রিকশাচালক মোহাম্মদ মোস্তফা
রিকশাচালক মোহাম্মদ মোস্তফা

মোস্তফার রিকশায় স্মৃতির ফুটবল

সেগুনবাগিচার এজি অফিসের সামনে থেকে মতিঝিলের ক্লাব পাড়ায় যাব। রিকশার খোঁজ করছি। হঠাৎ একজন বয়স্ক রিকশাচালককে দেখে এগিয়ে গিয়ে বললাম, ‘চাচা যাবেন? মতিঝিল।’ তিনি পাল্টা প্রশ্ন করলেন ‘মতিঝিল কই যাইবেন?’

রিকশাচালকদের এই পাল্টা প্রশ্নটা খুবই ঝামেলার। যেখানে যেতে চাই, সেটি নির্দিষ্ট করে বললে হয় তিনি চিনতে পারবেন না, নয়তো বেশির ভাগ যাত্রীই ঠিকমতো তাঁদের বোঝাতে পারেন না, তাঁরা কোথায় যাবেন। কিছুটা দ্বিধান্বিত হয়েই বললাম, ‘ফুটবল ফেডারেশন অফিস চেনেন? ওই যে ক্লাবগুলো যেখানে। মোহামেডান, ভিক্টোরিয়া, ওয়ান্ডারার্স…!’

আমাকে অবাক করে দিয়েই তিনি বললেন, ‘ওহ! মোহামেডান ক্লাব? চলেন।’ বুঝতে পারলাম, তিনি জায়গাটা খুব ভালো করেই চেনেন। বললেন, ‘আমি ৪০ বছর ধইরা মোহামেডান ক্লাবে যাই! জায়গাটা চিনব না!’ আমার সন্দেহ কেন, সেটিতেই যেন তাঁর বিস্ময়!

রিকশায় চেপে বসতেই শুরু হলো তাঁর গল্প। সবই ফুটবল নস্টালজিয়ার। বুঝতে পারলাম ক্লাব পাড়ার ‘খেপ’ তাঁর স্মৃতিকে ভালোভাবেই উসকে দিয়েছে। ভরদুপুরের গনগনে রোদের মধ্যেই রিকশা টানতে টানতে তাঁর স্মৃতিচারণা, ‘আপনে কি ফুটবল খেলেন?’ এবার তাঁকেই পাল্টা প্রশ্ন করলাম, ‘চাচা, আমাকে দেখে কি ফুটবলারের মতো মনে হয়?’

আশির দশকে এক আবাহনী–মোহামেডান ম্যাচের মুহূর্ত

নিজের অখেলোয়াড়সুলভ স্বাস্থ্যের দিকে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম। একটু হেসেই গল্পের ঝাঁপি উপুড় করে দিলেন তিনি, ‘কী দিন ছিল ভাই! নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ আমার বাড়ি। সেইখান থেকে এইটা ওইটা বেইচা ঢাকা স্টেডিয়ামে আসতাম খেলা দেখতে। মোহামেডান ছাড়া কিছু বুঝতাম না। কায়সার হামিদ এখন কই? একটা বিদেশি আছিল না? বিরাট লাম্বা! মনে পড়ছে, এমেকা… কায়সার হামিদের বন্ধু আছিল। সাব্বির. . কী প্লেয়ার! ওরে কেউ ধইরা রাখতে পারত না।’

এক ফাঁকে জেনে নিলাম রিকশাচালক ভদ্রলোকের নাম মোহাম্মদ মোস্তফা। আগেই বলেছেন বাড়ি নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ। জানা গেল, পেশা শুধু রিকশা চালানোই নয়। অনেক কিছুই করেন। মূলত রিকশাটা দিয়ে ডেলিভারির কাজ করেন বিভিন্ন জিনিস, ‘আমি রিকশায় প্যাসেঞ্জার কম নিই। বেশির ভাগ সময় জিনিসপত্র ডেলিভারি করি। ওই যে মোবাইল দিয়া অনলাইনে মানুষ বিভিন্ন জিনিস কেনে না? আপনারে নামায়া দিয়া যাব কাপ্তানবাজারে। ওইখান থেকে কিছু জিনিস নিয়া ডেলিভারি দিতে আবার আসব কাকরাইল।’

ফুটবল-স্মৃতিতে ফিরলেন তিনি। মোহাম্মদ মোস্তফা যে মোহামেডানের সমর্থক, সেটা জানা হয়ে গিয়েছিল। তবে আবাহনীর দুজন খেলোয়াড়ের প্রতি তাঁর অনুরাগের শেষ নেই। তাঁরা হলেন আশরাফউদ্দিন চুন্নু ও মোনেম মুন্না। রহস্যটা পরিষ্কার। দুজনই নারায়ণগঞ্জের খেলোয়াড়, ‘চুন্নুর খেলা আমার খুব ভালো লাগত। হেভি গতি ছিল। বল এই পায়ে, ওই পায়ে নিয়া দৌড়াইত। মোহামেডানের সঙ্গে আবাহনীর খেলা পড়লে চুন্নুরেই খুব ডরাইতাম। চুন্নু যেই দিন ব্যথা পাইল, খুব মন খারাপ হইসিল। মুন্না কোনো দিন মোহামেডানে খেলল না, এইটা আমার দুঃখ। মুন্নাও অল্প বয়সে মইরা গেল। ব্যাকে মুন্নার মতো কাউকে আমি দেখি নাই।’

আবাহনীর জার্সি গায়ে মোনেম মুন্না, ১৯৯২

তাঁর দৃষ্টিতে ডিফেন্সে কে এগিয়ে কায়সার হামিদ না মোনেম মুন্না-সাংবাদিকসুলভ একটা প্রশ্ন করেই ফেললাম। মোস্তফার নির্বিকার উত্তর, ‘মোহামেডান করি দেইখা জোর কইরা কায়সারের নাম কমু না। মুন্না অনেক ভালো।’

আবাহনী-মোহামেডানের স্মৃতি তাঁর কাছে প্রচণ্ড উত্তেজনার। ঢাকা স্টেডিয়ামে (বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম) হাজার হাজার দর্শকের সেই চিৎকার, পুলিশের লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাসের ঝাঁজ-তাঁর স্মৃতিজুড়ে আছে এসবই, ‘আমি আবাহনী-মোহামেডানের খেলা দেখতে গিয়া যে কত মাইর খাইছি পুলিশের, কত যে ব্যথা পাইছি। একবার ঘাড়ের উপর পুলিশের লাঠির বাড়ি পড়ছিল, দুই মাস ব্যথা আছিল।’

ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলার সময় মনে হচ্ছিল নিজের পরিচয় দেব না। কিন্তু সংগত কারণেই দিতে হলো। অনেক সময় এসব স্মৃতিচারণার ক্ষেত্রে দেখা যায় সাংবাদিক পরিচয় পেলে এমন মানুষদের আড্ডার স্বতঃস্ফূর্ততা হারিয়ে যায়।

মোস্তফার ক্ষেত্রেও একই জিনিস হলো। কিছুটা শক্ত হয়ে গেলেন তিনি। নিজেকে অভিশাপ দিতে থাকলাম, কেন তাঁর কাছে নিজের পেশার পরিচয়টা দিলাম। যে গল্পগুলো তিনি করছিলেন, সেখানে সাল, তারিখের ব্যাপার নেই, কিন্তু আছে একধরনের আবেগ। যে আবেগ বুকে নিয়ে এখনো বেঁচে আছেন অনেক সাধারণ ফুটবলপ্রেমী।

এখন আর ফুটবল দেখতে যান না মোস্তফা। কারণ হিসেবে বললেন, ‘মজা পাই না ভাই। সেই উত্তেজনা তো নাই। কোন ফাঁকে খেলা হইয়া যায়, জানিও না। আগে আমাগো পাড়ার পোলাপান আবাহনী-মোহামেডানের বিরাট বিরাট পতাকা তুলত, সেইটা দেইখা বুঝতাম কবে খেলা। এখন মোহামেডান, আবাহনীতে কারা খেলে, সেইটাই তো জানি না।’

কায়সার হামিদ, কানন (ছাইদ হাসান কানন), সাব্বির (রুম্মান বিন ওয়ালি), ইলিয়াস (ইলিয়াস হোসেন) আশি-নব্বইয়ের দশকের তারকা ফুটবলাররা এখন কে, কোথায়, কেমন আছেন জানতে চাইলেন। ‘ভালো আছেন’ শুনে বললেন, ‘তাদের নিশ্চয়ই অনেক বয়স হইসে!’ বয়স হওয়াটাই যে স্বাভাবিক ব্যাপার, সেটা তাঁকে বলতেই একটু যেন মনমরা হয়ে গেলেন, ‘হ! ভাই বয়স এমন একটা জিনিস ধইরা রাখা যায় না।’

কায়সার, সাব্বিররা ফুটবল থেকে অবসরে গেলেও ‘এই বয়সেও’ মোহাম্মদ মোস্তফা কিন্তু পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। ঢাকার যানজট, ভিড় ঠেলে রিকশা নিয়ে ছুটে চলেন এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়। বুকে তাঁর ফুটবলের অতীত দিনের স্মৃতি। যে স্মৃতি তাঁকে এখনো উদ্বেলিত করে। ফিরিয়ে নিয়ে যায় উত্তেজনায় ঠাসা সেই দিনগুলোতে।