যুক্তরাষ্ট্রের ফুটবলকে বদলে দিচ্ছেন মেসি
যুক্তরাষ্ট্রের ফুটবলকে বদলে দিচ্ছেন মেসি

মেসির হাত ধরে ‘সকার’ যেভাবে ‘ফুটবল’

আমি ইন্টার মায়ামিতে যাচ্ছি’—মেসির এই ঘোষণা যেন যুক্তরাষ্ট্রের ফুটবলে ঐতিহাসিক এক বিপ্লবের সূচনা করেছে। এই এক ঘোষণাতেই দেশটির খেলাধুলার ইতিহাসকে এখন নতুন করে লিখতে হচ্ছে। মেসির সেই ঘোষণার পর যুক্তরাষ্ট্রের খেলাধুলায় চতুর্থ স্থানে থাকা ফুটবলের জগৎও মুহূর্তের মধ্যে বদলে গেল। অনেকটা আকস্মিকভাবে এখন ‘সকার’ হয়ে উঠেছে ‘ফুটবল’।

এমনকি এখনো যাঁরা মেসির আগমন সম্পর্কে জানেন না, তাঁরাও যখন মায়ামির হাইওয়ে ধরে সারি সারি পামগাছের পাশ দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যান, দেখবেন আকাশছোঁয়া বিলবোর্ডগুলো। যেখানে গোলাপি জার্সি গায়ে মেসির ছবির সঙ্গে লেখা আছে, ‘এখন দেখা যাচ্ছে অ্যাপল টিভিতে।’ অবশ্য এই বিজ্ঞাপনের আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে কি না, সেই প্রশ্ন চাইলে কেউ তুলতেই পারেন। কারণ, গোটা যুক্তরাষ্ট্রই যে এখন মেসি-ম্যানিয়ায় আক্রান্ত।

মেসির আগমন কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রের ফুটবলকে বদলে দিচ্ছে তাঁর অভিষেক ম্যাচের দিকে তাকালেই কিছুটা ধারণা পাওয়া যাবে। ইন্টার মায়ামি বলছে, তারা চাইলে গত শনিবার হয়ে যাওয়া মেসির অভিষেক ম্যাচের টিকিট ৫ গুণ বেশি বিক্রি করতে পারত। সেদিনের ম্যাচের টিকিট ফুরিয়ে গিয়েছিল মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে। এমনকি সেই টিকিটগুলো পরদিন ১ হাজার ডলারে পুনঃবিক্রয় করা হয়েছে। এ ছাড়া গত মৌসুমে ইন্টার মায়ামির মাঠে দর্শকের গড় উপস্থিতি ছিল ১৬ হাজার ৪৮২টি। আর মেসির অভিষেক ম্যাচের ২১ হাজার টিকিট ফুরিয়ে গিয়েছিল মুহূর্তের মধ্যে। শুধু এটুকুই নয়, অনেকের জন্য মেসির অভিষেকের ম্যাচটিই ছিল তাঁদের দেখা প্রথম এমএলএস ম্যাচ।

অভিষেক ম্যাচে গোলের পর মেসি

দুই ভাতিজা অ্যালেক্স ও গ্যাব্রিয়ালকে নিয়ে খেলা দেখতে আসা পল লার্নার মেসির অভিষেকের সাক্ষী হওয়ার প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ‘আমি ২৫ বছর ধরে আমেরিকায় আছি এবং এটা আমার প্রথম সকার (ফুটবল) ম্যাচ। আমি বেসবল, আমেরিকান ফুটবল এবং বাস্কেটবল অনেক দেখেছি। এমনকি ল্যাক্রোসও দেখেছি। কিন্তু কখনো সকার দেখিনি। আমি এটা থেকে মুখ ফিরিয়েছিলাম। আমি ইউরোপিয়ান এবং ব্রাজিলিয়ান ফুটবল পছন্দ করি। কিন্তু এখন পরিস্থিতি বদলে গেছে।’

১৯৯৩ সালে যাত্রা শুরু করে এমএলএস। এরপর ২০০৭ সালে ডেভিড বেকহামের আগমনে দেশটির ফুটবলে নতুন দিনের হাওয়া লাগে। এরপর ক্যারিয়ারের শেষ ভাগে গিয়ে কাকা-ওয়েইন রুনিরাও সেখানে খেলে গেছেন। কিন্তু মেসির আগমনের বিষয়টি একেবারেই আলাদা। বিশেষ করে ২০২৬ বিশ্বকাপ সামনে রেখে আর্জেন্টাইন মহাতারকার আগমন যুক্তরাষ্ট্রের খেলার জগতের খোলনলচে বদলে দিচ্ছে। মেসির আগমন কতটা প্রাণসঞ্চার করছে, তা বেকহামের মুখ থেকেই শোনা যাক, ‘এটা দেশের জন্য দারুণ একটি মুহূর্ত। লিগের জন্যও অসাধারণ একটি মুহূর্ত। এটা আমাদের জন্য গর্বিত হওয়ার মতোই একটি মুহূর্ত।’

একইভাবে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন মালিকদের আরেকজন হোর্হে মাসও, ‘এই মুহূর্তটি দেশের ফুটবলের দৃশ্যপটই বদলে দেবে।’ যুক্তরাষ্ট্রের খেলার জগতে জনপ্রিয়তার দিক থেকে ফুটবলকে বর্তমানে চার নম্বরে রাখেন অনেকে। আমেরিকান ফুটবল এবং বাস্কেটবল এখনো ফুটবলের চেয়ে অনেকটাই এগিয়ে। তবে আইস হকি এরই মধ্যে পিছিয়ে পড়েছে এবং বেসবলও পড়েছে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে। বেসবলের জনপ্রিয়তার সামগ্রিক পতনই অবশ্য চোখে পড়ার মতো।

২০০৭ সালে ৭ কোটি ৯৫ লাখ দর্শক যেখানে বেসবল খেলা উপভোগ করেছে, সেখানে গত বছর এই সংখ্যাটি নেমে আসে ৬ কোটি  ৪৫ লাখে। বেসবলের জনপ্রিয়তা হারানোর এই সুযোগকে পুরোপুরিভাবে কাজে লাগাচ্ছে মেজর লিগ সকার (এমএলএস)। মেসির আগমনের ফলে সামনের দিনে জনপ্রিয়তার ফারাকটা আরও বাড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে এমএলএসের জনপ্রিয়তা তরতর করে বাড়ছে।

মেসি ও ডেভিড বেকহাম

এমএলএসে কমিশনার ডন গারবার বলেছেন, ‘আমাদের সমর্থক গোষ্ঠী মেজর লিগগুলোর মধ্যে সবচেয়ে তরুণ। উত্তর আমেরিকা, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার মধ্যে এই সমর্থক গোষ্ঠীই সবচেয়ে বৈচিত্র্যময়। মেসির মতো খেলোয়াড় এবং অ্যাপলের মতো অংশীদার আমাদের লক্ষ্য অর্জনে দারুণভাবে সাহায্য করছে। আমরা বিশ্বের সেরা ফুটবল লিগগুলোর একটি হতে চাই।’

কিন্তু জনপ্রিয়তা বাড়ার পরও অর্থনৈতিক দিক থেকে ফুটবলাররা এখনো শীর্ষে থাকা তিনটি খেলার চেয়ে পিছিয়ে আছে। পাশাপাশি শুধু মেসির আগমন এককভাবে সব বদলে দেবে, এটা ধরে নেওয়াও ঠিক হবে না। একটি গবেষণা বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের ফুটবলের অবস্থান পুরোপুরি বদলাবে, যদি তরুণ মেধাবী এবং শ্রমিক শ্রেণির ফুটবলার বিশেষ করে কৃষ্ণাঙ্গদের যদি খেলাটিতে দেখা যায়।

তবে জনপ্রিয়তার দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের খেলার জগতে যে বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে, সেটাকে অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। ড্যানিয়েলে নামের এক নারী তাঁর স্বামী মাইক এবং পুত্র কেগানকে নিয়ে ২ হাজার ২০০ মাইল পাড়ি দিয়ে এসেছিলেন মেসির খেলা দেখতে। টিকিট পাননি, এসেছিলেন মূলত ডিআরভি পিএনকে স্টেডিয়ামের আবহটা উপভো করতে। স্টেডিয়ামের বাইরে পামগাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে ছিলেন তাঁরা।

দেশটির খেলার জগতের বদলে দেওয়া চিত্রটা কেমন ড্যানিয়েলের মুখেই শোনা যাক, ‘বেসবল বিরক্তির। যদি না তুমি সেখানে বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে পান করতে যাও। নয়তো বেসবল দেখা বিরক্তিকর।’ তবে সামনের দিনে খেলা দেখা নিয়ে এমন পরিস্থিতিতে না–ও পড়তে হতে পারে ড্যানিয়েলেকে। ইন্টার মায়ামি আরও বড় স্টেডিয়াম বানানোর উদ্যোগ নিয়েছে। তবে আপাতত সমস্যার সমাধান হিসেবে নির্দিষ্ট কিছু ম্যাচের জন্য তারা ৬৫ হাজার আসনবিশিষ্ট এনএফএলের ক্লাব মায়ামি ডলফিনের মাঠকে ব্যবহার করার চেষ্টা করছে।

জয়ের পর দলের সঙ্গে মেসি

ফুটবলের বাড়তে থাকা জনপ্রিয়তার সঙ্গে এখন অর্থনৈতিক বিনিয়োগও আসতে শুরু করেছে। অ্যাপল ২.৫ বিলিয়ন ডলারে ১০ বছরের জন্য টেলিভিশন সম্প্রচার চুক্তি করেছে। সমর্থকেরা ৯৯ ডলারে সিজন পাস কেনার পাশাপাশি অ্যাপল টিভিতে সব খেলা দেখার সুযোগও পাচ্ছে। এরই মধ্যে অ্যাপল আর্জেন্টিনার ফুটবলপ্রেমীদের অ্যাপে খেলা দেখার সুযোগ করে দেওয়ার উদ্যোগও নিয়েছে।

একই সঙ্গে তারা মেসিকে নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র বানানোর কাজও শুরু করেছে। সামনের দিনগুলোতে আরও অনেক পৃষ্ঠপোষক যুক্তরাষ্ট্রের ফুটবলের সঙ্গে যুক্ত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যা অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি খেলাটি বিস্তারেও যথেষ্ট ভূমিকা রাখবে।

মেসির আগমন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও নতুন বিপ্লব নিয়ে এসেছে। ইস্টার্ন কনফারেন্সে সবার নিচে থাকা ইন্টার মায়ামির অনুসারী এখন ১ কোটি ২০ লাখে গিয়ে পৌঁছেছে। যা কিনা এনএফএল, এনএইচএল এবং এমএলবির যেকোনো দলের চেয়ে বেশি। এনবিএর তিনটি দলের (গোল্ডেন স্টেট ওয়ারিয়র্স, এলএ ল্যাকার্স এবং দ্য ক্লিভল্যান্ড ক্যাভালিয়ার্স) শুধু ইন্টার মায়ামির চেয়ে বেশি অনুসারী আছে।’

ফুটবলের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিতে টেলিভিশনও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ২০১২ সালে টেলিভিশনে প্রথম প্রিমিয়ার লিগের খেলা দেখানো হয়েছিল। সে সময় এর স্বত্ব কিনেছিল এনবিসি। সে সময় সমর্থকদের কাছ থেকে তারা যে সাড়া দিয়েছে, তা ছিল দুর্দান্ত। ১৮ মাস আগে তারা এটি চালিয়ে যাওয়ার জন্য আরও ৬ বছরের নতুন চুক্তি করে, যার মূল্য ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি।

এসবের ফলে বর্তমানে ফুটবল বিশেষ করে ইংলিশ ফুটবল ক্লাবগুলো যুক্তরাষ্ট্রে বেশ জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেছে। এটা একই সঙ্গে বিনিয়োগের দৃষ্টিকোণ থেকে যেমন লাভ নিয়ে আসছে, তেমনি যারা খেলাটিকে ভালোবাসে, তাদেরও যুক্ত থাকার সুযোগ করে দিচ্ছে। এই জনপ্রিয়তার ফলেই বর্তমানে নয়টি ইংলিশ ক্লাবের মালিকানায় যুক্ত করেছে মার্কিন ধনকুবেরদের।

তবে মঞ্চটা আগে থেকে প্রস্তুত থাকার পরও মেসির আগমন ভিন্ন এক দিগন্তের উন্মোচন করেছে, নিয়ে এসেছে রীতিমতো টর্নেডো। যুক্তরাষ্ট্রে ফুটবলের জনপ্রিয়তা আগে যেখানে পা পা করে বাড়ছিল, তা এখন প্রতি মুহূর্তে লাফিয়ে বাড়ছে। তবে এটা তো কেবলই শুরু। মেসি নামের ঘূর্ণিঝড় সামনের দিনগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের খেলার জগতে কী পরিবর্তন নিয়ে আসে, সেটাই এখন দেখার অপেক্ষা।