রামকৃষ্ণ মিশন আর হাটখোলা রোড যে জায়গায় মিলেছে, সেখান থেকে হাতের বাঁ দিকে চলে যাওয়া রাস্তার ঠিক পাশেই ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাব। ফটকের ওপরে সাইনবোর্ড। মলিন, রং ওঠা এই সাইনবোর্ডটাই যেন বলে দিচ্ছে অনেক কিছু।
দেশের খেলাধুলায় একসময়ের অন্যতম শক্তি ব্রাদার্সের বর্তমানটা ওই সাইনবোর্ডের মতোই মলিন, অনুজ্জ্বল। যে ক্লাব একসময় ছিল দেশের ফুটবলের অন্যতম শক্তি, তারাই এখন লড়ছে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে। কিন্তু সেই অস্তিত্বের লড়াইয়েও যেন হারই নিয়তি। এবার আবারও প্রিমিয়ার লিগ থেকে চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে নেমে গেছে দলটা। সেই দায় নিয়ে কাল ক্লাবটির ডিরেক্টর ইন চার্জের পদ থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন মহিউদ্দিন আহমেদ মহি, যিনি কিনা আবার বাফুফেরও সহসভাপতি। প্রথম আলোকে তিনি বলেছেন, ‘দল ব্যর্থ হয়েছে। আমি ব্যর্থতার দায়ভার কাঁধে নিয়ে পদ ছেড়ে দিচ্ছি। তবে আমি ক্লাবের পরিচালক পদে থাকব।’
এর আগে ২০২০–২১ মৌসুমেও প্রিমিয়ার লিগ থেকে অবনমন হয়েছিল ব্রাদার্সের। এবারের প্রিমিয়ার ফুটবল লিগে তাদের আর একটি ম্যাচই বাকি। ১৭ ম্যাচে ব্রাদার্সের পয়েন্ট মাত্র ৭, জয় একটি। পুরো লিগে মোট ৬৪টি গোল হজম করেছে তারা। নিজেরা দিয়েছে ২১টি গোল।
পেশাদার লিগ শুরুর আগে ব্রাদার্স ঢাকা লিগে শিরোপা জিতেছে দুবার। একবার শিরোপা জিতেছে জাতীয় লিগে। একসময় আবাহনী, মোহামেডানের পর তৃতীয় সেরা দল বলা হতো ব্রাদার্সকেই। লিগ ছাড়াও তিনবার ফেডারেশন কাপ জিতেছে গোপীবাগের ঐতিহ্যবাহী ক্লাবটি। জিতেছে আগাখান গোল্ডকাপ। মহাদেশীয় ক্লাব প্রতিযোগিতায় দেশকে তিনবার প্রতিনিধিত্বও করেছে ব্রাদার্স। এমন একটি ক্লাবের কিনা এখন রীতিমতো হারিয়ে যাওয়ার দশা!
১৯৪৯ সালে পুরান ঢাকার গোপীবাগ এলাকার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠা ব্রাদার্স বড় একটা সময় ব্যক্তিকেন্দ্রিক পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত হয়েছে। এলাকাবাসীর চাঁদা ও ধনাঢ্য ব্যক্তিদের অনুদানে পরিচালিত ক্লাবটি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পেশাদার হয়ে উঠতে পারেনি বলেই আজ এই দশা।
২০০৭ সালের পর থেকেই আস্তে আস্তে ব্রাদার্সের পতনের শুরু। সেটি আরও বেগবান হয় ২০১৭ সালের পর। সেবার লিগে সপ্তম ব্রাদার্স ২০১৮-১৯ মৌসুমে হয় ১১তম। এরপর ২০২০-২১ মৌসুমে তো অবনমিতই হয়ে যায়। আর্থিক সংকটের কারণে পেশাদার ফুটবলের দ্বিতীয় স্তরে (বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়নশিপ লিগ) ক্লাবটি এক মৌসুম খেলেইনি।
ব্রাদার্স ফুটবল দলের ম্যানেজার আমের খান সামনে এনেছেন আর্থিক সংকটের কথা, ‘কয়েকজন অনুদান দিলেন, একটা ফুটবল দল বানালাম, এভাবে আর চলে না। ফুটবলে করপোরেট অর্থ এসেছে। এখন এক–দুই কোটি টাকায় দল হয় না। আমাদের পৃষ্ঠপোষকের অভাব। মূলত আর্থিক সমস্যার কারণেই ব্রাদার্সের এই অবস্থা।’
সাবেক ফুটবলার সাজ্জাদ হোসেন সিদ্দিকী লাভলু মনে করেন, ব্রাদার্সের এই অবস্থার বড় কারণ রাজনীতি, ‘রাজনৈতিক রশি টানাটানি বড় ক্ষতি করেছে। ক্লাবকে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের ছাপ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক দলাদলি অনেক পৃষ্ঠপোষককে দূরে ঠেলে দিয়েছে।’
জাতীয় দলের সাবেক ফুটবলার ফয়সাল মাহমুদ চলতি মৌসুমের শুরুতে ব্রাদার্সের কোচের দায়িত্বে ছিলেন। ক্লাবের অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করে পরে তিনি দায়িত্ব থেকে সরে যান। তিনি বলেন, ‘ক্লাবটির কিছুই ঠিক নেই। একটা দিনও ভালোমতো অনুশীলন করাতে পারিনি। একটা প্রিমিয়ার লিগের দল, অথচ হাজারটা সমস্যা। ব্যবস্থাপনার সমস্যাই ব্রাদার্সের এই অবস্থার কারণ।’
ক্লাবের বর্তমান অবস্থার জন্য নেতৃত্বের সংকটকে দায়ী করেছেন সাবেক তারকা হাসানুজ্জামান বাবলু, ‘সাইফউদ্দিন মানিক, সাদেক হোসেন খোকাদের পর আর নেতৃত্ব তৈরি হয়নি। ভালো নেতৃত্ব না থাকার কারণেই আর্থিক সংকটে পড়েছে এই ক্লাব।’
ব্রাদার্সের আরেক সাবেক তারকা ওয়াসিম ইকবালের মতে, পেশাদারত্ব না আসাটাই সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে ক্লাবটির জন্য, ‘অনুদান দিয়ে এখন ফুটবল চলে না, এটা ব্রাদার্সের কর্তাদের বুঝতে হবে। ব্রাদার্সের সব আছে, কিন্তু পেশাদারত্বই নেই। এটা না থাকলে কিছুই হবে না।’