগস্টের আগে যেসব ফুটবলার এই ক্লাব দুটিতে অন্তত ৩৫-৪০ লাখ টাকায় চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন, তাঁরা পড়েন মহাবিপাকে। তাঁদের কেউ দৌড়ঝাঁপ করে ব্রাদার্সে, কেউ রহমতগঞ্জে, কেউ আবাহনীতে ভিড়েছেন।
শেখ রাসেল থেকে আসা জাতীয় দলের ডিফেন্ডার রিয়াদুল হাসানকে মোহামেডান একটা ‘সম্মানজনক স্যালারি’ দেবে। ওয়ান্ডারার্স নাকি কোনো কোনো খেলোয়াড়কে বলেছে ৩০-৩৫ হাজার টাকায় মাসে খেলতে। ব্রাদার্স তড়িঘড়ি করে শেষ সময়ে কয়েকজন ফুটবলার নিয়েছে ‘টোকেন মানি’ ছাড়াই।
তবে ক্লাবটি লাভবান হয়েছে কম টাকায় ভালো দল গড়ে। জাতীয় দলের ডিফেন্ডার রহমত মিয়া, গোলকিপার আশরাফুল ইসলাম, পাপ্পু হোসেন, রহমত মিয়া, মান্নাফ রাব্বি, সাজ্জাদসহ বেশ কয়েকজন ফুটবলার নিয়েছে ব্রাদার্স। রহমতগঞ্জ, ফর্টিসও মোটামুটি ভালো দল গড়েছে।
ইমন, মুরাদ, জাফর, কামরুলকে হারালেও রিয়াদুল রাফি, রহিম, দীপু, রাজীব শেখকে নিয়েছে বিকল্প হিসেবে মোহামেডান। সঙ্গে ৬ বিদেশি। রহমতগঞ্জে গেছেন ডিফেন্ডার রায়হান, গোলকিপার শহিদুল আলম, স্ট্রাইকার নাবিব নেওয়াজরা। তাঁরা সামান্য কিছু পারিশ্রমিক পাবেন। নাবিবের কথায়, ‘অঙ্কটা বলতেও বিব্রতবোধ করছি।’
কিন্তু মাসে ৫০ হাজার, এক লাখ টাকা বেতনে খেলতে নারাজ জাতীয় দলের অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়া। আবাহনী নাকি এর বেশি প্রস্তাব দেয়নি জামালকে। ফলে শেষমেশ জামাল কোনো দলেই নেই। একটা দেশের জাতীয় দলের অধিনায়ক ঘরোয়া ফুটবলে দলবিহীন, বিশ্ব ফুটবলেই তা নজিরবিহীন। শোনা যায়, পরশু দুপুরে আবাহনী শিবির থেকে আওয়াজ ওঠে তারাও খেলবে না। শেষে সবাইকে ৪–৫ লাখ টাকার বেশি দেওয়া সম্ভব নয় বলে আবাহনী। টাকার অঙ্কটা এতটা কমে আসার পরও স্ট্রাইকার মতিন মিয়া, মাসুক মিয়া জনিও দল পাননি।
চট্টগ্রাম আবাহনী তো এবার দলই গড়তে চায়নি। শেষমেশ পরশু মধ্যরাতে সাবেক ফুটবলার জাহিদ হাসান এগিয়ে এসে চট্টগ্রাম আবাহনীর হাল ধরে ৩৬ জন খেলোয়াড়ের একটা তালিকা বাফুফেতে জমা দিয়েছেন। কিন্তু চিন্তা রয়েছে দল কীভাবে চলবে। এমিলি যেমন বললেন, ‘আমরা আপাতত কোনো চুক্তিতে যাইনি খেলোয়াড়দের সঙ্গে। খেলোয়াড়েরা স্যাক্রিফাইস করেছে। কিন্তু পুরো মৌসুম ফ্রি খেলাতে পারব না। কম করেও ৩-৪ কোটি টাকা লাগে একটা দল চালাতে। এখন টাকা জোগাড় করাই বড় চ্যালেঞ্জ।’
এমন দলবদল আগে কখনো দেখেননি জানিয়ে মোহামেডানের কোচ আলফাজ আহমেদ বলছেন, ‘এবার খেলোয়াড়দের আর্থিক চাহিদা মাটিতে মিশে গেছে। ওরা কোনো ডিমান্ডই করতে পারেনি।’ ফর্টিস এফসি ম্যানেজার রাশেদুল ইসলাম মনে করেন পরিস্থিতি যা–ই হোক, ক্লাবগুলোর আরেকটু উদার হওয়া উচিত ছিল।
দলবদল তো শেষ। এবার খেলা মাঠে গড়ানোর পালা। স্বাধীনতা কাপ হচ্ছে না। ফেডারেশন কাপ, লিগ আর আর এক ম্যাচের চ্যালেঞ্জ কাপ হবে। এসব আয়োজনে তপু, আনিসুর, সোহেল রানাদের বসুন্ধরা কিংস হেসেখেলে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কথা।
কিংসের বড় প্রতিপক্ষ হতে পারে মোহামেডান। কিন্তু আবাহনী? ওয়ান্ডারার্স, চট্টগ্রাম আবাহনীর মতো বিদেশি নেয়নি আবাহনীও। ইব্রাহিম, আমিনুর রহমান, সুমন রেজা, আকাশ, জাফর ইকবালসহ আকাশি–নীলেরা ৩২ জন দেশি ফুটবলার নিয়েছে। কোনো বিদেশি নেয়নি শুনে ক্লাবটির সাবেক তারকা আশরাফউদ্দিন চরম ক্ষুব্ধ হয়ে একটা প্রশ্নও তুলছেন, ‘এটা লজ্জাজনক। আবাহনীর ইতিহাসে এমন হয়নি কখনো। টাকা নেই? এত দিন ক্লাবের সুবিধাভোগীরা কোথায় গেল?’