ভাঙাচোরা ছোট্ট একটা ঘর। ঘরে বেশ কয়েকজন কিশোরী। ঘরটা নারায়ণগঞ্জ শহরের জিমখানা আলাউদ্দিন খান স্টেডিয়ামের ঠিক পাশেই। মেয়েরা প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন অনুশীলনে নামার। তাঁদের মধ্যে একটি মুখ দেখে চমকে যেতে হলো। জার্সিতে নাম লেখা এনি। তবে এনি জানালেন, তাঁর নাম আসলে দুটি। অন্য নাম নুসাই মারমা। সবাই তাঁকে নুসাই নামেই ডাকে।
বাড়ি বান্দরবানের বগা লেকসংলগ্ন রুমা আর্মি ক্যাম্পের পাশে। ধানমন্ডির ঢাকা মহিলা কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে পড়ছেন। কিন্তু তাঁর স্বপ্ন বড় ফুটবলার হওয়া। সেই লক্ষ্যপূরণে ফুটবলচর্চা শুরু করেছেন বছরখানেক হলো। চার মাস ধরে আছেন নারায়ণগঞ্জ শহরে। সেটা শুধুই ফুটবল শেখার জন্য। নুসাই বললেন, ‘এখানে আমি একা নই। নারায়ণগঞ্জের বাইরের আরও কয়েকজন মেয়ে অনুশীলন করে। আমরা একসঙ্গে থাকি।’
নারায়ণগঞ্জ শহরের শহীদনগরে সুকমপট্টিতে থাকেন তাঁরা। নুসাইসহ নারায়ণগঞ্জের বাইরের জেলার মোট ১০ জন মেয়ে এখানে সপ্তাহে ছয় দিন অনুশীলন করে তৈরি করছেন নিজেদের। জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে সরেজমিন মাঠে গিয়ে অবশ্য পাওয়া গেল সাতজনকে। তিনজন গেছেন বগুড়ায় খেপ খেলতে। খেপ খেলার প্রস্তাব প্রায়ই আসে। বগুড়ায় বেশি যাওয়া হয়। সিরাজগঞ্জ, লালমনিরহাট থেকেও আসে প্রস্তাব।
যাঁরা মাঠে ছিলেন, সবার পরিচয় জানা গেল। তাঁরা নিজেরাই বললেন, ‘আমি স্বর্ণা, জেলা পটুয়াখালী। আমি সুরাইয়া, জেলা ঝালকাঠি, আমি শারমিন, জেলা বরগুনা...।’ নরসিংদী, সিরাজগঞ্জ, রংপুরের মেয়েও আছে। গাইবান্ধার দুজন একাডেমিতে আছেন ৪–৫ বছর ধরে।
তাঁদের এই সুযোগটা করে দিয়েছে নারায়ণগঞ্জ প্রমীলা ফুটবল একাডেমি। ফেসবুকে একাডেমির কার্যক্রম দেখে তাঁরা এখানে এসেছেন। নিজেদের এলাকায় ফুটবল শেখার সুযোগ নেই। ফুটবল শিখতে আগ্রহী মেয়েদের জন্য তাই বড় এক আশীর্বাদ এই একাডেমি।
প্রমীলা ফুটবল একাডেমি মূলত নারায়ণগঞ্জ বঙ্গবীর সংসদ ফুটবল একাডেমির অংশ। বঙ্গবীর সংসদ ফুটবল একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭২ সালে। প্রতিষ্ঠাতা স্থানীয় ফুটবল কোচ মোসলেউদ্দিন খন্দকার (বিদ্যুৎ চাচা নামে পরিচিত), নারায়ণগঞ্জের ফুটবলগুরু। যাঁর হাত ধরে এই অঞ্চলের অনেক ফুটবলার তৈরি হয়েছেন। খেলেছেন জাতীয় দলেও। তাঁদের মধ্যে মজিবর রহমান (রিতু), আজমল হোসেন (বিদ্যুৎ), ওয়ালি ফয়সাল, খোকন দাস, আবদুল্লাহ পারভেজ, ইউসুফ সিফাত উল্লেখযোগ্য।
২০০৩ পর্যন্ত শুধু ছেলেদের ফুটবলই হতো বঙ্গবীর সংসদ ফুটবল একাডেমিতে। ২০০৪ সালে নারী শাখা খোলা হয়। নাম দেওয়া হয় নারায়ণগঞ্জ প্রমীলা ফুটবল একাডেমি। এটিই নারায়ণগঞ্জের একমাত্র নারী ফুটবল একাডেমি। এরই মধ্যে বাফুফে থেকে ‘ওয়ান স্টার’ নারী ফুটবল একাডেমির স্বীকৃতি পেয়েছে। একাডেমিতে বর্তমানে খেলোয়াড় সংখ্যা ৩৫ জন।
মেয়েদের খেলার সুযোগ করে দেওয়াই ছিল প্রতিষ্ঠাতা বিদ্যুৎ চাচার স্বপ্ন। সেটি পূরণও হয়েছে। এই একাডেমি থেকে উঠে এসে কয়েকজন নারী ফুটবলার বাংলাদেশ জাতীয় দলে খেলেছেন। একাডেমির বর্তমান কোচ সুরভী আক্তারও এখান থেকেই উঠে এসেছেন। বিকেএসপির নারী কোচ আফিয়া খাতুন ও জাতীয় নারী দলের সহকারী কোচ মাহমুদা আক্তার (অনন্যা) একাডেমির শুরুর দিকের ছাত্রী। নারায়ণগঞ্জের আরেক নারী ফুটবলার মাকসুদা খন্দকারও (সুখী) এখানে ফুটবল শিখেছেন। তিনি একাডেমির প্রতিষ্ঠাতার মেয়ে। বর্তমানে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব–১৯ দলের খেলোয়াড় কানন রানী বাহাদুরও এই একাডেমির ছাত্রী।
২০১৭ সালে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন একাডেমির প্রাণপুরুষ মোসলেউদ্দিন খন্দকার। কিন্তু যে স্বপ্ন নিয়ে তিনি এটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেটার মৃত্যু হয়নি। মেয়েদের খেলার চর্চা চলছেই। একাডেমির বর্তমান নেতৃত্ব মেয়েদের নিয়মিত অনুশীলনে রেখেছেন। শুক্রবার বাদে সপ্তাহে বাকি ছয় দিনই চলে অনুশীলন। অনুশীলনের জন্য মেয়েদের কোনো টাকা দিতে হয় না, ভর্তিও ফ্রি, মাসিক অন্য কোনো ফিও নেই। পুরোপুরি বিনা খরচে মেয়েরা শিখতে পারছে ফুটবল।
শুরুর দিকে স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তি আর্থিক সহায়তার হাত বাড়িয়েছিলেন। একেকজন দুই-তিনজন করে মেয়ের দায়িত্ব নেন। মেয়েদের জার্সি, বল দেন। স্থানীয় ইপিলিয়ন গ্রুপ এই একাডেমিকে জার্সি, বলসহ ফুটবলের সরঞ্জাম দিয়েছে বেশ কয়েক বছর। সঙ্গে মাসে পাঁচ হাজার টাকা। সেটা অবশ্য বছরখানেক ধরে বন্ধ।
তারপরও একাডেমি চলছে কোচ সুরভী আক্তার, একাডেমির সাধারণ সম্পাদক আজমল হোসেনের (বিদ্যুৎ) শ্রমের বিনিময়ে। আজমল জাতীয় দলের সাবেক ফুটবলার, বাংলাদেশের প্রথম পেশাদার কোচ হিসেবে সম্প্রতি যিনি ভুটানের প্রিমিয়ার লিগে একটি ক্লাবের কোচ ছিলেন।
সম্প্রতি আলাউদ্দিন খান স্টেডিয়ামে গিয়ে দেখা যায়, মেয়েদের অনুশীলনের জন্য ন্যাড়া মাঠে পানি দিচ্ছেন আজমল। এ কাজে তাঁকে সহায়তা করছেন জাতীয় দলের সাবেক ফুটবলার আবদুল্লাহ পারভেজ। বাঁশি হাতে অনুশীলনে নামেন ২০০৬-১৬ পর্যন্ত বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দলে খেলা সুরভী। ‘সি লাইসেন্স’ করে এখন তিনি মেয়েদের ফুটবল শেখান।
ফুটবল নিয়ে ব্যস্ত থাকায় বিয়েশাদির ভাবনাটাই এখনো ভাবতে পারেননি ২৭ বছরের সুরভী। মেয়েদের নিয়ে অনুশীলনের ফাঁকে মাঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘সাত বোন, এক ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট আমি। দুই মাস আগে বাবা মারা গেছেন। আমি এই বাচ্চাদের নিয়েই আছি।’
ব্যক্তিগত জীবনটাকে গুছিয়ে নেওয়ার তাড়না আছে সুরভীর। কিন্তু তারপরও কেন একাডেমি ছেড়ে যান না, সেটা সুরভীর মুখ থেকেই শুনুন, ‘বিয়েশাদি তো একদিন করতেই হবে। কিন্তু ওদের মায়া ছাড়তে পারি না। বিয়ের জন্য বাসা থেকে চাপ দেয়। কিন্তু আমি চলে গেলে একাডেমিটা ভেঙে যাবে। এটা চিন্তা করে যাই না।’
একাডেমির মেয়েরাও তাঁর ভক্ত হয়ে গেছে। কোথাও যেতে হলেও মেয়েরা তাঁকে না বলে যায় না। এটা খুব ভালো লাগে সুরভীর, ‘ওরা সবাই অনেক ভালো, কথা শোনে। অনেক আগ্রহ ফুটবল শেখার। ফুটবলটা যেন ওদের নেশা হয়ে গেছে। ওরা এটা ছাড়া আর কিছু চিন্তাই করতে পারে না।’
তবে একটা আক্ষেপও আছে তাঁর। সুরভী বলেন, ‘দিন দিন একাডেমি চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। একটা খরচ তো আছে। বিকেলে অনুশীলনে এলে মেয়েদের জন্য একটু নাশতার ব্যবস্থা করতে হয়। সেটা কীভাবে করব, সেই চিন্তা থাকে। একজনই শুধু আমাদের একটু সহায়তা করে। মেয়র আইভি আপা (নারায়ণগঞ্জের মেয়র সেলিনা হায়াৎ) প্রতি মাসে একাডেমির জন্য ৫ হাজার টাকা করে দেন। এর বাইরে আর কোনো আয়ের খাত নেই একাডেমির।’
মেয়রের দেওয়া ৫ হাজার টাকাও খরচ হয়ে যায় মেয়েদের যাতায়াতের পেছনে। সুরভী জানান, তিনি নিজেও খরচ করেন একাডেমির মেয়েদের জন্য, ‘এখান থেকে আমি নিজে কিছু নিই না। আসলে নেওয়ার কীই–বা আছে! একাডেমির জন্য আমার ওস্তাদ বিদ্যুৎ ভাই পরিশ্রম করেন, আমিও করি। আমরা কিছু নিই না এখন থেকে। নেব কীভাবে? থাকলে তো? মেয়েদের শিখিয়ে আনন্দ পাই। এটাই আমাদের প্রাপ্তি।’
শহরের বৌবাজারে নিজের বাসায় একাডেমির চারজন মেয়েকে থাকারও ব্যবস্থা করে দিয়েছেন সুরভী। মেয়েরা অবশ্য নিজেদের খরচেই থাকেন।
এই বয়সে মা–বাবার ছায়া থেকে বেরিয়ে এসে আরেক জেলায় পড়ে থেকে ফুটবল শিখলেও মেয়েদের টুর্নামেন্ট খেলার তেমন সুযোগ নেই। একাডেমির সাধারণ সম্পদক আজমল হোসেনের আক্ষেপ, ‘ঢাকার বাইরের ১০টি মেয়ে অনেক সমস্যা পেরিয়ে নারায়ণগঞ্জে থাকে। ১২ মাস শুধু অনুশীলনই করে। কিন্তু টুর্নামেন্ট খেলার সুযোগ নেই। কারণ, মেয়েদের টুর্নামেন্ট তেমন একটা হয় না। নারায়ণগঞ্জে মেয়েদের খেলা নেই। মাঝেমধ্যে ওরা বিভিন্ন জায়গায় যায় খেলতে, এই যা, কিন্তু এভাবে তো হয় না। মেয়েদের জন্য টুর্নামেন্ট আয়োজন করতে হবে।’
বান্দরবানের নুসাই বা ঝালকাঠির সুরাইয়াদের চোখে তবু স্বপ্ন, একদিন সাবিনা–সানজিদাদের মতো গায়ে তুলবেন জাতীয় দলের জার্সি। ওদের এই স্বপ্ন পূরণ করতে পারলেই সার্থক হবে আজমল–সুরভীদের পরিশ্রম।