গঞ্জালো মন্তিয়েল যে দলে, ট্রাইব্রেকারে সে দলের জয় একরকম যেন অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। আর্জেন্টিনাকে কাতার বিশ্বকাপ জিতিয়েছে মন্তিয়েলের নেওয়া শট, এ বছর সেভিয়াকেও ইউরোপা লিগ শিরোপা এনে দিয়েছে তাঁর সফল স্পট কিক। যে শিরোপা জয়ের সুবাদে উয়েফা সুপার কাপ খেলার সুযোগ পায় সেভিয়া।
ম্যানচেস্টার সিটির বিপক্ষে আজ সেই সুপার কাপও গড়াল রোমাঞ্চকর টাইব্রেকারে। এবার পেনাল্টি শুটআউটে সেভিয়ার হয়ে চতুর্থ শট নিতে আসা মন্তিয়েল আগের দুবারের মতোই প্রতিপক্ষ গোলরক্ষককে ফাঁকি দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর সতীর্থ নেমানিয়া গুদেলির নেওয়া শেট শটটি বাঁধা পায় বারপোস্টে। তাতে প্রথমবার খেলতে এসেই নতুন ট্রফির স্বাদ পেয়ে গেল সিটি। ২০০৬ সালে ওই একবারই জেতা সেভিয়া এরপর এ নিয়ে হারল টানা ৬ বার।
গ্রিসের রাজধানী অ্যাথেন্সের কারাইসকাকিস স্টেডিয়ামে নির্ধারিত ৯০ মিনিট শেষে ম্যাচ ১–১ সমতায় ছিল। প্রথমার্ধে সেভিয়াকে এগিয়ে দেন ইউসেফ এন নেসিরি। দ্বিতীয়ার্ধে সমতা ফেরান সিটির কোল পালমার। দুটি গোলই হয়েছে হেড থেকে। উয়েফার নতুন নিয়ম অনুযায়ী, অতিরিক্ত ৩০ মিনিটের পরিবর্তে এরপর সরাসরি খেলা টাইব্রেকারে গড়ায়। সেখানে ৫–৪ ব্যবধানে জিতে সিটি।
টাইব্রেকারে সিটির হয়ে জাল কাঁপান আর্লিং হলান্ড, হুলিয়ান আলভারেজ, মাতেও কোভাচিচ, জ্যাক গ্রিলিশ ও অধিনায়ক কাইল ওয়াকার। সেভিয়ার হয়ে প্রথম চারটি শটে সফল হন লুকাস ওকাম্পোস, রাফা মির, ইভান রাকিতিচ ও মন্তিয়েল। কিন্তু শেষ শট নেওয়া গুলেদি ব্যর্থ হন। উঁচুতে নেওয়া তাঁর কিক বারে লেগে ফিরতেই উৎসবে মেতে ওঠে পেপ গার্দিওলার সিটি।
রোমাঞ্চকর এ জয়ে সিটিজেনদের কোচ হিসেবে শুধু সম্ভাব্য সব শিরোপাই জিতলেন না; কার্লো আনচেলত্তির গড়া রেকর্ডেও ভাগ বসালেন গার্দিওলা। আনচেলত্তির পর দ্বিতীয় কোচ হিসেবে ৪ বার জিতলেন উয়েফা সুপার কাপ। তবে আরেকটি জায়গায় অনন্য কীর্তি গড়ে ফেললেন ৫২ বছর বয়সী এ স্প্যানিশ। প্রথম কোচ হিসেবে ৩টি ভিন্ন ক্লাবকে তিনি এই ট্রফির স্বাদ পাইয়ে দিলেন। সিটির আগে বায়ার্ন মিউনিখ (২০১৩) ও বার্সেলোনাকে (২০০৯ ও ২০১১) এই শিরোপা জিতিয়েছিলেন গার্দিওলা।
আজকের জয়ে সেভিয়ার বিপক্ষে ১০০% জয়ের রেকর্ডও ধরে রাখল। এর আগে চ্যাম্পিয়নস লিগের গ্রুপ পর্বে মুখোমুখি হওয়া ৪ ম্যাচেই স্প্যানিশ ক্লাবটিকে হারিয়েছিল সিটি।
লন্ডনের ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে কদিন আগে আর্সেনালের বিপক্ষে কমিউনিটি শিল্ডে টাইব্রেকারে হেরে মৌসুম শুরু হয়েছিল ম্যানচেস্টার সিটির। সেই হারের পর বাস্তবতা টের পেয়েছিলেন গার্দিওলা। জানিয়েছিলেন, এ মৌসুমে অন্য যেকোনো বারের চেয়ে কঠিন পরীক্ষা দিতে হবে। তাই আর কখনোই ট্রেবল জয়ের সম্ভাবনা দেখেন না।
সেভিয়া আজ গার্দিওলার দলকে কঠিন পরীক্ষায় ফেলল ঠিকই; কিন্তু শেষ পর্যন্ত পেরে উঠল না। শুধু কি সেভিয়াই? আজ সিটির বড় প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছিল অ্যাথেন্সের আবহাওয়াও। স্প্যানিশ ক্লাবটির জন্যও তাই। কদিন আগেই ভয়াবহ দাবানাল ছড়িয়ে পড়েছিল গ্রিসের বেশ কয়েকটি এলাকায়। তীব্র দাবদাহে তাপমাত্রা উঠেছিল ৪৪° সেলসিয়াসে। সে তুলনায় আজকের ২৭° সেলসিয়াসকে কমই বলা যায়। কিন্তু ভ্যাপসা গরমে ঘামতে ঘামতে নাজেহাল দশা হয়েছিল খেলোয়াড়দের। তাই ম্যাচের ২৫ মিনিটে দেওয়া হয়েছিল প্রথম কুলিং ব্রেক।
অসহনীয় গরমের কারণে সিটিকে তখন পর্যন্ত বড্ড অচেনা লাগছিল। কিন্তু গরমের দোহাই দিয়ে কি আর গার্দিওলার চোখরাঙানি থেকে বাঁচা যায়! কুলিং ব্রেকের পুরোটা সময় গার্দিওলা শিষ্যদের ওপর রাগ ঝাড়লেন, ভুলভ্রান্তি দ্রুত শুধরে নিতে বললেন। বিপরীতে সেভিয়া কোচ হোসে লুইস মেন্দিলিবার শিষ্যদের পানি পানের সুযোগ দিলেন। মাথা ঠাণ্ডা রেখেই কিছু কথা বললেন। সেটাই কাজে দিল।
চাঙা হয়ে ফিরতে না ফিরতেই সিটিকে ভড়কে দিল সেভিয়া। ২৫ মিনিটে এন নেসিরি যে গোলটি করলেন, তা হয়ে রইল দলীয় সম্বন্বয়ের প্রতীক।
সেভিয়ার এই গোলের উৎস ছিলেন তাঁদের গোলরক্ষক ইয়াসিন বুনু। তাঁর লম্বা থ্রোতে বল পেয়ে যান ওকাম্পোস। তিনি বল বাড়ান তাঁর বাঁ পাশে থাকা মার্কোস আকুনিয়াকে। আর্জেন্টিনার হয়ে বিশ্বকাপ জেতা আকুনিয়া দারুণ উচ্চতায় ক্রস বাড়ান এন নেসিরির উদ্দেশে। মরক্কোর এই স্ট্রাইকারকে কড়া মার্কিংয়েই রেখেছিলেন নাথান আকে ও ফুটবল ইতিহাসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দামি ডিফেন্ডার ইওস্কো গাভারদিওল।
সেই দুজনের মাঝ বরাবর থাকলেও লাফিয়ে উঠে জোরালো হেড করেন এন নেসিরি। সেটা চেয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করার ছিল না সিটি গোলরক্ষক এদেরসনের। এমন এক হেডে গোল করে কাতার বিশ্বকাপ থেকে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর পর্তুগালকেও ছিটকে দিয়েছিলেন এন নেসিরি। আফ্রিকার প্রথম দল হিসেবে মরক্বো উঠেছিল সেমিফাইনালে।
পিছিয়ে পড়ার পর বহু ম্যাচে সঙ্গে সঙ্গে ফিরেছে সিটি। কিন্তু আজ প্রথমার্ধে সেটার লেশমাত্র দেখা যায়নি। ইলকাই গুন্দোয়ান সিটি ছেড়ে বার্সায় যোগ দিয়েছেন। কেভিন ডি ব্রুইনা প্রিমিয়ার লিগ মৌসুমের উদ্বোধনী ম্যাচে হ্যামস্ট্রিং চোটে পড়ে ৪ মাসের জন্য ছিটকে গেছেন মাঠের বাইরে। বের্নার্দো সিলভাকেও এ ম্যাচের স্কোয়াডে রাখেননি গার্দিওলা। রদ্রি–কোভাচিচদের নিয়ে গড়া মাঝমাঠ শুরুর দিকে তাই পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে পারেনি। বিরতির আগে সিটি হাতেগোনা যে কটি আক্রমণের চেষ্টা করেছিল, সব অঙ্কুরে বিনষ্ট করে দিয়েছে সেভিয়া। বিরতিতে যাওয়ার আগে দুটি ফ্রি কিকও পেয়েছিল সিটি। একটি সেভিয়ার মানব দেয়ালে বাধা পেয়েছে, অন্যটি হয়েছে ব্লকড।
প্রথমার্ধের যোগ করা সময়ে দারুণ ক্রস করেছিলেন গ্রিলিশ। কোভাচিচ বলে পা ছোঁয়ালেই গোল হতে পারত। কিন্তু তাঁকে সেভিয়ার ডিফেন্ডাররা ঘিরে রাখায় বলের নাগাল পাননি।
দ্বিতীয়ার্ধের শুরু থেকে গোলের জন্য হন্যে হয়ে পড়ে সিটি। রক্ষণ খোলা রেখে দলের প্রায় সবাই ওপরে উঠে খেলতে থাকেন। সেই অরক্ষিত রক্ষণকে ফাঁকি দেওয়ার সুবর্ণ সুযোগ আসে সেভিয়ার সামনে। খেলার ধারার বিপরীতে বল পেয়ে যান ওকাম্পোস। অসাধারণ পাস বাড়ান নেসিরিকে। তবে সহজতম সুযোগটি এবার নষ্ট করেন। শট মারেন সিটি গোলরক্ষক এদেরসেন বরাবর।
৫৯ মিনিটেও এমন এক সুযোগ পেয়েছিলেন নেসিরি। এবার ডানপ্রান্ত থেকে বল পেয়েছিলেন। তবে বলের গতিবিধি বুঝতে ভুল করেন। নাগাল পাওয়ার আগেই মুঠোবন্দী করে ফেলেন এদেরসন। এভাবে লাগাতার সুযোগ হাতছাড়া করে প্রথমার্ধের নায়ক দ্বিতীয়ার্ধে বনে যান খলনায়ক।
নেসিরি ভুল করলেও সিটি আর ভুল করেনি। ৬৩ মিনিটে কোল পালমারের গোলে সমতায় ফেরে গার্দিওলার দল। পালমারের উদ্দেশে পিন পয়েন্ট ক্রস বাড়িয়েছিলেন গত চ্যাম্পিয়নস লিগ ও নেশনস লিগের সেরা খেলোয়াড় রদ্রি। হতচকিত হয়ে গোলপোস্ট ছেড়ে অনেকটা এগিয়ে এসেছিলেন সেভিয়ার শেষ প্রহরী বুনু। পালমার বল পেয়ে যান গোলপোস্টের ডানপাশে। সেখান থেকে নেওয়া তাঁর মাপা হেডে বল বাঁ পাশ দিয়ে আশ্রয় নেয় জালে। ইংল্যান্ড অনূর্ধ্ব–২১ দলের হয়ে ইউরো জেতা এই তরুণ কদিন আগে কমিউনিটি শিল্ডেও গোল করেছিলেন। সেদিন তাঁর গোলটা বৃথা গেলেও এবার সেটা হয়নি।
পরে পালমারের বদলি নামা আলভারেজ নিজের ও দলের মান রেখেছেন টাইব্রেকারে গোল করে। এর আগে ও পরে সফল হয়েছেন তাঁর সতীর্থরাও। মন্তিয়েল আর সেভিয়ার রাতটা তাই হতাশাতেই শেষ হয়েছে।