ক্যারিয়ারের গোধূলিবেলায় নিউইয়র্ক কসমসে খেলার সময়টুকু বাদ দিলে মহারাজা পেলে কখনোই তাঁর ফুটবল নিয়ে ব্রাজিলের বাইরে যাননি। আরেক কিংবদন্তি গারিঞ্চাকেও কিংবদন্তি হওয়ার জন্য ব্রাজিলের বাইরের যেতে হয়নি। আর্জেন্টিনার ক্ষেত্রে বলা যায় অ্যাঞ্জেল লাবরুনা বা হোসে ম্যানুয়েল মোরেনোর কথা। সর্বকালের সেরার তালিকায় থাকা এই ফুটবলাররা কখনোই ইউরোপে খেলেননি। প্রশ্ন হচ্ছে, সাম্প্রতিক সময়ে এ দুই দেশের কোনো ফুটবল-প্রতিভার পক্ষে কি ইউরোপে না গিয়ে সর্বকালের সেরা দূরে থাক, সময়ের সেরা হওয়াও কি সম্ভব? উত্তরটা কেউ চাইলে অবশ্য এক শব্দে দিতেই পারেন—নাহ!
অন্তত সাম্প্রতিক অতীতে তেমন কোনো দৃষ্টান্ত নেই এবং অদূর ভবিষ্যতে হতে পারে, সেটিও দূরের বাতিঘর। দক্ষিণ আমেরিকান ফুটবলের নিম্নগামী মান এবং ইউরোপিয়ান ফুটবলের উৎকর্ষতাই এর অন্যতম কারণ। তাই কেউ সেরা হতে চাইলে তাঁকে লাতিন আমেরিকা ছেড়ে যেতে হবে ইউরোপেই। লিওনেল মেসি, নেইমার, আনহেল দি মারিয়া, কাসেমিরো, থিয়াগো সিলভা থেকে শুরু করে হালের ভিনিসিয়ুস-রদ্রিগো-আলভারেজ-ম্যাক অ্যালিস্টাররা সেই পথেই হেঁটেছেন। আর্জেন্টিনাকে ৩৬ বছর পর বিশ্বকাপ জেতানো মেসির শিকড়টা তো সেই ক্যাম্প ন্যুয়ের লা মাসিয়াতেই পোঁতা!
এই ধারা মেনেই প্রায় প্রতি মৌসুমে তরুণ তুর্কিরা ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা ছেড়ে চলে আসেন ইউরোপে। যাঁদের অনেকেই ইউরোপের ফুটবল–নন্দনে রাখতে শুরু করেন নিজেদের পদচ্ছাপ। কেউ কেউ হয়ে ওঠেন সময়ের সেরা তারকাও। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার তেমনই একটি প্রজন্ম এখন ইউরোপিয়ান ফুটবলে নিজেদের রাজত্ব তৈরির অপেক্ষায় আছেন। যাঁদের কেউ কেউ এরই মধ্যে নিজেদের আগমনী ঘোষণা করেছেন। আর কেউ কেউ হাঁটছেন সে পথে। শিগগিরই এসে পৌঁছাবেন এবং ফুটবল–জাদুতে ছড়াবেন মুগ্ধতা।
ব্রাজিল বরাবরই ফুটবলের উর্বর ভূমি। জাতীয় দল হিসেবে ব্রাজিলের ফুটবল সাম্প্রতিক সময়ে ধুঁকলেও দেশটিতে তারকার অভাব আছে, তা বলার সুযোগ নেই। বরাবরের মতো একদল তরুণ এখন ইউরোপের সেরা ক্লাবগুলোয় মুগ্ধতা ছড়াচ্ছেন। রিয়াল মাদ্রিদের ভিনিসিয়ুস-রদ্রিগোরা সময়ের সেরার তালিকায় নিশ্চিতভাবে জায়গা পাবেন। গত বছরের মে মাসের এক হিসাবে দেখা গেছে, সামগ্রিকভাবে খেলোয়াড় রপ্তানিতে সবচেয়ে এগিয়ে ছিল ব্রাজিল। তবে সে তালিকা গত কয়েক মাসে নিশ্চিতভাবে আরও সমৃদ্ধ হয়েছে। যেখানে ফুটবলের ভবিষ্যৎ বিবেচিত হওয়ার কিছু তারকাও এখন ইউরোপে নিজেদের মেলে ধরার অপেক্ষায় আছেন।
ব্রাজিলের যেসব প্রতিভা নিজেদের জাদু দেখাতে যাচ্ছেন, তাঁদের অন্যতম ভিতর রকি। এরই মধ্যে স্প্যানিশ পরাশক্তি বার্সেলোনায় নিজের যাত্রা শুরু করেছেন তিনি। চলতি মৌসুমে যোগ দিয়ে ৭টি ম্যাচও খেলে ফেলেছেন। লা লিগায় ৫ ম্যাচ খেলে করেছেন দুটি গোল। বার্সার এই উদীয়মান স্ট্রাইকার বক্সের ভেতর রীতিমতো অপ্রতিরোধ্য। গতি ও আগ্রাসনে যেকোনো শক্তিশালী রক্ষণকে একাই নাস্তানাবুদ করার সামর্থ্য আছে তাঁর।
মাঠে যেকোনো পরিস্থিতিতে জায়গা বের করা এবং বিদ্যুৎ–গতিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রেও রকি অনন্য। অনেকে তাঁকে রোনালদো নাজারিওর সঙ্গে তুলনা করে ‘নতুন রোনালদো’ও বলছেন। দলের প্রয়োজনে উইংসহ একাধিক পজিশনে খেলতে পারেন রকি। তবে ধারাবাহিকতার অভাব তাঁকে ভোগাতে পারে। অবশ্য বার্সেলোনার মতো ক্লাবে সঠিক পরিচর্যা পেলে এ সমস্যা উতরে যাওয়া রকির জন্য মোটেই কঠিন কিছু নয়।
রকির বন্ধু ফিলিপে এনদ্রিকও একই সময়ে রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে নিজের যাত্রাটা শুরু করতে পারতেন। বাদ সেধেছে মূলত তাঁর বয়স। ১৮ বছর পূর্ণ না হওয়ায় সব চূড়ান্ত হওয়ার পরও রিয়ালের হয়ে এখনই খেলা হচ্ছে না তাঁর। যদিও সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর ক্লাবটির হয়ে নিজের নতুন যাত্রা শুরু করতে খুব বেশি অপেক্ষা করতে হবে না তাঁকে। এনদ্রিককে পেতে অপেক্ষায় আছে রিয়ালও। সহজাত ফুটবল–প্রতিভায় নজড়কাড়া এই এনদ্রিক ব্রাজিলের হয়ে অলিম্পিক বাছাইয়েও দুর্দান্ত ফুটবল উপহার দিচ্ছেন। লেগে থাকা মার্কারকে মুহূর্তের মধ্যে ছিটকে দিয়ে এলোমেলো করে দিতে পারেন প্রতিপক্ষের রক্ষণকে। পাশাপাশি শারীরিক গড়ন ইউরোপে বাড়তি সুবিধা দেবে এনদ্রিককে।
সাভিও অবশ্য এখনই ইউরোপে উঠতি তারকার স্বীকৃতি পাচ্ছেন। চলতি মৌসুমে লা লিগায় জিরোনার চমক দেখানোর নেপথ্যের নায়কও এই ব্রাজিলিয়ান। এরই মধ্যে ১৯ বছর বয়সী এই ফরোয়ার্ডকে পেতে মরিয়া হয়ে মাঠে নেমেছে ম্যানচেস্টার সিটি। সাভিও নিজেও বলেছেন, ‘আমি আগামী মৌসুমে সিটিতে খেলতে চাই।’ শেষ পর্যন্ত সাভিও-সিটি জুটি বাঁধলে সেটা ইউরোপিয়ান ফুটবলে নতুন এক রোমাঞ্চই নিয়ে আসবে।
ইউরোপ মাতানোর অপেক্ষায় থাকা খেলোয়াড়দের তালিকায় বলা যায় লুকাস বেরালদোর নামও। এই জানুয়ারিতেই সাও পাওলো থেকে পিএসজিতে যোগ দিয়েছেন ২০ বছর বয়সী বেরালদো। সেন্টারব্যাক পজিশনে খেলা এই তরুণ প্যারিসের ক্লাবটির হয়ে ৬ ম্যাচ খেলেও ফেলেছেন। রক্ষণকে দৃঢ়তা দেওয়ার পাশাপাশি দলের আক্রমণে ভিত গড়ে দেওয়ার দারুণ সামর্থ্যও আছে তাঁর। বলের ওপর নিয়ন্ত্রণ ও দখলেও বাকিদের চেয়ে বেশ এগিয়ে বেরালদো।
তরুণ স্ট্রাইকার মার্কোস লিওনার্দোও অদূর ভবিষ্যতে ইউরোপিয়ান ফুটবলে ব্রাজিলিয়ান সুবাস নিয়ে আসতে পারেন। সহজাত এই গোলস্কোরার জানুয়ারিতে নাম লিখিয়েছেন বেনফিকায়। পর্তুগিজ এই ক্লাবে নিজের প্রতিভার আলো ছড়াতে পারলে ইউরোপের অন্য শীর্ষ ক্লাবগুলোও দূরের পথ নয়। দুই পায়ে কার্যকর লিওনার্দোর পজিশনিংও দারুণ। সব মিলিয়ে সেরা হওয়ার সব উপাদানই আছে লিওনার্দোর। এখন শুধু এগিয়ে যাওয়ার পালা।
মেসির সঙ্গে আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জেতায় বড় ভূমিকা ছিল একদল তরুণের। হুলিয়ান আলভারেজ-এনজো ফার্নান্দেজরা দারুণভাবে সংগত না করলে মেসির জন্য মিশনটা অনেক কঠিনই হয়ে যেত। তবে এই তরুণদের বাইরেও আরও অনেকেই আছেন, যাঁরা উঠে আসছেন আর্জেন্টিনার ফুটবলকে এগিয়ে নিতে। বিশ্বকাপ–পরবর্তী সময়ে আর্জেন্টিনার ফুটবলে নতুন দিনের কথা বললে সবার আগে আসে আলেহান্দ্রো গারনাচো ও ক্লদিও এচেভেরির নাম। গারনাচো অবশ্য আগেই থেকেই আলোচনায় ছিলেন। অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপ দিয়ে নিজেকে চেনান এচেভেরিও।
শুরুতে ‘মেসি–ম্যারাডেনা’র মিশ্রণে তৈরি এচেভেরির কথাই বলা যাক। এই আর্জেন্টাইনের প্রতিভার ঝলক বুঝতে হলে ফিরে যেতে হবে ২০২৩ অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রাজিলের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করা ম্যাচটিতে। যেখানে প্রতিটি গোলই ছিল নান্দনিকতায় ভরপুর। ২৮ মিনিটে প্রথম গোলটি ছিল মাঝমাঠ থেকে একক প্রচেষ্টায়। ৫১ মিনিটে দ্বিতীয় গোল ছিল বল নিয়ন্ত্রণের মাস্টারক্লাস। বাঁ প্রান্তে পাস পেয়ে দৌড়ের ওপর এক স্পর্শেই বল সামনে ফেলে ব্রাজিলের তিন ডিফেন্ডারের মাঝ দিয়ে কোনাকুনি শটে লক্ষ্যভেদ করেন এচেভেরি। আর শেষ গোলটি লাতিন আমেরিকার প্রথাগত স্ট্রাইকারদের মতো।
মাঝমাঠ থেকে থ্রু পাস পেয়ে গায়ের সঙ্গে লেপটে থাকা ব্রাজিলের এক ডিফেন্ডারকে পেছনে ফেলে গোলকিপারকেও একা পেয়ে যান এচেভেরি। তাঁকে কাটিয়েই পূর্ণ করেন হ্যাটট্রিক। এচেভেরির এমন প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে তাঁকে কিনে নিয়েছে ম্যান সিটি। আপাতত ধারে থাকবেন রিভার প্লেটেই। এরপর আগামী বছরের জানুয়ারিতে আসবেন সিটিতে।
বয়স মাত্র ১৯, কিন্তু গারনাচোর জন্য বয়স যেন কোনো বিষয়ই নয়। যে বয়সে অনেকেই যখন ইউরোপে আসার পথ খুঁজছেন, গারনাচো তখনই প্রিমিয়ার লিগে দ্যুতি ছড়াচ্ছেন নিজের ফুটবল-জাদুতে। গত বছরের ২৭ নভেম্বর এভারটনের বিপক্ষে ওভার হেডে কিকে গোলটাই যেন গারনাচোর প্রতিভার সাক্ষ্য দিচ্ছে। তবে দৃষ্টিনন্দন গোলের পাশাপাশি তাঁর ধারাবাহিকতাও দারুণ। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের দুর্দিনেও নিজেকে প্রতিনিয়ত প্রমাণ করে যাচ্ছেন। পথচলাটা মাত্র শুরু, যেতে হবে বহুদূর।
কিছুদিন ধরেই আলোচনায় আর্জেন্টাইন তরুণ নিকো পাজ। আর্জেন্টিনার সাবেক ফুটবলার পাবলো পাজের ছেলে নিকোর জন্ম স্পেনে। রিয়াল মাদ্রিদের বয়সভিত্তিক দলে প্রস্তুত হয়ে যাত্রা শুরু করেছেন মূল দলে। এরই মধ্যে রিয়ালের হয়ে ৮ ম্যাচ খেলেছেন ১৯ বছর বয়সী এই তরুণ। চ্যাম্পিয়নস লিগে গোলও পেয়েছেন এই মিডফিল্ডার। এখন তারকাবহুল রিয়ালে নিজের জায়গাটা পাকা করতে পারলে নিকোর এগিয়ে যাওয়াটা শুধুই সময়ের ব্যাপার।
জানুয়ারির দলবদলে বোকা জুনিয়র্স থেকে ব্রাইটনে এসেছেন ১৯ বছর বয়সী ভ্যালেন্টিন ভারকো। প্রিমিয়ার লিগে অভিষেকের অপেক্ষায় থাকা ভারকো এর আগে আলো ছড়িয়েছেন বোকায়। লেফট উইঙ্গার হিসেবে গতিতে চমকে দেওয়ার পাশাপাশি বলের ওপর তাঁর নিয়ন্ত্রণও চমৎকার। পাশাপাশি উইং-ব্যাক হিসেবেও নিজের ছাপ রাখার সুযোগ আছে তাঁর। ব্রাইটনে নিজেকে মেলে ধরতে পারলে শীর্ষ ক্লাবগুলোও হয়তো লুফে নেবে তাঁকে।
ওপরের নামগুলোর বাইরে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার আরও অনেকেই আছেন, যাঁরা সামনের দিনগুলোয় ইউরোপে নিজের ছাপ রাখতে পারেন। প্রতিভা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। সঠিক পরিচর্যা, আত্মবিশ্বাস এবং শৃঙ্খলা তাঁদের পৌঁছে দিতে পারে সেই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে।