২০২১ সালের নভেম্বর, খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে বার্সেলোনা। মৌসুম শুরুর আগে লিওনেল মেসির বিদায়, অর্থনৈতিক সংকট এবং পয়েন্ট টেবিলে সেরা চারে থাকা নিয়ে দুশ্চিন্তা—সব হারানোর আশঙ্কায় রীতিমতো কাঁপছিল কাতালান ক্লাবটি। এমন পরিস্থিতিতে কোচের দায়িত্ব নেওয়ার আগে যে কেউ দ্বিতীয়বার ভাববেন। কিন্তু জাভি হার্নান্দেজের সে সুযোগ ছিল না। ঘরের ডাকে সাড়া দিয়ে বার্সেলোনার দিন বদলে দেওয়ার স্বপ্ন নিয়ে সাবেক ক্লাবের কোচ হয়ে আসেন স্প্যানিশ কিংবদন্তি। মাঝ মৌসুমেই স্থলাভিষিক্ত হন রোনাল্ড কোমানের।
আবেগে তাড়িত হয়ে দায়িত্ব নিলেও তা পালন করাটা জাভির জন্য সহজ ছিল না। খেলোয়াড় হিসেবে জাভি যখন বার্সা ছেড়েছিলেন, তখন ক্লাবটি ছিল ট্রেবল বিজয়ী। ইউরোপের মহাপরাক্রমশালী ক্লাবগুলোর একটি। কিন্তু কোচ হিসেবে যে বার্সেলোনার দায়িত্ব নেন, সেটি ছিল পতিত। সংকট আর ব্যর্থতায় গোটা দলের আত্মবিশ্বাস তখন তলানিতে।
এমনকি বার্সার কোনো শিরোপা না জেতার বয়সও পেরিয়ে গেছে আড়াই বছর। আরেকটি শিরোপা জেতার সম্ভাবনাও দূরের বাতিঘর। সব জেনেও বিপদগ্রস্ত দলটির ডাকে সাড়া না দিয়ে পারেননি জাভি। হতে চেয়েছিলেন পতিত বার্সার পাবন। শুরু করলেন দলকে নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর নতুন এক লড়াই; গতকাল রাতে যে লড়াইয়ের ইতি টানার ঘোষণা দিলেন জাভি নিজেই। বললেন, ক্লাবের ভালোর জন্যই এমন সিদ্ধান্ত।
বিদায়বেলায় জাভি জানিয়েছেন, কেউ একজন নাকি তাঁকে বলেছিল বার্সেলোনার স্যার আলেক্স ফার্গুসন হতে। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে যিনি ২৭ বছর দায়িত্ব পালন করে পেয়েছিলেন অসামান্য সব সাফল্য। কিন্তু আধুনিক ফুটবলে এ ধারা বদলে গেছে আরও আগে। এমন কিছুর স্বপ্ন দেখা রীতিমতো অসম্ভব! এখন সবকিছুই মাপা হয় তড়িৎ সাফল্য দিয়ে।
এক দুই ম্যাচের ব্যর্থতাতেই গুটাতে হয় পাততাড়ি। তাই কোচদের ব্যাগও নাকি গুছানো থাকে। যদিও জাভির জন্য নিয়মটা একই রকম হওয়ার কথা ছিল না। বিশেষ করে দুই বছরে দলটিতে যেসব পরিবর্তন তিনি নিয়ে এসেছেন, সেসব বিবেচনায় নিলে। জাভিকে অবশ্য ক্লাব ছাঁটাই করেনি, তিনি নিজেই সরে গেছেন। কিন্তু টানা ব্যর্থতার পর চাপটাও যে সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
দুই বছর আগে জাভি দায়িত্ব নেওয়ার পর তাঁর প্রথম কাজ ছিল ছন্নছাড়া দলটিতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং যেকোনোভাবে দলকে চ্যাম্পিয়নস লিগে পৌঁছে দেওয়া। তবে বার্সা কোচের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল দলের মাঝে হারানো আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনা। একসময়ের সতীর্থ ও অভিজ্ঞ সের্হিও বুসকেতসের কাছ থেকে দলের পুরো চিত্র বুঝে নিয়েই নিজের লড়াইয়ে নামেন জাভি।
পুরো দলকে একসূত্রে গাঁথতে হারিয়ে যাওয়া নিয়মগুলোও তিনি ফিরিয়ে আনেন। দেরি করে অনুশীলনে এলে জরিমানা এবং বেশি দেরি করলে উচ্চ জরিমানার নিয়মও চালু করেন জাভি। অনুশীলন শুরুর দেড় ঘণ্টা আগে মাঠে আসার নিয়মও জারি করেন তিনি। দলীয় ঐক্য বাড়ানোর লক্ষ্যে একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া এবং সময় কাটানোর নিয়মও ঠিক করে দেন জাভি। এ ছাড়া খেলোয়াড়দের খাদ্যশৃঙ্খলা ও পুষ্টি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বও নিজের কাঁধে নেন এই স্প্যানিশ কোচ।
এরপর জাভি মনোযোগ দেন নিজের পরিকল্পনাকে মাঠে বাস্তবায়ন করার মতো খেলোয়াড় কেনার দিকেও। একই সঙ্গে ক্লাবের সংস্কৃতি এবং নিজের কৌশলের সঙ্গে বেমানান খেলোয়াড়দের বিদায়ের রাস্তাও করে দেওয়া হয়। সে সময় বেশ কিছু কঠিন সিদ্ধান্তও নিতে হয় জাভিকে। অভিজ্ঞতার পাশাপাশি তারুণ্যকে গুরুত্ব দিতে শুরু করেন বিশ্বকাপজয়ী এই ফুটবলার। জাভির অধীন গত দুই বছরে বেশ কয়জন উদীয়মান তরুণের অভিষেক হয়েছে।
জাভির অধীন খেলেই গাভি-পেদ্রি-ইয়ামালরা নিজেদের মেলে ধরার সুযোগ পেয়েছেন। নিজের কৌশলের কারণে একসময়ের সতীর্থ ও বন্ধু জেরার্দ পিকেকে বেঞ্চে বসানোর কঠিন সিদ্ধান্তও নিতে হয়েছিল তাঁকে। পাশাপাশি গোল স্কোরিংয়ে শক্তি বাড়াতে তিনি রবার্ট লেভানডফস্কির মতো হাইপ্রোফাইল খেলোয়াড়কেও দলে নিয়ে আসেন। জাভির হাত ধরেই রক্ষণে চাপের মুখে ধসে পড়া বার্সাও এ সময় বেশ দৃঢ়তা পায়। সব মিলিয়ে বলা যায় একেবারে শূন্য থেকেই দলকে আবার নতুন করে গড়ে তুলেছিলেন ২০১৯ সালে কাতারের ক্লাব আল সাদে কোচিং ক্যারিয়ার শুরু করা জাভি।
পদ্ধতিগতভাবে জাভি যে ভুল পথে হাঁটেননি, সে প্রমাণ দ্রুতই পাওয়া যায়। তাঁর হাত ধরেই ধীরে ধীরে সঠিক পথে ফিরতে শুরু করে বার্সা। ক্লাবটিও পেতে শুরু করে ফল। ২০২১-২২ মৌসুমে যে ক্লাবটি সেরা চারে টিকে থাকার শঙ্কায় ভুগছিল, সেই দলটিই পরের মৌসুমে জিতে নেয় লিগ শিরোপা। এর আগে অবশ্য চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রিয়াল মাদ্রিদকে হারিয়ে বার্সাকে স্প্যানিশ সুপার কাপের শিরোপাও এনে দেন জাভি।
এরপর নতুন মৌসুমে সব কটি ট্রফিতে চোখ রেখেই যাত্রাটা শুরু করেছিল জাভির বার্সা। শুরুটা ভালোই হয়েছিল। কিন্তু লিগ দৌড়ে পিছিয়ে পড়ার পাশাপাশি অল্প সময়ের ব্যবধানে দুটি ঘরোয়া ট্রফিও হারায় বার্সা। স্প্যানিশ সুপার কাপে রিয়ালের কাছে শিরোপা হাতছাড়া করার পর বিদায় নিতে হয়েছে কোপা দেল রে থেকেও। লিগে ২১ ম্যাচ শেষে শীর্ষে থাকা রিয়ালের চেয়ে ১০ পয়েন্টে পিছিয়ে আছে বার্সা। চ্যাম্পিয়নস লিগে অবশ্য আগের দুবারের ব্যর্থতা ভুলে এবার শেষ ষোলোর টিকিট পেয়েছে কাতালান ক্লাবটি; যদিও তা যথেষ্ট ছিল না। সংবাদমাধ্যম এবং সমর্থকদের কাছ থেকে চাপ ক্রমেই বাড়ছিল। কে জানে, হয়তো এমন পারফরম্যান্সের পর বার্সা কর্তৃপক্ষও জাভিকে আর ডাগআউটে দেখতে চায়নি। আর এসবের ফলস্বরূপ শেষ পর্যন্ত দায়িত্ব ছাড়ার ঘোষণাই দিতে হলো জাভিকে।
দায়িত্ব নেওয়ার আগে ২০২১ সালের অক্টোবরে জাভি বলেছিলেন, বার্সার কোচ হওয়া তাঁর স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন পূরণও হয়েছিল। চেয়েছিলেন ক্লাবকে সঙ্গে নিয়ে আরও বড় স্বপ্ন পূরণের পথে হেঁটে যেতে। কিন্তু সেই স্বপ্ন আর এযাত্রায় পূরণ হলো না জাভির!