পেলে: সাও পাওলোর বস্তি থেকে বিশ্বসেরা
পেলে: সাও পাওলোর বস্তি থেকে বিশ্বসেরা

পেলে যে কারণে সর্বকালের সেরা

কীর্তিমানের মৃত্যু নেই। পেলেরও মৃত্যু নেই। তাঁর দেহ থেকে প্রাণপাখি উড়ে গেলেও কীর্তিই তাঁকে অমর করে রাখবে। অনেকের চোখেই তিনি সর্বকালের সেরা ফুটবলার। তিনবার বিশ্বকাপজয়ী একমাত্র ফুটবলার। পৃথিবী তাঁকে হারিয়েছে। কিন্ত তর্কযোগ্যভাবে সর্বকালের সেরা ফুটবলার থেকে যাবেন পেলে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ‘মেইল অনলাইন’ এক প্রতিবেদনে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছে, পেলেকে কেন সর্বকালের সেরা বলা হয়। তার সার সংক্ষেপ তুলে ধরা হলো।

সাও পাওলোর দারিদ্রপীড়িত বস্তিতে তাঁর জন্ম। সেখানকার রাস্তায় মোজা মুড়িয়ে বল বানিয়ে কিংবা জাম্বুরা দিয়ে ফুটবল খেলতেন। ঠিক খেলতেন নয়, খেলার পাশাপাশি জাদুকরি সব মুহূর্তের জন্ম দিতেন ওই অল্প বয়সেই। পরিবারের একটা ফুটবল কিনে দেওয়ার সামর্থ্যও ছিল না। কিন্তু ১৫ বছর বয়সে সেই ছেলেটিই সান্তোসের মূল দলে গোলের পর গোলের মালা গেঁথেছেন। ১৬ বছর বয়সে খেলেছেন ব্রাজিল জাতীয় দলে। আর ১৭ বছর বয়সে ১৯৫৮ বিশ্বকাপে ৪ ম্যাচে ৬ গোল করে ব্রাজিলকে জিতিয়েছেন বিশ্বকাপ। হয়ে গেলেন সর্বকণিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বকাপজয়ী!

কিন্তু সেটা কেবলই পেলের শুরু।

যখন শেষ করেছিলেন, ততদিনে পৃথিবীতে তাঁর মতো আর কেউ নেই। তিনবার বিশ্বকাপজয়ী একমাত্র ফুটবলার। আর একমাত্র ফুটবলার হিসেবে এক হাজার গোলের মালিক (তর্কযোগ্য)।

তরুণরা লিওনেল মেসি ও ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর আধুনিক কিংবদন্তিদের দীর্ঘ ক্যারিয়ার এবং গোলের পর গোল ও রেকর্ড নিয়ে পেলের শ্রেষ্ঠত্বকে প্রশ্ন করেন। কিন্তু ডিয়েগো ম্যারাডোনা, আলফ্রেডো ডি স্টেফানো ও ইয়োহান ক্রুইফদের নিয়ে সেভাবে কথা হয় না, যাঁরা পেলেকে সত্যিকারের চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন। এমনকি ব্রাজিলেও পেলের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে তুলনা চলে। পেলের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে গারিঞ্চাকে দাঁড় করায় স্বয়ং ব্রাজিলিয়ানরাই। গারিঞ্চাকে ব্রাজিলয়ানরা ভালোবাসে তাঁর জীবনের সঙ্গে ব্র্রাজিলের জীবনধারার মিলের জন্য। বল নিয়ে তাঁর কারিকুরির জন্য। এই ভালোবাসা হৃদয়নিঃসৃত। আর পেলের প্রতি ভালোবাসাটা থেকে আসে মাথা থেকে। পেলের রেকর্ড, পর্বতসম পরিসংখ্যান যে অস্বীকারের পথ নেই। মজার ব্যাপার, ব্রাজিলিয়ানদের হৃদয় ও মস্তিস্কের এই দুই ভালোবাসার মানুষ একসঙ্গে খেললে ব্রাজিল কখনো হারেনি।

তবে যদি এটা মেনে নেওয়া যায় সর্বকালের সেরার বিতর্কে পেলের কাছে ম্যারাডোনা হেরে সর্বজনবিদিত রানার আপ তাহলে, সর্বকালের সেরার বিতর্কের একটা রফা করা যায়। ম্যারাডোনার প্রতিভা, দ্যুতি ও বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে আবেগ ও নাটকীয়তা। কিন্তু ব্রাজিলের কালোমানিক নিখুঁতভাবে কাটা হীরে, ক্ষুরধার এবং দূতিটা চিরকালীন। ফুটবলীয় প্রজ্ঞার শীর্ষবিন্দু। পরিমিতিবোধে অনন্য, কখনো প্রতিভার অপচয় করেননি। সব সময়ই একটা লক্ষ্য ছিল। ঠিক প্রতিপক্ষের গোলপোস্টের সামনে সব সময় যেমন ছিলেন।

১৯৭০ বিশ্বকাপের আগে রাজনৈতিক কারণে ব্রাজিল জাতীয় দলের কোচের পদ থেকে ছাঁটাই হওয়া হোয়াও সালদানাকে ব্রাজিলের এক ক্রীড়ালেখক জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘ব্রাজিলের সেরা গোলকিপার কে?’ সালাদানা বলেছিলেন, ‘পেলে।’ সেই ক্রীড়ালেখক পাল্টা জানতে চান, ‘বেশ, তাহলে সেরা রাইটব্যাক?’ এবারও উত্তর এল ‘পেলে।’ মোটামুটি দলের অর্ধেক পজিশনে পেলের নাম বলার পর সালাদানা খানিক হেসে বলে ফেলেন, ‘পেলে যেকোনো পজিশনেই বিশ্বের সেরা ফুটবলার।’ পেলের সঙ্গে ও বিপক্ষে খেলা অনেকেই সালদানার সুরেই কথা বলেছিলেন।

১৯৫৮ বিশ্বকাপের আগে পেলে চোট পেয়েছিলেন। তাঁর সতীর্থরাই চাপাচাপি করে পেলেকে সুইডেন বিশ্বকাপে নিয়ে যান। সেই বিশ্বকাপে পেলে ৬টি গোল করেন। ফাইনালে জোড়া গোল করেছিলেন। ম্যাচ শেষে আনন্দের আতিশায্যে মূর্চ্ছা গিয়েছিলেন ১৭ বছর বয়সী পেলে। জ্ঞান ফেরার পর প্রতিপক্ষ (সুইডেন) দলের খেলোয়াড় সিগভার্দ পার্লিং পেলেকে বলেছিলেন, ‘তোমার দ্বিতীয় গোল দেখে করতালি দিতে ইচ্ছে করছিল।’

১৯৬২ বিশ্বকাপে পেলে চোটের কারণে দুই ম্যাচের বেশি খেলতে পারেননি। সেবার ব্রাজিলকে জেতালেন গারিঞ্চা। পরের বিশ্বকাপেও কড়া ট্যাকলের শিকার হয়ে পেলে বিদায় নিলেন প্রথম রাউন্ড থেকে। ব্রাজিলও বিদায় নেয় তাঁর সঙ্গে। এই চোটের কারণেই ১৯৭০ বিশ্বকাপে পেলের খেলার কথাই ছিল না। কিন্তু এই বিশ্বকাপেই ‘গোল অব দ্য সেঞ্চুরি’র পাসটি ছিল তাঁর পা থেকে। ‘শতাব্দীর সেরা ফুটবলার’-এর সিগনেচার পাস ছিল সেটি। ইতালির বিপক্ষে সেই ফাইনাল ৪-১ গোলে জিতেছিল ব্রাজিল। এই ম্যাচে পেলেকে মার্ক করার দায়িত্ব ছিল ইতালির ডিফেন্ডার তারচিসিও বারজিনিচের ওপর। তিনি বলেছিলেন, ‘ফাইনালের আগে আমি নিজেই নিজেকে বুঝিয়েছিলাম, সে (পেলে) আমাদের মতোই রক্তমাংসের মানুষ। আমি ভুল ভেবেছিলাম।’

সান্তোস, ব্রাজিল ও নিউইয়র্ক কসমসের হয়ে মোট ৪০ ট্রফি জিতেছেন পেলে। তিনি ও ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার মিলে ফুটবলের ভিত গড়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে। উয়েফার সভাপতি থাকতে মিশেল প্লাতিনি একটা মন্তব্য করেছিলেন, ‘ফুটবলার পেলে ও মানুষ পেলে। কিন্তু পেলে যখন ফুটবল খেলেছেন তখন তিনি ঈশ্বর হয়ে উঠেছেন।’

ইতিহাসই সে কথা বলে। সেটা শুধু ১৩৬৬ ম্যাচে ১২৮২ গোলের জন্য নয়, প্রতিভার দ্যুতিতে সবার চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার জন্য্ও নয়। বরং খেলাটির প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা এবং সেটা পৃথিবীর মানুষের দ্বারে দ্বারে পৌঁছে দেওয়ার জন্যও পেলের কোনো তুলনা নেই। একটা খেলায় একজন অমর কিংবদন্তির কাছ থেকে লোকে আর কি আশা করতে পারে?

ফুটবল যে দেশে ধর্ম, সেখানে আজ সবাই শোকাতুর তাঁর জন্য।