বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন
বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন

আর ভিক্ষা চাইবেন না সালাউদ্দিন

গত ১৯ সেপ্টেম্বর কাঠমান্ডুতে নেপালকে হারিয়ে প্রথমবার সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপ জেতে বাংলাদেশ। দেশে ফেরা ফুটবলারদের বিমানবন্দর থেকে বাফুফে ভবন পর্যন্ত ছাদ খোলা বাসে দেওয়া সংবর্ধনা বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনেই বিরল ঘটনা।

কিন্তু স্বপ্নের মতো সেই সময়টা শেষ হতে সময় লাগল না। সাবিনাদের জন্য গত মাসে সিঙ্গাপুরে প্রীতি ম্যাচ খেলার ব্যবস্থা করেছিল বাফুফে। শেষ মুহূর্তে সিঙ্গাপুর অপারগতা প্রকাশ করায় সফরটি আর হয়নি। আগামী ৫-১১ এপ্রিল ২০২৪ প্যারিস অলিম্পিকের নারী ফুটবলের এশিয়ান অঞ্চলের বাছাই খেলতে মেয়েদের মিয়ানমারেও পাঠাচ্ছে না বাফুফে। বাফুফের সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈম গত পরশু বলেছেন, ‘দল পাঠাতে বাফুফের প্রয়োজনীয় অর্থের সংকুলান না থাকায় গত সপ্তাহে আমরা যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের কাছে আর্থিক সহায়তা চেয়েছিলাম। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া পাচ্ছিলাম না। অর্থের সংকুলান করতে না পারায় টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ অংশ নিচ্ছে না।’

এত দিন সবার কাছে ভিক্ষা চেয়েছি। এখন ভিক্ষার দরজাও বন্ধ হয়ে গেছে। মেয়েরা সাফ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী অর্থ পুরস্কার দিয়েছেন, সেনাবাহিনী দিয়েছ। আমাদের একটা স্পনসর আছে, ঢাকা ব্যাংক। ওরা বছরে ১ কোটি ৮০ লাখ টাকার মতো দেয়। বসুন্ধরা এখন পর্যন্ত দিয়েছে ২৫ লাখ টাকা। আমাদের ক্যাম্পে খাওয়ার খরচ বছরে সাড়ে তিন কোটি টাকার মতো। মেয়েরা সাফ জেতার পর বাফুফে টাকা পেয়েছে শুধু প্রথম আলোর কাছ থেকে
কাজী সালাউদ্দিন, বাফুফে সভাপতি

মিয়ানমার সফরটা তুলনামূলক কঠিনই হতো বাংলাদেশের মেয়েদের জন্য। অলিম্পিক বাছাইয়ের সাবিনা খাতুনদের প্রতিপক্ষ হতো ইরান, মালদ্বীপ ও স্বাগতিক মিয়ানমার। দল না পাঠানোর সিদ্ধান্তে শক্ত প্রতিপক্ষের বিপক্ষে খেলার সুযোগ তো হাতছাড়া হচ্ছেই, নিবন্ধন করেও সরে যাওয়ায় জরিমানাও গুনতে হতে পারে বাংলাদেশকে।

ক্যাম্প চলছে না মেয়েদের? বিভিন্ন কাজ চলছে না? সেসব খাতে খরচ আছে। জাতীয় দলসহ আমাদের বয়সভিত্তিক বিভিন্ন দল আছে। এখন ৭০ জন মেয়ে আছে বাফুফে ভবনের ক্যাম্পে।
মাহফুজা আক্তার, বাফুফের নারী ফুটবলের প্রধান

সাফ জয়ের মাত্র ছয় মাসের মধ্যে ‘টাকার অভাবে’ নারী দলকে এ রকম গুরুত্বপূর্ণ একটা টুর্নামেন্টে না পাঠানোর সিদ্ধান্ত একই সঙ্গে বিস্ময়কর এবং হতাশার। প্রয়োজনীয় অর্থের ব্যবস্থা করে দল বিদেশে পাঠানোর দায়িত্ব বাফুফের। সেই দায়িত্ব পালনে তারা ব্যর্থ তো বটেই, উল্টো দায় দিচ্ছে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের ওপর।

ছাদখোলা বাসে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের ট্রফি উঁচিয়ে বাংলাদেশ অধিনায়ক সাবিনা খাতুন

টুর্নামেন্টে দল পাঠাতে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের কাছে কেন আর্থিক সহায়তা চাইতে হবে বাফুফেকে? মেয়েদের ফুটবলে তো স্পনসর আছেই! গত ২৬ জানুয়ারি ২০২৩ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত ৩ বছরের জন্য বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলকে পৃষ্ঠপোষকতা করার ঘোষণা দেয় বসুন্ধরা গ্রুপ। তবে বাফুফের নারী ফুটবলের প্রধান মাহফুজা আক্তারের ব্যাখ্যা, চুক্তি অনুযায়ী নাকি পৃষ্ঠপোষকদের আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার খরচ দেওয়ার কথা নয়, ‘চুক্তিটা হলো বাফুফে ভবনে মেয়েদের থাকা-খাওয়ার খরচে তারা কিছু অবদান রাখবে। আর মেয়েদের লিগটা স্পনসর করবে। আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার জন্য তারা টাকা দেবে না।’

বাফুফে বিওএকে কোনো চিঠি দেয়নি। মন্ত্রণালয়কে যে চিঠি দিয়েছে সেটার কপি দিয়েছে শুধু আমাদের। বিওএর কাছে কোনো আর্থিক সহায়তার আবেদন তারা করেনি। করলেও এত টাকা আমরা কোথা থেকে দিতাম?
সৈয়দ শাহেদ রেজা, বিওএর মহাসচিব

অর্থের অভাবে অলিম্পিক বাছাইয়ে দল পাঠাতে না পারাটা মেনে নিতে পারছেন না বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনও। তবে তাঁর এককথা, ‘এত দিন সবার কাছে ভিক্ষা চেয়েছি। এখন ভিক্ষার দরজাও বন্ধ হয়ে গেছে।’

বাফুফে সভাপতি বলেন, ‘মেয়েরা সাফ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী অর্থ পুরস্কার দিয়েছেন, সেনাবাহিনী দিয়েছে। আমাদের একটা স্পনসর আছে, ঢাকা ব্যাংক। ওরা বছরে ১ কোটি ৮০ লাখ টাকার মতো দেয়। বসুন্ধরা এখন পর্যন্ত দিয়েছে ২৫ লাখ টাকা। আমাদের ক্যাম্পে খাওয়ার খরচ বছরে সাড়ে তিন কোটি টাকার মতো। মেয়েরা সাফ জেতার পর বাফুফে টাকা পেয়েছে শুধু প্রথম আলোর কাছ থেকে’—বলেছেন সালাউদ্দিন।

নেপাল থেকে ফেরার পর ছাদখোলা বাসে সাফজয়ী বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল

যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি বাফুফে এই সফরের জন্য অর্থসহায়তা চেয়েছিল বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের (বিওএ) কাছেও। সেখান থেকেও ‘না’-ই শুনতে হয়েছে। সালাউদ্দিন বলেছেন, ‘বিওএ বলেছে, টাকা না থাকলে দল যাবে না। মন্ত্রণালয় বলেছে, দিতে পারবে না। টাকা পেলে যাবে, না হয় যাবে না। আমি কোথা থেকে টাকা আনব?’

বিওএর মহাসচিব সৈয়দ শাহেদ রেজার সঙ্গে এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে তিনি অবশ্য প্রথম আলোকে বলেছেন,‘বাফুফে বিওএকে কোনো চিঠি দেয়নি। মন্ত্রণালয়কে যে চিঠি দিয়েছে সেটার কপি দিয়েছে শুধু আমাদের। বিওএর কাছে কোনো আর্থিক সহায়তার আবেদন তারা করেনি। করলেও এত টাকা আমরা কোথা থেকে দিতাম?’

এ ব্যাপারে কথা বলতে যোগাযোগ করা হলে যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেলের মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া গেছে। তবে গত পরশু একটি সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেছেন, বাফুফের চিঠি তিনি পেয়েছেন গত শুক্রবার। মাত্র চার-পাঁচ দিনের মধ্য সরকারি টাকা পাওয়া সম্ভব নয়। এতে বাফুফের পেশাদারত্বের অভাবই ফুটে উঠেছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ফটোসেশনে অংশ নেন সাফজয়ী বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দলের সদস্যরা

সাফ জিতে আসার পর পুরস্কার ও মেয়েদের ফুটবলের উন্নতির জন্য বাফুফেকে দেড় কোটি টাকা সংগ্রহ করে দিয়েছিল প্রথম আলো। সেই টাকা দিয়ে দল পাঠানোর ব্যবস্থা করা যেত কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে পাল্টা প্রশ্নই করলেন মাহফুজা, ‘ক্যাম্প চলছে না মেয়েদের? বিভিন্ন কাজ চলছে না? সেসব খাতে খরচ আছে। জাতীয় দলসহ আমাদের বয়সভিত্তিক বিভিন্ন দল আছে। এখন ৭০ জন মেয়ে আছে বাফুফে ভবনের ক্যাম্পে।’

নারী ফুটবল প্রধানের কথা অনুযায়ী তাঁদের হাতে যে টাকা আছে, সেটা শুধু মেয়েদের থাকা-খাওয়ার জন্যই, ‘মেয়েদের ফান্ডের খাওয়ার টাকায় যদি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলি, তাহলে মেয়েরা না খেয়ে থাকবে। ক্যাম্প চালাতে পারব না। এক তহবিলের টাকা আরেক তহবিলে দেওয়া যায় না।’

খেলতে যাওয়া-আসা, হোটেল খরচ, ভিসা ফি, স্থানীয় যাতায়াতসহ মিয়ানমারের সব খরচই বহন করতে হবে অংশগ্রহণকারী দলকে। বাফুফে দল পাঠালে সব মিলিয়ে ৬০-৭০ লাখ টাকার মতো প্রয়োজন ছিল বলে জানিয়েছেন মাহফুজা। ‘এত দিন যত সমস্যাই হোক আমরা সমাধান করেছি। এবারই প্রথম অর্থের কারণে সফর বাতিল করেছি। কারণ, এটা অনেক বড় অঙ্কের টাকা’—বলেছেন তিনি।