আর্জেন্টিনার তারকা লিওনেল মেসি
আর্জেন্টিনার তারকা লিওনেল মেসি

ফাইনালের আগেই তো এটি ‘মেসির বিশ্বকাপ’

আগেই বলে দিয়েছেন, এটাই তাঁর শেষ বিশ্বকাপ। তারপরও লিওনেল মেসিকে আবারও তা বলতে হচ্ছে কেন? কারণ কি এটাই, লিওনেল মেসিকে আর বিশ্বকাপে দেখা যাবে না, এটা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে অনেকের! না, আসল কারণ মনে হয় অন্য। ৩৫ বছর বয়সেও লিওনেল মেসির তারুণ্যের সেই রূপে দেখা দেওয়া!

পরশু রাতে তর্কযোগ্যভাবে বিশ্বকাপ ফুটবলে নিজের সেরা ম্যাচটা খেলার পর মেসিকে তাই আবারও বলতে হলো, ‘পরের বিশ্বকাপটা অনেক দিন পরে। পারব না। আমার মনে হয়, এভাবে শেষ করাই ভালো।‌’

এভাবে শেষ মানে কীভাবে শেষ, তা খুলে বলার দরকার আছে বলে মনে হয় না। ১৮ ডিসেম্বর রাতে আলোর রোশনাইয়ে ভেসে যাওয়া লুসাইল আইকনিক স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপ ট্রফিটা হাতে নিয়ে বিদায়। এর চেয়ে ভালো চিত্রনাট্য আর কী হয়!

তা ফুটবল-বিধাতাও এই চিত্রনাট্যই লিখে রেখেছেন তো! কে বলতে পারে! কে বলতে পারে, লিওনেল মেসির ফুটবলজীবনের একমাত্র অতৃপ্তিটা ঘুচিয়ে দেবে লুসাইল, নাকি হয়ে যাবে মারাকানা-টু! প্রায় সাড়ে আট বছর আগের যে মারাকানা মেসির জীবনে ‌‘এত কাছে, তবু এত দূর’-এর আক্ষেপ। যে মারাকানা আর্জেন্টাইনদের অনন্ত দীর্ঘশ্বাস। যে মারাকানা সেদিন কাঁদিয়েছিল মেসিকে।

কাতার বিশ্বকাপে কি ক্যারিয়ারের একমাত্র অতৃপ্তি ঘোচাতে পারবেন মেসি

আর্জেন্টিনার ফুটবল ইতিহাসে বড় ভালোবাসার সঙ্গে উচ্চারিত হয় দুটি স্টেডিয়ামের নাম। বুয়েনস এইরেসের মনুমেন্টাল আর মেক্সিকো সিটির আজটেকা। একটার পর একটা বিশ্বকাপ হতাশার গল্প লিখেছে আর আর্জেন্টাইনরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফিরে গেছে এই দুই স্টেডিয়ামে। যেখানে লেখা হয়েছে তাদের বিশ্বজয়ের দুই গল্প। লুসাইল কি এতে তৃতীয় সংযোজন!

তা হলে কিন্তু দারুণ মানিয়ে যায়। লুসাইল তো এই বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার ‘হোম গ্রাউন্ড’। আক্ষরিক অর্থেই ‌বাড়ির পাশের মাঠ। কাতারে আর্জেন্টিনা দলের ঠিকানা কাতার বিশ্ববিদ্যালয়। মেট্রোতে পরের স্টেশনটাই লুসাইল। পাঁচ কিলোমিটারের মতো দূরত্ব। ম্যাচের দিন মাঠে যেতে আর্জেন্টিনার টিম বাসের ১০ মিনিটও লাগে না। এটাই লুসাইলকে আর্জেন্টিনার হোম গ্রাউন্ড মনে হওয়ার একমাত্র কারণ নয়। নীল-সাদা জার্সিতে ছেয়ে যাওয়া গ্যালারিও নয়। স্টেডিয়ামে কী আসে–যায়, আর্জেন্টিনার প্রতিটি ম্যাচেই তো গ্যালারি এ রকম থেকেছে। লুসাইল আলাদা হয়ে যাচ্ছে সেটি এই বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার আবেগে উথালপাতাল যাত্রার সাক্ষী বলে। ফাইনালের আগে ছয় ম্যাচের চারটিই এই মাঠে। আর্জেন্টিনার ভিত্তিমূল কাঁপিয়ে দেওয়া সৌদি আরবের বিপক্ষে পরাজয়ও। টানা ৩৬ ম্যাচ অপরাজিত থাকার পর যে পরাজয় এর পরের প্রতিটি ম্যাচকেই ‘ফাইনাল’ বানিয়ে দিয়েছে আর্জেন্টিনার জন্য। সত্যিকার ফাইনালে ওঠার পর লিওনেল মেসি তাই বলছেন, ‌‘আমরা তো পাঁচটা ফাইনাল খেলেই ফেলেছি। পাঁচটা ফাইনালই জিতেছি। আশা করি, শেষ ফাইনালটাও এমনই হবে।’

সৌদি আরবের কাছে হারের পর বাকি ম্যাচগুলোকে ফাইনাল হিসেবে দেখেছেন মেসি

সৌদি আরবের বিপক্ষে ওই পরাজয়ের পর প্রতিটি ম্যাচের আগেই আর্জেন্টিনার সংবাদ সম্মেলনে একটা কথা কমন থেকেছে। স্প্যানিশ ভাষায় সম্ভবত ‘সুফ্রিমিয়েন্তো’। ইংরেজি হয় ‌‘সাফারিং’। বাংলা প্রতিশব্দ করা যায়: কষ্ট পাওয়া, যন্ত্রণা পাওয়া, ভোগা ইত্যাদি। স্প্যানিশ তো আর বুঝি না, ফিফা অনুবাদকের মাধ্যম হয়ে ইংরেজিতে ‘‌সাফারিং’ শুনতে শুনতে মনে হতো, এটাকে আর্জেন্টিনা দল থিম সং বানিয়ে নিল নাকি!

নিতেই পারে। এই বিশ্বকাপে প্রতিটি ম্যাচই তো আর্জেন্টিনার জন্য ‘সাফারিং’। সৌদি আরব ম্যাচটা অভাবনীয় পরাজয়ে আর এর পরের প্রতিটি ম্যাচই জীবন-মরণ লড়াই। হেরে গেলেই বিদায়। যেটির অনুষঙ্গ হয়ে এসেছে সেই শঙ্কা, আজই কি বিশ্বকাপে লিওনেল মেসির শেষ ম্যাচ? সত্যিকার শেষ ম্যাচটা যে ফাইনাল, সেটিও তো মেসির কল্যাণেই। পাহাড়প্রমাণ চাপের মধ্যে ম্যাচের পর ম্যাচ বের করে নিয়ে গেছেন দলকে। পাঁচ ‌‘ফাইনাল’-এর চারটিতেই ম্যাচসেরার পুরস্কার হাতে ওঠাই যার প্রমাণ। আর্জেন্টিনার ১৯৮৬ বিশ্বকাপ জয় যদি ডিয়েগো ম্যারাডোনার একক কৃতিত্বধন্য হয়, এই বিশ্বকাপের আর্জেন্টিনাও তো ‘লিওনেল মেসি শো’। ফুটবল দলীয় খেলা বলে ম্যারাডোনার বিশ্বকাপে পার্শ্বনায়ক হিসেবে বুরুচাগা-ভালদানোর নামগুলো যেমন আসে, এখানেও তেমন আসছে দু–একটি নাম। ক্রোয়েশিয়া ম্যাচের পর সবচেয়ে বেশি হয়তো হুলিয়ান আলভারেজ।

২০১৪ বিশ্বকাপও অনেকটা এমনই ছিল। সেবারও আর্জেন্টিনার চার ম্যাচে সেরা খেলোয়াড়ের ট্রফি উঠেছিল মেসির হাতে। সেই বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়ের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি ‘গোল্ডেন বল’-ও। যদিও তা নিয়ে একটু বিতর্ক ছিল। খোদ ফিফা সভাপতি সেপ ব্ল্যাটার পর্যন্ত যাতে বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন। সেই বিশ্বকাপে মেসির ৪টি গোল। যার ৩টিই বিশ্বকাপের সেরা গোলের ফুটেজে থাকবে। মেসির ম্যাজিক গোলেই গ্রুপ পর্ব পেরিয়েছিল আর্জেন্টিনা। কিন্তু ওই গোলগুলো ছাড়া ম্যাচে সামগ্রিক প্রভাবের দিক থেকে মেসিকে মোটেই মেসি বলে মনে হয়নি। একমাত্র যে ম্যাচটিকে মনে হয়েছিল, দ্বিতীয় রাউন্ডে সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে সেই ম্যাচে আবার গোল নেই। নকআউট ম্যাচে যে মেসি গোল করতে পারেন না!

এই অপবাদও কী দারুণভাবেই না ঘুচিয়েছেন এবার! সৌদি আরবের কাছে হারার পর এই বিশ্বকাপে প্রতিটি ম্যাচই তো আর্জেন্টিনার জন্য ‘নকআউট’, সত্যিকার নকআউটের তিন ম্যাচের প্রতিটিতেই এবার গোল করেছেন মেসি। শুধু তো গোলই নয়, কী অপূর্ব সব অ্যাসিস্ট। মেসির গোল বেশি সুন্দর নাকি অ্যাসিস্ট—এ আলোচনাও তো তুলে দিয়েছেন এবার। যেমন আলোচনা হচ্ছে, বিশ্বকাপ জিতুন বা না জিতুন, সর্বকালের সেরার স্বীকৃতি কেন এখনই পাবেন না মেসি?

আর্জেন্টিনা ২০১৪ বিশ্বকাপের ফাইনালে ওঠার পরও এমন একটা আলোচনা শুরু হয়েছিল। মেসি বিশ্বকাপ জিতলেই সর্বকালের সেরা। যা শুনে সাবেক ইংল্যান্ড স্ট্রাইকার গ্যারি লিনেকার বলেছিলেন, মেসির হাতে বিশ্বকাপ উঠলেও তিনি এগিয়ে রাখবেন ম্যারাডোনাকেই। ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে মাঠ আলো করা পারফরম্যান্স দেখার পর সেই লিনেকারই ‘ম্যারাডোনা না মেসি’র আর্জেন্টাইন সীমানা ছাড়িয়ে সর্বকালের সেরার স্বীকৃতি দিয়ে দিতে চাইছেন মেসিকে।

১৮ ডিসেম্বর লুসাইলের রাতটা মনে হয় চূড়ান্ত রায় দেওয়ার অপেক্ষায়।