লিভারপুল ছাড়ছেন ফিরমিনো
লিভারপুল ছাড়ছেন ফিরমিনো

অ্যানফিল্ডে শেষ বাঁশি বাজলেই ‘লাল’ ফিরমিনো ‘নীল’

‘নো লুক’ পাসের মাস্টার তিনি। পাস দেওয়ার সময় কোথায় দিচ্ছেন, কাকে দিচ্ছেন, খেয়াল করার বালাই নেই। কিন্তু তিনি ঠিকই জানেন পাসটি কে পেতে যাচ্ছেন, বলটা তাঁর পায়ের বেঁধে দেওয়া গতিপথ মেনে পৌঁছে যায় ঈপ্সিত লক্ষ্যে। লিভারপুলের হয়ে অ্যানফিল্ডে রবার্তো ফিরমিনো আজ শেষ ম্যাচটি খেলবেন।

ফিরমিনো কি পাস দেওয়ার সময় আজও তাকাবেন না? সম্ভবত না। আজ যে তাঁর পাসের লক্ষ্যের দিকে আরও বেশি না তাকানোর দিন। অ্যানফিল্ডকে শেষবারের মতো দেখে নিতে হবে না! চোখে স্মৃতির মায়াঞ্জন মেখে ব্রাজিলিয়ান ফরোয়ার্ড আজ ফিরে তাকাবেন গত আট বছরে অ্যানফিল্ডে কাটানো প্রতিটি দিনে। মনেও কি ঝড় উঠবে—শেষ হয়ে হইল না শেষ!

পেশাদার ফুটবলে আবেগের জায়গা সামান্যই। তবু কি পারা যায়? মনের মধ্যে দলা পাকিয়ে ওঠা অযুত স্মৃতির ঢেউ সবাই সামলাতে পারে না। সেই যে ২০১৫ সালে হফেনহেইম থেকে অ্যানফিল্ডে এলেন। তখনো ফিরমিনো ‘ববি’ হয়ে ওঠেননি।

নিন্দুকেরা বলেছিলেন, লিভারপুলের গতিপথের মতো এই দলবদলও মাঠে মারা যাবে, টাকাটা স্রেফ জলে ঢেলেছে। কিন্তু আট বছর, হ্যাঁ মাত্র আট মৌসুমের ব্যবধানে সেই ‘জল’ আজ কারও কারও চোখে অন্যরূপ আর মহিমা নিয়ে ধরা দেবে। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে লিভারপুলের কোনো সমর্থক হয়তো চিৎকার করবেন, প্রিয় ববি! যেয়ো না, প্লিজ! ফিরমিনো কি তা শুনে একটু হাসবেন, যে হাসি আসলে বিচ্ছেদের মোড়কে জমা সন্তুষ্টির বিন্দু! ওই যে কথায় আছে না, তখনই বিদায় নিতে হয়, যখন সবাই ধরে রাখতে চায়!

২০১৫ সালে লিভারপুলে যোগ দিয়েছিলেন ফিরমিনো

ফিরমিনো সে পথেরই মানুষ। লিভারপুলের সঙ্গে বাঁধন কেটেছেন নিজেই। গত মার্চে চুক্তি নবায়ন করেননি। এই মৌসুম শেষেই ছাড়তে চেয়েছেন অ্যানফিল্ড। শিষ্যের এই ইচ্ছা শুনে বিস্মিত হয়েছিলেন কোচ ইয়ুর্গেন ক্লপ। অবিশ্বাস্য লেগেছিল লিভারপুল সমর্থকদের। যে ছেলেটির অ্যানফিল্ডে আসার সময় কেউ তেমন সম্ভাবনা দেখেনি।

তারকা হয়ে তো ওঠা দূরের কথা—দিন গড়িয়ে সে ছেলেটিই হয়ে উঠলেন লিভারপুলের পুনর্জাগরণের অন্যতম সারথি, ক্লাব কিংবদন্তি। তাঁকে বিদায় জানানোর শ্রেষ্ঠ সময় তো এটাই—অ্যানফিল্ডে আজ মৌসুমের শেষ ম্যাচ খেলবে লিভারপুল। দিনে দিনে ঘরের ছেলে হয়ে ওঠা ফিরমিনোকে ক্লপ একাদশে রাখবেন কি না, তা অনিশ্চিত। কিন্তু যখনই নামান, অ্যানফিল্ডে একটা অদৃশ্য রং ভর করতে পারে, যা আসলে লিভারপুলেরই রং—সর্বলাল—ঘরের ছেলেকে বিদায় জানানোর সময় মনের মধ্যে অদৃশ্য যে রক্তপাত ঘটে, সেটার রংও তো লাল–ই! সেই ব্যথায় ফিরমিনোর আজ নীল হওয়ার দিন।

ফিরমিনো ব্রাজিলিয়ান, কিন্তু লিভারপুলের লাল রঙে মিশে গিয়েছিলেন। আর তাই লিভারপুলে আজ বিদায়ের মঞ্চে আরও অনেকেই উঠবেন, কিন্তু সমর্থকদের দীর্ঘশ্বাসের দমক তাঁর জন্যই বেশি ছুটবে। জেমস মিলনারের মতো ক্লাব কিংবদন্তি, নবি কেইতা, অ্যালেক্স অক্সালেড–চেম্বারলেইনরাও বিদায় নেবেন এই ম্যাচ দিয়ে।

লিভারপুলকে ইউরোপে আবারও দাপুটে করে তোলার নেপথ্য কারিগরদের একজন ক্রীড়া পরিচালক জুলিয়ান ওয়ার্ড, গবেষণাপ্রধান ইয়ান গ্রাহামও বিদায় নেবেন দ্রুতই। খেলোয়াড়দের মতো বিদায়ী ভালোবাসা তাঁরা হয়তো পাবেন না। তাঁরা সেটি প্রত্যাশাও করেন না। কিন্তু ফিরমিনো না চাইলেও পাবেন, তাঁকে নিতে হবে—শেষ বাঁশি বাজার পর সম্ভবত কোনো চোখই শুকনো থাকবে না। ফিরমিনোর প্রতি বিদায়ী ভালোবাসায় বেশির ভাগের চোখে কী যেন পড়বে। ভেজা ভেজা লাগবে।

এমন যে হবে, ফিরমিনো তা জানেন বলেই আগেভাগে বলে রেখেছেন, ‘আমি ম্যাচে মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করছি।’ কিন্তু শেষ বাঁশি বাজার পর? তখন তো আর ম্যাচ নেই! ফিরমিনোর মুখেই শুনুন, ‘শতভাগ নিশ্চিত থাকুন কেঁদে ফেলব।’ ফিরমিনোর এই কান্নার অর্থ শুধু বিচ্ছেদের ব্যথা নয়, আনন্দাশ্রুও। কেন? সে গল্প আমরা সবাই জানি। তবু বিদায়লগ্নে স্মরণ করায় দোষ নেই।

ভাঙছে ক্লপ ফিরমিনো জুটি

লিভারপুলের হয়ে ৩৬০ ম্যাচে ১০৯ গোল। সাফল্য? লিভারপুলের পুনরুত্থানের পথে কি জেতেননি! চ্যাম্পিয়নস লিগ, প্রিমিয়ার লিগ, এফএ কাপ, ক্লাব বিশ্বকাপ, সুপার কাপ থেকে কমিউনিটি শিল্ড। কিন্তু ফিরমিনোর মহিমা শুধু ট্রফি জেতাতেই সীমাবদ্ধ নয়। লিভারপুলে যোগ দেওয়ার পর কিছুদিন উইংয়ে খেলেছেন কিংবা বেঞ্চে বসতে থাকতে হয়েছে, যখন ব্রেন্ডন রজার্স ছিলেন। ক্লপ এসে তাঁকে ‘ফলস নাইন’ পজিশনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া পর ভেঙে পড়ল খোলস, বেরিয়ে এলেন আসল ফিরমিনো।

তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত খেলা, নিঃস্বার্থ পাস ও সুযোগসন্ধানী মানসিকতায় লিভাপুলের আক্রমণভাগ হয়ে উঠেছিল ‘ত্রিশূল’—ডানে মোহাম্মদ সালাহ, বাঁয়ে সাদিও মানে এবং তাঁদের পেছনে ফিরমিনো। মানে চলে গেছেন। সালাহ আছেন। এই বিচ্ছেদেও সেই ‘ত্রিশূল’ আক্রমণভাগের স্মৃতি কেউ ভোলেনি।

আক্রমণভাগে দুই দিকের দুটি ফলার (সালাহ–মানে) ঠিক মাঝের ফলাটি ছিলেন ফিরমিনো—ইউরোপের অন্যতম ভয়ংকর আক্রমণভাগ। ফিরমিনো সেখানে বাকি দুজনের সঙ্গে অনেক কিছুতে পিছিয়ে থাকলেও গুরুত্বের দিক থেকে সম্ভবত উল্টো। সালাহ ও মানের মহিরুহ হয়ে ওঠার পেছনে বড় ভূমিকা ছিল ফিরমিনোর নিঃস্বার্থ ও বুদ্ধিদীপ্ত খেলার।

আর তাই লিভারপুলের সমর্থকদের কাছে ফিরমিনো খুব প্রিয়। ক্লাবটির ভক্তদের মার্সিসাইড শাখার চেয়ারম্যান লেস লসনের দাবি, লিভারপুলের বৈশ্বিক সমর্থকগোষ্ঠীর কাছে ফিরমিনোর মতো সমাদৃত খেলোয়াড় তিনি আর দেখেননি। এর পেছনে বড় ভূমিকা তাঁর নিঃস্বার্থ খেলার—সেটাই নাকি মিস করবেন লিভারপুলের সমর্থকেরা। আর মুখের হাসিটা? যেন ৩১ বছর বয়সী কোনো ‘কিশোর’–এর সরল হাসি! ফিরমিনোর দাঁতের চিকিৎসক রবি হিউজেসের দাবি, ববির দাঁতের চিকিৎসা করার পর সবাই নাকি তাঁর কাছে গিয়ে ‘ববিস ড্যাজলার্স’ চান—অর্থাৎ, ফিরমিনো হাসলে সাদা দাঁতগুলো যেমন সরল সৌন্দর্য ছড়ায়, তেমন করে দাও!

বোঝাই যাচ্ছে, দুই পক্ষেরই ভালোবাসার টান প্রবল। তাহলে চলে যাওয়া কেন? ফিরমিনো যখন নিজেই বলেছেন, ‘আমি সবকিছু মিস করব...বিশেষ করে সমর্থকদের। আমি তাদের ভালোবাসি। এই আট বছরে তারা আমাকে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছে। ক্লাব আমার ও পরিবারের জন্য যা করেছে, তার জন্য আমি সুখী।’

লিভারপুলের হয়ে ৩৬০ ম্যাচে ১০৯ গোল গোল করেছেন এই ব্রাজিলিয়ান

তাহলে? উত্তরটা তাঁর মুখেই শুনুন, ‘দুর্ভাগ্যজনকভাবে এটাই সময়। চক্রটা পূরণ হয়েছে, তাই চলে যাওয়ার এটাই সময়...হয়তো একদিন ফিরব, কিন্তু যাওয়ার সময় এখনই।’ আর তাঁর এই চলে যাওয়ার সময় লিভারপুল–ভক্ত রস চ্যান্ডলের মনে পড়ছে সবচেয়ে বড় সত্য, ‘সে ফুটবলে আনন্দ ফিরিয়ে এনেছিল।’ লিভারপুলেরই সাবেক মিডফিল্ডার ড্যানি মার্ফির ভাষায়, ‘ফিরমিনো লিভারপুলের কাল্ট হিরো।’

কাল্ট হিরো—শব্দটির ব্যাপ্তি অনেক এবং সুগভীর। ফিরমিনোর রেখে যাওয়া ‘লিগ্যাসি’র গভীরতা তার চেয়ে কম নয়। তাঁর সময়ে সাত বছরে চারবার ইউরোপিয়ান ফাইনাল খেলেছে, শিরোপা জিতেছে একবার। ৩০ বছর পর জিতেছে লিগ। এর সঙ্গে অন্যান্য ঘরোয়া শিরোপা জয় এবং মাঠে নিজের খেলার আলাদা একটা ধরন তৈরি করা, যা সালাহ–মানের চেয়ে একদমই আলাদা। একই সঙ্গে বুদ্ধিদীপ্ত, প্রতিভাবান ও নিঃস্বার্থ—কাল্ট হিরো বা কিংবদন্তি হয়ে উঠতে আর কী লাগে!

পৃথিবীতে প্রতিটি যুগেই লোকে নিজ নিজ অঞ্চলের ‘কাল্ট হিরো’দের অনুসরণ করেছে, করছে—ফিরমিনোর ক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় হচ্ছে না। মার্ফির মুখেই শুনুন, ‘লিভারপুলের অনেক মানুষ তাকে ভালোবাসে এবং ভালোবাসবে। অনেক তরুণ খেলোয়াড় ও বাচ্চারা তার মতো হতে চায়। এর চেয়ে বড় প্রশংসা আর কী হতে পারে!’

লিভারপুলের ইতিহাসে সর্বোচ্চ গোলদাতার তালিকায় ১৭তম ফিরমিনো। আহামরি কিছু নয়। কিন্তু গোল বানিয়েছেন ৭১টি। প্রিমিয়ার লিগ শুরুর পর লিভারপুলের হয়ে শুধু স্টিভেন জেরার্ড, মোহাম্মদ সালাহ ও স্টিভ ম্যাকম্যানামান তাঁর চেয়ে বেশি গোল বানিয়েছেন। প্রিমিয়ার লিগে বড় ৬টি দলের বিপক্ষে করেছেন ২৭ গোল, চ্যাম্পিয়নস লিগে ২২ গোল। পডকাস্ট ‘দ্য অ্যানফিল্ড র‌্যাপ’–এর জন গিবনস তাই লিভারপুলে ফিরমিনোর আসল পরিচয়টা জানিয়ে দিলেন, ‘সে গোল করায় ও পরিশ্রম করে খেলে, যদিও আরও গোল করতে পারত। কিন্তু সবার আগে সে “টিম প্লেয়ার”—দলের জন্য খেলে।”’

লেস্টার সিটির মাঠে লিভারপুলের সর্বশেষ ম্যাচেই ফিরমিনোকে বিদায় দেওয়ার প্রথম পর্ব সেরেছে লিভারপুলের ভক্তরা। তাঁর জন্য বানানো ‘সি সিনর’ গান ধরেছিলেন ভক্তরা। অথচ ফিরমিনোকে সেদিন ক্লপ বেঞ্চেও রাখেননি। খুব আবেগাক্রান্ত হয়েছিলেন, ‘বিস্মিত হয়েছিলাম, কারণ ম্যাচটা ছিল প্রতিপক্ষের মাঠে। ভক্তরাও জানত, আমি বেঞ্চেও নেই। তবু তারা গান ধরেছিল আমার জন্য, যে কারণে খুব আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম। যখন জানলাম ভক্তরা আমার জন্য গান বেঁধেছে, তখন কেমন যে লেগেছে! এসবই ভালোবাসার প্রকাশ।’

ফিরমিনোর ছবিতে ছেয়ে গেছে অ্যানফিল্ডের আশপাশ

অ্যানফিল্ডে আজও ‘সি সিনর’ গানের সুর উঠবে গ্যালারিতে। দুই দিন আগে ফিরমিনো নিজেও গাড়িতে সন্তানদের নিয়ে এই গানে গলা মিলিয়েছেন। তাঁর সন্তানেরা গানটি পিয়ানোতে তুলতে চায়। ফিরমিনো পিয়ানো বাজাতে পারলেও গানটি এখনো তোলা হয়নি। বলেছেন, ‘এটা অনেক কঠিন। তবে আমি শিখে নেব।’

আসলে লিভারপুলে এটাই সম্ভবত ফিরমিনোর আসল পরিচয়, শিখে নেওয়া কিংবা মানিয়ে নেওয়ায় তাঁর জুড়ি মেলা ভার। ওয়াইড উইঙ্গার কিংবা স্ট্রাইকার থেকে ‘ফলস নাইন’—পজিশন যা–ই হোক, ফিরমিনো সব সময়ই দলের জন্য খেলেছেন। এমন একজনকে বিদায় জানানোর দিন লিভারপুলের সমর্থকদের কি আর ম্যাচে তাকানোর অত সময় থাকবে!

আজ যে লিভারপুলের ঘরে লালের ভিড়ে ফিরমিনো–বিচ্ছেদের ব্যথায় নীল হওয়ার দিন, ‘কাল্ট হিরো’কে সামনে রেখে অ্যানফিল্ডের গ্যালারিতে শেষবারের মতো ‘সি সিনর’ গানটি গাওয়ার দিন—‘কপরা (সমর্থক) তোমাদের একটি বিষয় জানাতে চায়,
বিশ্বসেরা কে জানো,

নাম তার ববি ফিরমিনো,
আমাদের ৯ নম্বর
যতবার বল দেবে ততবারই গোল করবে,
সিনর,
বলটা তাই ববিকে দাও, সে গোল করবে...।’