ফিরে দেখা বিশ্বকাপ

রঙিন বিশ্বকাপে সবচেয়ে ‘রঙিন’ ব্রাজিল

ফুটবল এমন এক খেলা, যেখানে গোল হওয়া না হওয়ার আনন্দ-বেদনার সঙ্গে জটিলতম সব ফরমেশন ও কৌশলের মজা পাওয়া যায়। যে যার জায়গা থেকে খেলাটাকে উপভোগ করতে পারার এই দুর্দান্ত সর্বজনীনতা খেলাটাকে দুনিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় ইভেন্টে পরিণত করেছে। আর নিঃসন্দেহে ফুটবলের সবচেয়ে বড় আসর হলো বিশ্বকাপ ফুটবল। চার বছর পরপর হওয়া এই টুর্নামেন্টের সময় গোটা পৃথিবীর নজর থাকে কে জিতল, কে হারল। খেলাটির সব রকম মানবীয় আবেগকে ধারণ করার যে ক্ষমতা, এ কারণে বিশ্বকাপ ফুটবল শুধু হার-জিতের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এই ইতিহাস তো মানুষেরই ইতিহাস। কাতারে আর কিছুদিন পরই শুরু হবে বিশ্বকাপের ২২তম আসর। তার আগে ফিরে তাকিয়ে ১৯৭০ বিশ্বকাপের গল্প শোনা যাক।

এই সপ্তাহে মানব ইতিহাসের ভয়ংকরতম ঘূর্ণিঝড় ‘ভোলা সাইক্লোনের’ ৫২তম বর্ষপূর্তি। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলে বড় বড় ঝড়ের ইতিহাস পুরোনো নয়, তবে এই ঝড়ের পূর্বাভাস দিয়েছিলেন বিশেষজ্ঞরা। বাঙালির জীবনকে তুচ্ছ ভাবা শাসকেরা এ নিয়ে কোনো উদ্যোগ নেননি।

সেই ঝড়ে মারা যায় ৫ লাখের মতো মানুষ। এই বছর যে কাতারে বিশ্বকাপ হবে, সে দেশেও এতসংখ্যক কাতারি নেই। আর এন্তার ক্ষতি তো ছিলই। তবু চোয়াল শক্ত করে উঠে দাঁড়িয়েছিল মানুষ। জবাব দিয়েছিল সে বছর (১৯৭০) সাধারণ নির্বাচনে। পরের ইতিহাসও সবার জানা। পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম নিষ্ঠুর গণহত্যা পেরিয়ে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভ।

অস্থির, প্রতিবাদী এক দশক শেষে নতুন দশকের শুরুতেই এল বিশ্বকাপ। গোটা দুনিয়াই তখন নতুনের স্বপ্ন দেখছে। ইউরোপজুড়ে ‘স্পিরিট অব ৬৯’, ভিয়েতনামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে এককাট্টা মানুষ, এমনকি সোচ্চার মার্কিনরাও। এরই মধ্যে উত্তর আমেরিকার আরেক প্রান্ত মেক্সিকোতে শুরু হয় বিশ্বকাপ। সেখানেও নতুনের আবাহন। এই বিশ্বকাপ ইউরোপ ও দক্ষিণ আমেরিকার বাইরে আয়োজিত প্রথম বিশ্বকাপ। এই বিশ্বকাপ রঙিনে সম্প্রচারিত প্রথম বিশ্বকাপ। আর অনেকেই বলেন, বিশ্বকাপের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা দলটি এবারই চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল।

বিশ্বকাপ শুরু হলো

বাছাইপর্ব শেষে মোট ১৬টি দল চার গ্রুপে ভাগ হয়ে খেলে। এবারই প্রথম লাল, হলুদ কার্ড ও দুজন বদলি নামানো হয়। তাতে খেলার সৌন্দর্য বেড়েছিল। ‘যুদ্ধাহত’ সালভাদর  ‘এ’ গ্রুপে তিন খেলাতেই হারে। গোলশূন্য ড্র করা মেক্সিকো ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন বাকি দুই খেলায় জিতে যায় পরের রাউন্ডে। পয়েন্ট ও গোল ব্যবধান সমান হলেও টসে জিতে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয় সোভিয়েতরা।

গ্রুপ ‘বি’ থেকে ইতালি আর উরুগুয়ে কোয়ালিফাই করে। ইতালি শেষ গ্রুপ ম্যাচে ইসরায়েলের সঙ্গে গোলশূন্য ড্র করায় ভ্রু কুঁচকেছে অনেকের। জায়নবাদীদের জন্য প্রীতি উপহার হিসেবে ঢিলেঢালা ফুটবল খেলেছে ইতালি, এমন বলেন কেউ কেউ। ‘সি’ গ্রুপ থেকে ব্রাজিল ঢিলেঢালার ধার ধারেনি। গোলের নেশা ও সুন্দর ফুটবল খেলা ব্রাজিল সব ম্যাচ জিতে উঠে যায় পরের রাউন্ডে।

পেলে-টোস্টাওদের ব্রাজিল অতিরক্ষণাত্মক ইংল্যান্ডকে মাত্র এক গোল দিলেও রোমানিয়াকে তিনটি আর চেকোস্লোভাকিয়াকে দেয় চার গোল। অন্যের প্রশংসায় সদা কৃপণ ব্রিটিশ গণমাধ্যম বলেছিল, এই দলের খেলা এত সুন্দর যে আইন করে বন্ধ করে দেওয়া উচিত।

১৯‍৭০ বিশ্বকাপের ব্রাজিল–ইংল্যান্ড ম্যাচের দৃশ্য

ইংল্যান্ড বাকি দুই খেলায় জিতে কোয়ার্টারে ওঠে। তবে ইংল্যান্ডের জালে ব্রাজিলের একমাত্র গোলটির কথা না বললেই নয়। সেদিন ইংল্যান্ডের এগারোজনই নিজেদের বক্স পাহারা দিয়েছে, ধারাভাষ্যকারদের একজন তো বলেই বসেন, গোটা ইংল্যান্ড, এমনকি রানি পর্যন্ত পেনাল্টি বক্স পাহারা দিচ্ছেন। এরই মধ্যে ব্রাজিলের পাওলো সিজার পাস দেন টোস্টাওকে। তিনজনকে কাটিয়ে টোস্টাও পাস দেন পেলেকে। ততক্ষণে তাঁকে ঘিরে তিন ডিফেন্ডার। পেলে করলেন কী ডামি শটের ভান করে বলটা ঠেলে দেন জর্জিনিওকে। বস্তিতে বেড়ে ওঠা জর্জিনিও ছোটবেলা থেকেই পুলিশের গুলি, আর গুন্ডাদের মার এড়ানো শিখেছেন, আর ব্রিটিশরা ননির পুতুল! অবলীলায় একজনকে কাটিয়ে গোল করলেন।

অনবদ্য এই ব্রাজিলকে গোলের সংখ্যায় অবশ্য টেক্কা দিয়েছিল জার্ড মুলারের পশ্চিম জার্মানি। হুম, ঠিকই ধরেছেন ‘ডার বোম্বার’, পশ্চিম জার্মানির মার্কসম্যানন মুলার। বুলগেরিয়া ও পেরুর সঙ্গে টানা দুই ম্যাচে হ্যাটট্রিকসহ গ্রুপের তিন ম্যাচে মাত্র (!) সাত গোল করেন মুলার।

জার্মানি গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন, পেরু রানার্সআপ। পেরুর বিশ্বকাপ শেষ হয় কোয়ার্টার ফাইনালেই। বিপক্ষ দল ছিল ব্রাজিল, প্রস্ফুটিত জোগো বনিতোর সামনে বুক চিতিয়ে লড়েও আন্দেজের মানুষদের কিছু করার ছিল না। রিভেলিনো ১১ মিনিটে গোল করেন, জর্জিনহো দেন ৭৫ মিনিটে, আর এর ফাঁকে দুই গোল দেন টোস্টাও। টুর্নামেন্টের মাত্র কিছুদিন আগে চোখের অপারেশন করা টোস্টাওয়ের গোলগুলো দর্শকদের চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছিল।

ইতালিও চার গোল দেয় মেক্সিকোকে। আগের ফাইনালের প্রতিশোধ নিতে পশ্চিম জার্মানি ৩-২ গোলে হারায় ইংল্যান্ডকে। নির্ধারিত ৯০ মিনিটের খেলা ড্র হলে অতিরিক্ত সময়ে মুলারের গোলে জার্মানরা চলে যায় সেমিফাইনালে। গোলশূন্য ড্রয়ের পর ১১৭ মিনিটে পাওয়া গোলে উরুগুয়েও সোভিয়েতদের হারিয়ে শেষ চারে জায়গা করে নেয়। অর্থাৎ, এমন চারটা দল সেমিফাইনালে, যাদের সবাই আগে কাপ জিতেছে।  
ব্রাজিলের সঙ্গে সেমিফাইনালে ১৯ মিনিটে গোল দিয়ে স্বপ্নের সলতেয় আগুন দেয় উরুগুয়ে। আগুনটা যে আসলে কিসে দিয়েছিল! ব্রাজিল গুনে গুনে তিন গোল দিয়ে উঠে যায় ফাইনালে।

ব্রাজিলিয়ানরা তখন জুলেরিমে ট্রফি চিরতরে জয়ের স্বপ্নে বিভোর।
গোটা দেশের মানুষ জুলে রিমের স্বপ্ন দেখতে থাকে। দেশ হিসেবে ব্রাজিল কিন্তু গোঁড়া ক্যাথলিক ধর্মের অনুসারীদের। দেশটির সব গ্রামে চার্চ নেই, কিন্তু ফুটবল ক্লাব আছে। দেশের মেহনতি মানুষের কাছে রোববারের প্রার্থনার চেয়ে ফুটবল বেশি জরুরি। ‘মারাকানাজ্জো’ বিপর্য়য় কাটিয়ে ’৫৮ ও ’৬২তে বিশ্বকাপ জেতা দলটি ’৬৬তেও জিতে চিরতরে জুলে রিমে ঘরে নিয়ে আসবে, এটাই ছিল স্বপ্ন।

সেই স্বপ্নভঙ্গের পর সত্তরের ব্রাজিল ফুটবল-ধর্মের অনুসারীদের চোখে হয়ে ওঠে পাখাহীন দেবদূতের দল। সবুজ মাঠের ক্যানভাসে পিকাসো-ভিঞ্চি। জর্জিনিও, টোস্টাও, পেলে আর রিভেলিনোর মতো স্ট্রাইকার তো ছিলেনই, গারসন আর অধিনায়ক কার্লোস আলবার্তোও মাঝে মাঝেই উঠে গিয়ে ছয়জনের আক্রমণভাগে পরিণত করতেন দলটিকে। ফুটবলের এত ভয়াল সুন্দর রূপ বিশ্ব খুব কমই দেখেছে।

জর্জিনিওকে মাথায় চড়িয়ে ব্রাজিল ফুটবলারদের উল্লাস

দ্বিতীয় সেমিফাইনালও ছিল মহাকাব্যিক। প্রথমে মনে হচ্ছিল খেলাটা ম্যাড়মেড়ে হবে। আট মিনিটেই এগিয়ে যাওয়া ইতালি বুঝি ‘কাতানাচ্চিও’ খেলে বিপক্ষকে আর গোল করতে দেবে না। অদম্য জার্মানরা মেশিনের মতো খেলে ৯০ মিনিটের মাথায় গোল দিয়ে খেলাটাকে ঠিকই অতিরিক্ত সময়ে নিয়ে যায়। সেখানেই রচনা হয় মহাকাব্যের।
পরের ৩০ মিনিটে ৫ গোল!

মুলার দুই গোল দিয়ে নিজের গোলসংখ্যা ১০-এ নিলেও ইতালি ৩ গোল দেয়। শেষ দিকে ভাঙা হাতে প্লাস্টার ঝুলিয়ে খেলেন বেকেনবাওয়ার।
দুবার করে বিশ্বকাপ জেতা ব্রাজিল আর ইতালির মধ্যে স্বপ্নের ফাইনাল নিশ্চিত হয়। জয়ী দল চিরতরে জিতে নেবে জুলে রিমে ট্রফি।

অ্যাজটেকার ফাইনালে মাত্র ১৮ মিনিটেই জাদুর ঝাঁপি খুলে দেন পেলে। হেডে গোল করেন। তাঁকে মার্কিংয়ের দায়িত্বে থাকা ইতালির ডিফেন্ডার বার্গনিচ পরে এই গোল নিয়ে বলেছিলেন, ‘আমরা একসঙ্গেই লাফালাম অথচ যখন আমি মাটিতে নেমে আসলাম, তখনো দেখলাম পেলে শূন্যে!’

ফুটবলের রাজা পেলে। মাত্র ১৭ বছর বয়সেই যাঁর পায়ের জাদুতে বিশ্বকাপ পায় ব্রাজিল। বিশে পৌঁছানোর আগেই ব্রাজিল সরকার তাঁকে ‘রাষ্ট্রীয় সম্পদ’ হিসেবে ঘোষণা দেয় এবং ইউরোপে ‘রপ্তানি’র ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল।  
মেঘমল্লার রাগে যেভাবে বৃষ্টি হয়, দীপক রাগে যেভাবে আগুন জ্বলে তেমনি পেলের খেলা দেখার জন্য নাকি যুদ্ধও থেমেছে। নইলে বিবাদ ভুলে কেন যুদ্ধবিরতিতে যাবে বায়াফ্রা-নাইজেরিয়া!

ইতালির সঙ্গে ফাইনাল শেষ হওয়ার চার মিনিট আগপর্যন্ত ব্রাজিল ৩-১ গোলে এগিয়ে থাকলেও শেষ গোলটি দেশটির ফুটবল ও পেলের খেলায় সৌন্দর্যের প্রতীক হয়ে আছে। গোলকিপারের থেকে বলটা নিয়ে ব্রাজিলের খেলোয়াড়েরা একে অপরকে পাস দেন, কাটান, পাস দেন।

বাঁ প্রান্তে এভাবে করে ৯ জনের পা ঘুরে বল আসে পেলের পায়ে। ইতালিয়ানরা বাঁ প্রান্ত সামলাতে ব্যস্ত, ওদিকে ডান প্রান্ত দিয়ে চোরা দৌড়ে বক্সের প্রায় কাছাকাছি চলে আসেন কার্লোস আলবার্তো। পেলের পাসটা একদম সামনেই ছিল। দৌড়ের ওপরই কামানের গোলার মতো শট নেন আলবার্তো। রচিত হয় বিশ্বকাপের ইতিহাসেই তর্কযোগ্যভাবে সেরা গোল। বিশ্বকাপে পেলের শেষ অবদানও!

জুলে রিমে চিরতরে জিতেও ধরে রাখতে পারেনি ব্রাজিল। ফেডারেশনের ভবন থেকে ১৯৮৩ সালে চুরি যায়। ট্রফিটা আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। কিন্তু সুন্দর ফুটবল ভিটেমাটি ফিরে পেয়েছিল।