ঘটনাটা গত আগস্টের। লুটন টাউনের বিপক্ষে ম্যাচের পর সংবাদ সম্মেলনে চেলসি কোচ মরিসিও পচেত্তিনো। এক সাংবাদিক জিজ্ঞাসা করলেন, দুই মৌসুম বাইরে (ধারে) কাটিয়ে আসা মালাং সারকে ম্যাচ-স্কোয়াডে না রাখার কারণ কী?
পচেত্তিনো প্রশ্নের জবাব দেবেন কী, সারকেই চিনতেই পারলেন না। বললেন, ‘কার কথা বলছেন?’ সাংবাদিক এবার সার ও জেমি কামিং দুজনের নাম উল্লেখ করে আবারও একই প্রশ্ন করলেন। পচেত্তিনো তবু নির্বাক। বুঝতেই পারছেন না কাদের কথা বলা হচ্ছে। চোখেমুখে প্রশ্ন, ‘কারা ওরা’। পাশ থেকে একজন নাম বলে দিলেন। কামিং যে একজন গোলকিপার, সেটাও বলে দিলেন ওই সাংবাদিক। পচেত্তিনো এর পরও হাতড়ে বেড়ালেন কিছুক্ষণ। বেশ কয়েক সেকেন্ড ইতিউতি করার পর ‘ও আচ্ছা, বুঝেছি’ ধরনের প্রতিক্রিয়া দিয়ে কথা বাড়ালেন।
নাম বুঝতে সমস্যা নয়, মানুষ চিনতেই যে সমস্যা হচ্ছিল, সেটা ওই সংবাদ সম্মেলনের ভিডিও দেখা যে কারোরই মনে হবে। এ নিয়ে তখন বেশ হাস্যরস তৈরি হয়েছিল ফুটবল–সমর্থকদের মধ্যে। আর্জেন্টাইন এই কোচ চেলসির দায়িত্ব নিয়েছিলেন এ ঘটনার মাস দেড়েক আগে। মালিকপক্ষ তখন দলবদল-বাজার থেকে সমানে কেনাকাটা চালিয়ে যাচ্ছে। চলছে ধারে দেওয়া-নেওয়াও। হরদম কেউ আসছে, কেউ যাচ্ছে। লুটনের সঙ্গে ম্যাচের দিনও চেলসির স্কোয়াডের আকার ছিল ৩২ জনের। এর মধ্যেই খেলোয়াড়দের নামধাম গুলিয়ে ফেলেছিলেন পচেত্তিনো।
ঠিক এক বছর পর আগস্টের এই সময়ে চেলসির স্কোয়াড ৪২ জনের। গত বছরের চেয়ে ১০ জন বেশি। শুধু তা-ই নয়, দলের প্রধান কোচ এনজো মারেসকাও নতুন। এই প্রথম কোনো শীর্ষ সারির দলের দায়িত্ব নেওয়া মারেসকাও যে যেকোনো মুহূর্তে পচেত্তিনোর পরিস্থিতিতে পড়তে পারেন, সে সম্ভাবনা আছে যথেষ্টই।
দলবদলের বাজার খোলা থাকার সময়ে চেলসির এই অস্থিরতা চলছে দুই বছর ধরে। টড বোয়েলির নেতৃত্বাধীন বর্তমান মালিকেরা চেলসি কেনার পর গ্রীষ্ম ও শীতকালীন মিলিয়ে এ নিয়ে পঞ্চম ট্রান্সফার উইন্ডো চলছে। এর মধ্যেই ৩৯ জন খেলোয়াড় কিনেছে চেলসি। খরচ করেছে প্রায় ১.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। প্রিমিয়ার লিগের আর কোনো ক্লাবই এ সময়ে এত বেশি খেলোয়াড় কেনেনি, খরচও করেনি।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই বিশাল বহর নিয়ে কী করবে চেলসি? যেখানে স্কোয়াডে ২৩ জন খেলোয়াড় থাকলেই চলে, ঘন সূচি ও সম্ভাব্য চোটের বিষয় মাথায় রেখেও যেখানে ‘বিগ সিক্স’–এর অন্য কোনো ক্লাব ৩০ জনের বেশি দল গড়েনি, সেখানে চল্লিশের বেশি খেলোয়াড় কীভাবে কাজে লাগাবে অল ব্লুজরা? প্রতি ম্যাচে মাঠে নামানোর জন্য ১১ জনের সঙ্গে আরও ৪ জন বাছাই করা হবে কোন পদ্ধতিতে?
জবাবটা ভালো দিতে পারবে ক্লাবের মালিকপক্ষ। জানা থাকার কথা কোচ মারেসকারও। তবে লেস্টার সিটি থেকে আসা ইতালিয়ান এই কোচ এরই মধ্যে যে ধারণা দিয়েছেন, তাতে অবশ্য ‘বাছাই’য়ের চেয়ে ‘ছাঁটাই’ পদ্ধতির আভাসই পাওয়া যাচ্ছে। লিগে মৌসুমের প্রথম ম্যাচের পর চেলসি কোচ বলেছেন, ‘আমি ২১-২২ জন নিয়ে কাজ করছি। বাকিরা আলাদা আছে। ওরা দলের সঙ্গে নেই।’
মারেসকা যাঁদের আলাদা রাখা হয়েছে বলেছেন, সংবাদমাধ্যমের ভাষায় সেটি ‘বোম্ব স্কোয়াড’। তবে অভ্যন্তরীণভাবে বিবেচিত হচ্ছে ‘লোন স্কোয়াড’ হিসেবে। তাঁদের কাউকে ধারে পাঠানো হবে, কাউকে বিক্রি করা হবে, কাউকে আরও কিছুদিন পর্যবেক্ষণ করা হবে।
এ দলটির তত্ত্বাবধানে আছেন টেকনিক্যাল কোচ কার্লো কুদিসিনি, সঙ্গে সহকারী হিসেবে এড ব্রান্ড। দলের সব সুযোগ-সুবিধা অন্যদের মতো সমান হলেও অনুশীলনে তারা ভিন্ন দল। এর মধ্যে আছেন রাহিম স্টার্লিং, দুই বছর আগে যাঁকে ম্যানচেস্টার সিটি থেকে কেনা হয়েছিল প্রায় ছয় কোটি ডলারে। এরই মধ্যে মিডফিল্ডার কনর গ্যালাঘারকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে আতলেতিকো মাদ্রিদে।
ক্লাবের একাডেমি থেকে উঠে আসা আরমান্ডো ব্রোহাকে ধারে পাঠানো হচ্ছে ইপসউইচে। এ ছাড়া ডিফেন্ডার বেন চিলওয়েল, অ্যাক্সেল দিসাসি ও ট্রেভহ চালোবাহ এবং মিডফিল্ডার কারনি চুকওয়েমেকারা আপাতত কোচের পছন্দের তালিকায় নেই। বোম্ব স্কোয়াড বা লোন স্কোয়াডে রাখা খেলোয়াড়দের মধ্যে আরও আছেন কেপা আরিজাবালাগা, রোমেলু লুকাকু, লুকা বার্গস্ট্রম, তিনো আনজোরিন, অ্যালেক্স মাতোস, হার্ভি ভ্যালে, অ্যাঞ্জেলো গ্যাব্রিয়েল, ডেইভিড ওয়াশিংটন ও ডেভিড ফোফানারা।
এমনকি লিগে সিটির বিপক্ষে গোল করা ননি মাদুয়েকেরও নিউক্যাসলে চলে যাওয়ার আলোচনা আছে। মারেসকাই বলেছেন, ‘বাস্তবতা হচ্ছে, যতক্ষণ দলবদল বাজার খোলা, ততক্ষণ যেকোনো কিছুই ঘটতে পারে।’
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি বলছে, চেলসির লক্ষ্য এমন একটি দল গঠন করা, যেখানে আর কাউকে অপ্রয়োজনীয় মনে হবে না। দীর্ঘ মেয়াদে খেলানো যাবে। এর বাইরে যাঁরা থাকবেন তাঁদের বিক্রি করা হবে বা বাজারের জন্য উন্মুক্ত রাখা হবে। ছয়জন বিদেশি ফুটবলারকে ধারে পাঠানো যায়। চেলসির লক্ষ্য তিনজনকে ফ্রান্সের স্ত্রাসবুর্গ আর তিনজনকে ইংল্যান্ডের ক্লাবগুলোয় পাঠানো। স্ত্রাসবুর্গের মালিকানায় আছেন চেলসির মালিকেরাই।
এ ক্ষেত্রে বড় লক্ষ্য বেতন বাবদ খরচ কমানো এবং তারকা হয়ে ওঠার আগেই তরুণদের দলে ভেড়ানো। কিছু খেলোয়াড়কে আবার দীর্ঘ মেয়াদের চুক্তি দেওয়া হচ্ছে। যেমন আতলেতিকো থেকে জোয়াও ফেলিক্সকে নেওয়া হয়েছে সাত বছরের চুক্তিতে, কোল পালমারের সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ বাড়িয়ে করা হয়েছে নয় বছর। এসব বড় চুক্তির লক্ষ্য ট্রান্সফার ফি একাধিক বছরের মধ্যে ভাগ করে বাৎসরিক ব্যয়ের পরিমাণ কমিয়ে আনা।
এরই মধ্যে আগের মালিকানার তুলনায় ৫০ শতাংশ ওয়েজ বিল কমেছে বলেও দাবি করেছে চেলসি। চেলসি মনে করছে, কম বেতনের কেনা খেলোয়াড় যদি পরে প্রত্যাশিত মাত্রার তারকা না হয়ে ওঠেন, তাহলে বিক্রি করে ছেড়ে দেওয়া যাবে। লাভ যদি বেশি না–ও হয়, ক্ষতির আশঙ্কা কম।
ট্রান্সফার মার্কেটে থাকা চেলসি খেলোয়াড়দের তথ্য বিশ্লেষণ করে স্কাই স্পোর্টস বলছে, চেলসি খেলোয়াড়দের মোট চুক্তির মেয়াদ ১৯১ বছর। দেখতে অদ্ভুত লাগলেও এর ইতিবাচক দিক হচ্ছে, এতে ফ্রি এজেন্ট খেলোয়াড় হারানোর শঙ্কা কম। কাউকে ধরে রাখতে চুক্তির মেয়াদ বাড়ানোর জন্য তাড়াহুড়াও করতে হবে না। বিশেষ করে ২০২২ সালে আন্দ্রেস ক্রিস্টেনসেন বার্সেলোনায় এবং আন্তনিও রুডিগার রিয়াল মাদ্রিদে ফ্রি এজেন্ট হিসেবে যেভাবে চলে গেছেন, তেমন ঘটনা আটকানো যাবে।
কিন্তু এসব কুশলী পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে চূড়ান্ত সাফল্য কি পাওয়া যাবে? দিন শেষে লিগ জিতলেন কি না, উয়েফার প্রতিযোগিতায় কতটা এগোলেন, এগুলোই বিবেচনায় নেওয়া হয়। ক্লাবের জনপ্রিয়তা, বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠানের আগ্রহ কিংবা ভবিষ্যৎ খেলোয়াড়দের লক্ষ্য হওয়ার জন্য সাফল্যই পূর্বশর্ত। কিন্তু চেলসি সেটা পারবে কি?
এখন পর্যন্ত লক্ষণ কিন্তু সুবিধার নয়। গত দুই বছরে লিগ তো জেতা যায়ইনি, এমনকি চ্যাম্পিয়নস লিগেও জায়গা করা যায়নি। একবার লিগ শেষ করতে হয়েছে ১২তম হয়ে, আরেকবার ষষ্ঠ। আবার সর্বশেষ দুই বছরের হিসাব বলছে, ক্লাব এ সময়ে ৯ কোটি এবং ১২.১ কোটি পাউন্ড লসও করেছে।
এই ২০২৪-২৫ বা পরের বছরের মধ্যে যদি বড় কোনো ট্রফি না আসে, তবে ৪২ জনের বিশাল বহর স্রেফ সাদা হাতি হিসেবেই বিবেচিত হবে।