ফুটবল তাহলে এতটাই নির্মম! আর্সেনালের সমর্থকেরা চাইলে এখন এমনটা ভাবতেই পারেন। অথচ কদিন আগেও সব ঠিকঠাক চলছিল। ১৯ বছর পর আর্সেনালের প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা পুনরুদ্ধার মনে হচ্ছিল হাতছোঁয়া দূরত্বে। কিন্তু এরপর কীভাবে যে কী হলো, শিরোপাটাই তো ফসকে গেল! মৌসুমের শেষ ভাগে এসে মিকেল আরতেতা কি যেসব ভুল করেছেন, সেদিকে ফিরে তাকাবেন?
এমন তিক্ত স্মৃতির দিকে কে আর ফিরে তাকাতে চায়! কিন্তু ঘুরে দাঁড়াতে হলে একবার ফিরে তাকাতেই হবে। অসংখ্য উচ্ছ্বসিত মুহূর্তের ভেতর আর্সেনাল কোচ এমন কিছু ক্ষণও পাবেন, যেসব মুহূর্ত তাঁর হাত থেকে শিরোপা ছিনিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু পরিস্থিতি এত দূর আসার কথায় ছিল না। আর্সেনাল কত সহজেই না শিরোপাটা জিততে পারত। মৌসুমের বেশির ভাগ সময় শীর্ষে থাকার পরও যেভাবে ‘গানার’দের হাত থেকে শিরোপাটা হাত ফসকে যাচ্ছে, তা উত্তর লন্ডনের ক্লাবটির সমর্থকদের আরও অনেক দিন তাড়া করে বেড়াবে।
কাগজে-কলমে আর্সেনালের শিরোপা জয়ের সম্ভাবনা অবশ্য এখনো টিকে আছে। আর সেটি হলে আর্সেনাল নিয়ে নতুন গল্পগাথাও লেখা যাবে। কিন্তু এ মুহূর্তের বাস্তবতা হচ্ছে, আজ রাতেই আর্সেনালের স্বপ্নের সলিলসমাধি হয়ে যেতে পারে। নটিংহামের বিপক্ষে হারলেই আর্সেনালের প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা জয়ের স্বপ্ন আরও অন্তত এক মৌসুমের জন্য দীর্ঘায়িত হবে। কারণ, এ ম্যাচ হারলে ৪ পয়েন্টে এগিয়ে থাকা ম্যান সিটিকে আর ছুঁতে পারবে না তারা, যা টানা তৃতীয় লিগ শিরোপা তুলে দেবে ম্যানচেস্টারের দলটির হাতে। যা সিটিকে ট্রেবল (প্রিমিয়ার লিগ, চ্যাম্পিয়নস লিগ এবং এফএ কাপ) জয়ের পথেও এক ধাপ এগিয়ে দেবে।
এমনকি আজ জিতলেও সিটিকে শিরোপাবঞ্চিত রাখতে আর্সেনালকে অপেক্ষা করতে হবে অতিনাটকীয় কিছুর। সে ক্ষেত্রে সিটিকে হাতে থাকা তিন ম্যাচেই পয়েন্ট হারাতে হবে। অর্থাৎ তিন ম্যাচ থেকে ৩ পয়েন্ট পেলেই নিশ্চিতভাবে শিরোপা জিতবে সিটি। এমনকি গোল ব্যবধানে অনেকটা এগিয়ে থাকায় ন্যূনতম ২ পয়েন্ট হলেও শিরোপা জিতবে পেপ গার্দিওলার দল। রিয়াল মাদ্রিদকে উড়িয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনাল নিশ্চিত করা সিটি এখন আত্মবিশ্বাসে টগবগ করে ফুটছে। এ অবস্থায় চেলসি ও ব্রাইটনের সঙ্গে টানা পয়েন্ট হারালে সেটি ভিন্ন এক ‘মিরাকলের’ গল্প হয়ে থাকবে।
প্রশ্ন হচ্ছে, আর্সেনাল মৌসুমের শুরু থেকে অপ্রতিরোধ্য ফুটবল খেলছিল, তারা ঠিক কোথায় পথ হারাল? ফিরে তাকালে আর্সেনাল কোচ আরতেতার মনে ভিড় জমাতে পারে মোড় বদলে দেওয়া অনেকগুলো মুহূর্ত, যেখানে সবার আগেই আরতেতার মনে পড়বে গত ১৫ ফেব্রুয়ারিতে ম্যান সিটির বিপক্ষে ম্যাচটির কথা। সেদিন নিজেদের মাঠ এমিরেটসে সিটির হাতে বিধ্বস্ত হয়েছিল আর্সেনাল।
প্রথমার্ধে ১-১ গোলে সমতা থাকার পর দ্বিতীয়ার্ধে ৩-১ গোলে ম্যাচ হেরে বসেছিল আর্সেনাল। এরপর তো সিটির বিপক্ষে তাদের মাঠেও বিধ্বস্ত হলো আর্সেনাল। কিংবা এভারটনের বিপক্ষে গুডিসন পার্কে রক্ষণের ভুলে গোল খেয়ে হারা ম্যাচটির কথাও মনে পড়তে পারে তাঁর। একই সঙ্গে পোড়াতে পারে লিভারপুলের বিপক্ষে অ্যানফিল্ডে শুরুতে ২-০ গোলে এগিয়ে গিয়েও শেষ পর্যন্ত ২-২ গোলে ড্রয়ের যন্ত্রণা। বলা যায়, পরের সপ্তাহে ওয়েস্ট হাম ম্যাচের কথাও। সেদিন বুকায়ো সাকা পেনাল্টি মিস না করলে ২-২ গোলে ড্র করতে হতো না আর্সেনালকে। আরতেতা চাইলে অবশ্য এমন আরও কিছু স্মৃতি হাতড়ে বের করতে পারেন।
অবশ্য এত কিছু না বলে পুরো বিষয়টি আরেকটু সহজ করেও বলা যায়। শিরোপা লড়াইয়ে থাকা প্রতিদ্বন্দ্বী দলটির নাম ম্যান সিটি বলেই এভাবে শিরোপা হাতছাড়া করার পথে হাঁটতে হলো আর্সেনালকে। বাকি কারণগুলো বাস্তবিক অর্থে গৌণ। আর শেষ পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে শিরোপা হাতছাড়া হয়ে গেলে সেই যন্ত্রণা কীভাবে সামলাতে হয়, তা জানতে আর্সেনাল কোচ শরণাপন্ন হতে পারেন লিভারপুল কোচ ইয়র্গেন ক্লপের।
গত কয়েক মৌসুমে সিটির শিরোপা জয়কে সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছিল ‘অল রেড’রা। তবে শুধু একবারই সিটিকে পেছনে ফেলে জিততে পেরেছে তারা। আর দুইবার মাত্র ১ পয়েন্টের জন্য শিরোপা হাতছাড়া করতে হয়েছে অ্যানফিল্ডের দলটিকে। এমনকি ২০১৮-১৯ মৌসুমে ৯৭ পয়েন্ট নিয়েও শেষ পর্যন্ত ট্রফি ঘরে তুলতে ব্যর্থ হয় লিভারপুল।
এ কারণে আর্সেনালের শিরোপা যতই হাতের মুঠোয় থাকুক, ফসকে যাওয়ার সম্ভাবনাও পাশ থেকে ঠিকই উঁকি দিচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত সেটিই এখন সত্যি হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। অথচ ২০১৭-১৮ থেকে ২০২১-২২ মৌসুম পর্যন্ত গড়ে সিটির চেয়ে ২৭.৮ পয়েন্টে পিছিয়ে থাকা আর্সেনাল এবার বেশির ভাগ সময় পর্যন্ত সিটিকে পেছনে ফেলেই ছুটেছে। কিন্তু শেষ লাইনের কাছাকাছি এসে সব গুবলেট পাকিয়ে এখন হতাশা নিয়ে মৌসুম শেষ করার অপেক্ষা।
২০১৬ সালে পেপ গার্দিওলা দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে সিটির উন্নতির গ্রাফটা প্রতিনিয়ত ঊর্ধ্বমুখী ছিল। প্রতিদ্বন্দ্বীদের জন্য আরও বড় দুঃসংবাদ হচ্ছে যতই দিন যাচ্ছে, দলটি ততই ধারালো হচ্ছে। সোনা আগুনে পুড়ে যেভাবে খাঁটি হয়, গার্দিওলার দলটিও এখন সে পথে এগিয়ে চলেছে। সিটির এমন দানবীয় উত্থানের পাশে বাকি সবাইকে ধীরে ধীরে আরও ছোট লাগছে।
চ্যাম্পিয়নস লিগের পরাক্রমশালী রিয়াল মাদ্রিদও গার্দিওলার সিটির আগুনে রীতিমতো ঝলসে গেছে, যা একই সঙ্গে মনে করিয়ে দিচ্ছে গার্দিওলার হাতে গড়া ২০০৮ সাল-পরবর্তী বার্সেলোনা দলকে। লিওনেল মেসি-জাভি-ইনিয়েস্তাদের নিয়ে রীতিমতো ভয়াল-দর্শন এক দল তৈরি করেছিলেন গার্দিওলা, অনেক দিন পর্যন্ত যে দলের ধারেকাছেও ঘেঁষতে পারেনি বাকিরা।
সিটি এখন যেখানে এসে দাঁড়িয়ে আছে, সেই অবস্থা কিন্তু এক দিনে তৈরি হয়নি। দুবাইভিত্তিক মালিকের পেট্রোডলারপুষ্ট হয়ে অঢেল খরচ করে দল গড়েছেন গার্দিওলা। যেখানে যা প্রয়োজন, তার জোগান দিয়েই অপ্রতিরোধ্য একটি দল বানিয়েছেন এই স্প্যানিশ কোচ। তবে শুধু টাকা দিয়ে তো আর দল হয় না। এখানে চাইলে উদাহরণ হিসেবে পিএসজিকেও নেওয়া যায়। তারাও টাকা ঢেলেছে ঠিক, কিন্তু সাফল্য যেন সোনার হরিণ। সিটির অপ্রতিরোধ্য হওয়ার পেছনে তাই সবচেয়ে বড় গার্দিওলার অনন্যসাধারণ ফুটবলীয় মস্তিষ্ক ও দর্শনের, যিনি প্রায় সাত বছর ধরে দলটিকে গড়ে তুলেছেন।
বর্তমানে দলগতভাবে তারা এমন অবস্থানে আছে, যা প্রিমিয়ার লিগের ইতিহাসে কখনোই দেখা যায়নি। ১৯৭০ থেকে মধ্য ’৮০ পর্যন্ত লিভারপুল ৯ লিগ শিরোপার ৭টি জিতেছিল। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডও প্রিমিয়ার লিগ যুগে একই রকম দাপট দেখিয়েছে। কিন্তু আধুনিক ফুটবলে সিটির মতো আর কেউ শিরোপা লড়াইটাকে এমন একপেশে করে ফেলেনি। নয়তো কে ভেবেছিল, কোনো দলকে ৯৭ পয়েন্ট নিয়েও দ্বিতীয় হতে হবে!
গত ছয় মৌসুমে ৫ বার শিরোপা জিতলেও সিটির বড় আক্ষেপ ছিল চ্যাম্পিয়নস লিগ জিততে না পারা। ২০১৯-২০ মৌসুমে ফাইনালে উঠেও হেরেছিল চেলসির কাছে। তবে সিটির সেই অপূর্ণতা ঘুচতে পারে আগামী কদিনের মধ্যেই। ইস্তাম্বুলে ১০ জুন রাতের ফাইনালে ইন্টার মিলানকে হারালেই ম্যান সিটির প্রথম ইউরোপ সেরার শিরোপা জেতার পাশাপাশি গার্দিওলার বৃত্তও পূরণ হবে। সঙ্গে সুযোগ আছে এফএ কাপও জিতে ট্রেবল মিশন সম্পন্ন করার। এখন কৌতূহলী প্রশ্ন হচ্ছে, টানা তিন লিগ শিরোপা ও চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতার মধ্য দিয়ে সিটির শিরোপাক্ষুধা কি শেষ হবে?
তবে এখানেও বাকিদের জন্য আছে হতাশার খবরই। চলতি মৌসুমে সিটির পারফরম্যান্স, স্কোয়াড ও গার্দিওলার ট্যাকটিক্যাল স্থিতিশীলতাকে বিশ্লেষণ করলে বোঝা যাবে, সিটি মাত্রই সেরা ছন্দে এসেছে। আর্লিং হলান্ড-হুলিয়ান আলভারেজদের এখনো অনেক দূর যাওয়া বাকি। ফলে আগামী আরও কয়েক মৌসুম সিটির মসনদ হারানোর সম্ভাবনা বেশ ক্ষীণ, যা প্রিমিয়ার লিগ ও ইউরোপিয়ান প্রতিদ্বন্দ্বীদের জন্য অশনিসংকেত হয়েই থাকছে।