এক দিন-দুই দিন, এক সপ্তাহ-দুই সপ্তাহ, এক মাস-দুই মাস...দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেল একটা বছর। ফুটবল–বিশ্বকে রিক্ত করে, শূন্যতা আর হাহাকারে ভাসিয়ে নশ্বর জগতের মায়া কাটিয়ে গত বছরের এই দিনে অবিনশ্বরে যাত্রা করেছিলেন পেলে। ৮২ বছর বয়সে জীবনের মাঠ ছেড়েছেন। কিন্তু কিংবদন্তিরা মরে নাকি! তাঁরা বেঁচে থাকেন অনুগামীদের মনে। ভক্তরা তাঁদের স্মরণ করেন নানা উপলক্ষে। আজ যেমন ফুটবল–সম্রাটের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁকে মনে করছেন হাজারো ভক্ত, আসলে পুরো ফুটবল-বিশ্বই।
পেলের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে দেখা যাক, কোথায় চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন মহান এই ফুটবলার। জানা যাক, কেমনই–বা তাঁর সমাধিস্থল। একুমেনিক্যাল মেমোরিয়াল সমাধিক্ষেত্রের ওয়েবসাইটে আবেদন করলে পেলের সমাধি দেখার অনুমতি মেলে। প্রতিদিন ৬০ দর্শনার্থী পেলের সমাধি দেখার সুযোগ পান।
এটি আমার প্রত্যাশাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে। সত্যিই সুন্দর একটি জায়গা। আশা করি, অনেক পর্যটক এখানে আসবে এবং পেলের গল্পটা জানবেন।পেলের সমাধিক্ষেত্র ঘুরে দেখার পর ব্রাজিলিয়ান ব্যবসায়ী রদ্রিগেজ
দুই যুগের বেশি সময়ের খেলোয়াড়ি জীবনে কত ডিফেন্ডারকে যে ফাঁকি দিয়েছেন পেলে। কিন্তু জীবন-মৃত্যুর লড়াইয়ে দুরারোগ্য ক্যানসারকে আর ফাঁকি দিতে পারেননি। ক্যানসারের সঙ্গে লম্বা লড়াই শেষে গত বছরের ২৯ ডিসেম্বর চলে গেছেন পেলে। মারা যাওয়ার ৫ দিন পর অনুষ্ঠিত হয় তর্কসাপেক্ষে সর্বকালের সেরা ফুটবলারের শেষকৃত্য। শেষকৃত্যের শোকমিছিল শেষে তাঁকে সমাহিত করা হয় সান্তোসের একুমেনিক্যাল মেমোরিয়াল সিমেট্রিতে।
১৪ তলা একুমেনিক্যাল মেমোরিয়াল সমাধিক্ষেত্রে পেলেকে সমাহিত করার পর ভক্তরা শুরুর দিকে প্রিয় তারকার সমাধি দেখতে পাননি। লক্ষ-কোটি ভক্তের ভালোবাসায় তিনি ‘পেলে’ হয়েছিলেন। না–ফেরার দেশে চলে গেলে কিংবা ১৪ তলা সমাধিস্থলে সমাহিত করলেও কি তাঁকে ভক্ত-সমর্থকদের কাছ থেকে দূরে রাখা যাবে! তাই তো মৃত্যুর প্রায় ৫ মাস পর জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে ব্রাজিলের হয়ে ৩টি বিশ্বকাপ জেতা পেলের সমাধিক্ষেত্র।
পেলের সমাধিক্ষেত্র উন্মুক্ত করে দেওয়ার পর থেকেই সেখানে প্রায় প্রতিদিনই ভক্তদের যাতায়াত। ‘ও রেই’ (রাজা)-কে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে কেউ কেউ চোখের জল আটকে রাখতে পারেন না। প্রিয় তারকার সমাধির সামনে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করতে করতে কেউ কেঁদে বুক ভাসাচ্ছেন, এমন দৃশ্য প্রায়ই দেখা যায়। পেলের সমাধিক্ষেত্র খুলে দেওয়ার পর প্রথম দর্শনার্থী ছিলেন রদ্রিগেজ নামের এক ব্যবসায়ী। কিংবদন্তির সমাধি দেখে মুগ্ধ সেই ব্যবসায়ী তখন বলেছিলেন, ‘এটি আমার প্রত্যাশাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে। সত্যিই সুন্দর একটি জায়গা। আশা করি, অনেক পর্যটক এখানে আসবে এবং পেলের গল্পটা জানবেন।’
কী আছে পেলের সমাধিতে যে রদ্রিগেজকে এতটা মুগ্ধ করেছে! ১৪ তলা সমাধিক্ষেত্রের প্রথম তলায় সমাহিত করা হয়েছে পেলেকে। প্রায় ২০০ বর্গমিটার একটি কক্ষের মাঝখানে রাখা হয়েছে পেলের কফিন। সেই কফিনের চারদিকে আবার খোদাই করা আছে পেলের ক্যারিয়ারের নানা মুহূর্ত। কক্ষটিতে ঢোকার সময় দরজায় দর্শনার্থীকে স্বাগত জানায় পেলের দুটি সোনালি রঙের ভাস্কর্য। পেলের সমাধি যে কক্ষে রাখা হয়েছে, সেটির ভেতরটা একটি মাঠের আদলে সাজানো। দেখে মনে হবে, পেলে যে জায়গায় সবচেয়ে বেশি স্বচ্ছন্দ আর খুশি থাকতেন, মৃত্যুর পরও সেই মাঠেই ঠাঁই নিয়েছেন!
পেলের সমাধি রাখার কক্ষটির দেয়ালজুড়ে গ্যালারিতে দর্শকদের উচ্ছ্বাসের বিভিন্ন ছবি। সবুজ গালিচায় আবৃত কক্ষের মাঝখানে পেলের সমাধি আর চারদিকে দর্শকদের উচ্ছ্বাসের ছবি—এটা দেখে যে কারও মনে হবে, খেলোয়াড়ি জীবনের মতো মৃত্যুর পরও পেলে দর্শকদের হাততালি পাচ্ছেন। আর এ হাততালি ও উচ্ছ্বাস কখনোই থামবে না! পেলের সমাধির আরেকটি বিষয়ও চোখে পড়ার মতো। পেলের কফিনের চারপাশটা সোনায় মোড়ানো। দৃশ্যটি দেখে একটা বাক্যই মনে পড়বে যে কারও—সোনার কফিনে শুয়ে আছেন ফুটবলের কালোমানিক!