‘স্যালভেশন’ (পরিত্রাণ বা মুক্তি)—৯৮ মিনিটে রিকার্দো কালাফিওরির সহায়তায় মাতিয়া জাকাগনি গোল করার পর ধারাভাষ্যে থাকা পিটার ড্রুরির প্রথম উচ্চারিত শব্দ ছিল এটি। ১-০ গোলে পিছিয়ে বিদায়ের শঙ্কা কাঁপতে থাকা দলটি যখন ম্যাচের শেষ মিনিটে গোল করেন, তখন সেটি তো পরিত্রানই। এই বল কোনোভাবে গোল না হয়ে ডেড হয়ে গেলেই বাজত শেষ বাঁশি। ৩ পয়েন্ট নিয়ে ইতালিকে তখন অপেক্ষা করতে হতো তৃতীয় সেরা দলগুলোর একটি হয়ে পরের পর্বে যাওয়ার। কিন্তু জাকাগনির গোল ইতালিকে সেই দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্তি দিয়ে তুলে দিয়েছে শেষ ষোলোয়।
ম্যাচ জেতানো এই গোলের মালিক জাকাগনি হলেও গোলটির প্রকৃত নায়ক আসলে কালাফিওরি। আর গোলটি তাঁর জন্যও ছিল স্যালভেশন বা পরিত্রাণ। আগের ম্যাচে তাঁর আত্মঘাতী গোলেই স্পেনের কাছে হেরেছিল ইতালি। আজ্জুরিদের শেষ ষোলোতে নিয়েই যেন সেই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করেছেন তিনি। যদিও সেই আত্মঘাতী গোলে তাঁর ভূমিকা ছিল সামান্যই। কিন্তু ভুল তো ভুলই। গোলের পাশে নামটা তো তাঁরই লেখা থাকবে। ক্যারিয়ারের শুরুতে যন্ত্রণার তির হয়ে বিদ্ধ করা সেই মুহূর্ত ভুলতেই ক্রোয়েশিয়া ম্যাচ শেষে অঝোরে কেঁদেছেন কালাফিওরি। সেই কান্না যে শুধু ইউরোতে টিকে থাকার আনন্দে নয়, তা তো বলাই যায়।
ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে ইতালি যখন হারের অপেক্ষায় ছিল, তখনই মূলত মাঝমাঠ থেকে দৌড়টা শুরু করেছিলেন কালাফিওরি। এই সেন্টার-ব্যাক যখন প্রতিপক্ষ ডি-বক্সের কাছাকাছি আসেন, তখন তাঁকে ঘিরে ধরেছিল ক্রোয়েশিয়ার ৯ খেলোয়াড়। চাইলে তখনই পাস দিতে পারতেন সামনে অপেক্ষায় থাকা তিন খেলোয়াড়ের যে কাউকে। কিন্তু কালাফিওরি তা না করে আরও একটু এগিয়ে বক্সের লাইনে চলে আসেন। তাঁকে ঠেকাতে ক্রোয়েশিয়ার খেলোয়াড়েরাও সামনের দিকে এগিয়ে আসেন।
একেবারে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করেই তিনি বল বাড়ান বাঁ প্রান্তে কিছুটা পিছিয়ে থাকা জাকাগনিকে। বল পায়ে যাওয়ার পর লাৎসিওর এই উইঙ্গারের সামনে ছিল কেবল ক্রোয়াট গোলরক্ষক লিভাকোভিচ। ওয়ান টু ওয়ান পরিস্থিতিতে দুর্দান্ত এক বাঁকানো শটে বাকি কাজ সারেন জাকাগনি। এই গোলে জাকাগনিকে ফিনিশিংয়ের কৃতিত্ব না দেওয়া অন্যায় হবে। কিন্তু সেটা মনে রেখেই বলতে হয়, কালাফিওরির মেধা ও দূরদর্শিতা ছাড়া এই গোল কখনোই সম্ভব ছিল না।
একজন সেন্টার–ব্যাক হিসেবে কালাফিওরি যা করেছেন, তা মূলত একজন শীর্ষ সারির প্লে-মেকারের কাজ। অবশ্য এই ম্যাচে দলের আক্রমণে কালাফিওরির অবদানের দিকে তাকালে কে বলবে তিনি আসলে একজন সেন্টার–ব্যাক!
এই ম্যাচে বোলোনার এই ডিফেন্ডারের পরিসংখ্যান ছিল এমন: অ্যারিয়াল ডুয়েলে শতভাগ জয়, ক্রসের যথার্থতা শতভাগ, সঠিক পাস ৯৩ শতাংশ, পাস সম্পন্ন করেছেন ৫৭টি, বল ক্লিয়ার করেছেন ৫টি, সুযোগ তৈরি ৪টি (দলের হয়ে সবচেয়ে বেশি), বড় সুযোগ সৃষ্টি ১টি এবং অ্যাসিস্ট ১টি। একজন সেন্টার–ব্যাকের কাছ থেকে দলের আক্রমণভাগে এমন পারফরম্যান্স নিঃসন্দেহে অনবদ্য। মাত্র ২২ বছর বয়সেই তাঁর মধ্যে খোঁজা হচ্ছে পাওলো মালদিনি, আলেসান্দ্রো নেস্তা কিংবা ফ্যাবিও ক্যানাভারোর ছায়া। ধ্রুপদি ইতালিয়ান রক্ষণের যে দৃঢ়তা ও কার্যকারিতার সবটুকুই আছে তাঁর খেলায়।
এবারের ইউরো দিয়েই মূলত আকর্ষণের কেন্দ্রে চলে এসেছেন কালাফিওরি। সিরি ‘আ’র ফুটবল যাঁরা নিয়মিত অনুসরণ করেন না, তাঁদের পক্ষে কালাফিওরিকে সেভাবে চেনার কথা নয়। রোমার একাডেমি থেকে উঠে আসা এই ফুটবলার এমন কিছু নিয়ে এসেছেন, অনেক দিন ধরে যার অপেক্ষায় ছিলেন ইতালীয়রা। কালাফিওরি এরই মধ্যে পরিচিতি পেয়েছেন অ্যাটাকিং সেন্টার-ব্যাক হিসেবে।
উত্থানপর্বেই অবশ্য বড় ধাক্কা খেয়েছিলেন কালাফিওরি। ৬ বছর আগে হাঁটুর মারাত্মক চোটে পড়েন তিনি। এই চোটে শেষ হয়ে যেতে পারত তাঁর ক্যারিয়ার। এ চোট নিয়ে সে সময় চিকিৎসকেরা বলেছিলেন, এমন চোট সাধারণত ফুটবলে নয়, দেখা যায় মোটোক্রসে (একধরনের মোটরসাইকেল প্রতিযোগিতা, যা মূলত বিশেষভাবে তৈরি করা জটিল রাস্তায় খেলা হয়।) এমনকি প্রতি ১০ বছরে সাধারণত একজন মানুষ এই চোটের শিকার হন বলেও মন্তব্য করেন এক চিকিৎসক।
কিন্তু অবিশ্বাস্য এই চোটকে ঠিকই ট্যাকল করে সামলে নিয়েছেন কালাফিওরি। ফুটবলকে ভালোবেসে কখনো তিনি হাল ছাড়েননি; কঠোর পরিশ্রম করে আবার ফিরে এসেছেন। সেই চোটই অবশ্য শাপেবর হয়েছিল রোমে জন্ম নেওয়া এই ফুটবলারের জন্য। কীভাবে সেটা তাঁর মুখেই শোনা যাক, ‘সেই সময়ে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ ছিল না; জেতার জন্য কোনো ফাইনাল ছিল না। সেটা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বড় লড়াই। আমার হাল ছেড়ে দেওয়ার সুযোগ ছিল না।’ সেই হাল না ছাড়ার প্রত্যয়টুকুই তৈরি করেছে আজকের কালাফিওরিকে। যার দেখা মিলেছে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে ম্যাচেও।
রোমা, জেনোয়া ও বাসেল হয়ে এখন খেলছেন বোলোনায়। রোমায় জন্ম নেওয়ায় অনেকে ভেবেছিলেন, কালাফিওরি হয়তো দানিয়েল দি রসি ও ফ্রান্সিসকো টট্টিদের পথ ধরে শহরের ক্লাবটিতেই থেকে যাবেন। কিন্তু নানা হিসাব-নিকাশের ভেতর ক্লাব ছাড়তে হয় তাঁকে। কালাফিওরিকে হারানোর যন্ত্রণা এখনো পোড়ায় ডি রসিকে। তবে খেলোয়াড় হিসেবে বিবর্তনে তাঁকে সহায়তা করেছেন বোলোনার তখনকার কোচ থিয়াগো মোত্তা। ইতালীয় এই কোচই কালাফিওরিকে লেফট ব্যাক থেকে নিয়ে এসেছেন সেন্টার–ব্যাক পজিশনে। এই পজিশনে তাঁকে এখন ভবিষ্যতের মালদিনি-নেস্তা ভাবতে শুরু করেছেন অনেকে।
মালদিনি-নেস্তার কাতারে যাওয়া এখনো দূরের বাতিঘর। তবে ক্যারিয়ারের শুরুতে যে দৃঢ়তা ও আত্মবিশ্বাস কালাফিওরির অবয়ব থেকে উপচে পড়তে দেখা গেছে, তা ইতিবাচক এক পথচলারই ইঙ্গিত দিচ্ছে। তবে আপাতত কালাফিওরিকে নিয়ে একটি আক্ষেপও আছে। কার্ড দেখে এক ম্যাচের নিষেধাজ্ঞা পাওয়ায় শেষ ষোলোয় সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে খেলা হবে না তাঁর। এখন এই সেন্টার–ব্যাকের অভাব বাকিরা মেটাতে পারেন কি না, সেটাই দেখার অপেক্ষা।