কাতার বিশ্বকাপে ক্রোয়েশিয়ার কাছে হেরে বিদায়ের পর এডুকেশন সিটি স্টেডিয়ামজুড়ে দেখা যাচ্ছিল ছোপ ছোপ হলুদ বেদনা। মাঠজুড়ে ছন্নছাড়া হয়ে কেঁদে আকুল নেইমার-রিচার্লিসনরা। নেইমারকে সান্ত্বনা দিতে আসতে হলো ক্রোয়েশিয়ার তারকা ফুটবলার ইভান পেরিসিচের ছেলেকে। সেদিনের সেই ছন্নছাড়া ব্রাজিল দল এখনো পারেনি নিজেদের গুছিয়ে নিতে।
বিশ্বকাপের পর খেলা প্রীতি ম্যাচেও দেখা গেছে সেই পথহারা ব্রাজিলকে। তিন ম্যাচ খেলে হেরেছে মরক্কো ও সেনেগালের মতো দলের কাছেও। তবে ব্রাজিলের ছন্নছাড়া দশার সবচেয়ে বড় প্রতীক হয়ে আছে সম্ভবত দলটির কোচ নিয়োগ নিয়ে মঞ্চস্থ হওয়া নাটক। সেই নাটক আপাতত শেষ হয়েছে মনে হলেও আসলে নাটকীয়তা এখনো শুরুই হয়নি।
ঘটনার শুরু বিশ্বকাপ থেকে ব্রাজিলের বিদায়ের পর কোচ তিতের সরে যাওয়া থেকে। ২০১৮ ও ২০২২ সালে বিশ্বকাপে তিতের ব্যর্থতা দেশি কোচদের ওপর থেকে ব্রাজিল ফুটবল ফেডারেশনে (সিবিএফ) আস্থার ভিতকে শিকড়সহ নাড়িয়ে দেয়। যে কারণে তিতের বিদায়ের পর থেকেই ব্রাজিল হাত বাড়ায় বিদেশি কোচদের দিকে। এ বিষয় নিয়ে বিতর্ক শুরু হতেও খুব বেশি সময় লাগেনি।
ব্রাজিলের কিংবদন্তি ফুটবলাররাও কোচ নিয়োগ নিয়ে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এক দিকে রোনালদো নাজারিওর মতো কিংবদন্তিরা বিদেশি কোচ নিয়োগের পক্ষে রায় দেন, আর অন্য দিকে বিদেশি কোচ নিয়োগকে ব্রাজিলের মর্যাদাহানির সঙ্গে তুলনা করেন আরেক কিংবদন্তি রিভালদো।
এই সব সমালোচনাও অবশ্য ব্রাজিল ফুটবলের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠানটিকে বিদেশি কোচ নিয়োগ নীতি থেকে টলাতে পারেনি। সে সময় ব্রাজিলের পরবর্তী সম্ভাব্য কোচ হিসেবে লুইস এনরিকে, জোসে মরিনিও, কার্লো আনচেলত্তিসহ বেশ কিছু নাম শোনা যায়। তবে নানা গুঞ্জনের পথ পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত সেই তালিকাটি নেমে আসে একে। ফেব্রুয়ারির শুরুতেই কার্লো আনচেলত্তির ব্রাজিলের কোচ হওয়ার খবর চাউর হয়। সিবিএফ অবশ্য শুরুতে এ খবর অস্বীকার করে। তবে এরপরও থামেনি এই গুঞ্জন।
ব্রাজিল দলের খেলোয়াড়েরাও আনচেলত্তির কোচ হওয়া নিয়ে কথা বলেন। শেষ পর্যন্ত এ মাসের শুরুতে সিবিএফের পক্ষ থেকে বার্তা সংস্থা এএফপিকে আনচেলত্তির ব্রাজিলের কোচ হওয়ার খবরটি নিশ্চিত করা হয়। তবে সেখানেও ছিল চমক। এখন নয়, আনচেলত্তি দায়িত্ব নেবেন মূলত ২০২৪ সালের কোপা আমেরিকা থেকে। আরও এক মৌসুম তিনি রিয়াল মাদ্রিদের কোচই থাকবেন। আর আগামী এক বছর অন্তর্বর্তীকালীন কোচের দায়িত্ব পালন করবেন ফার্নান্দো দিনিজ।
এদিকে আনচেলত্তিকে কোচ করা নিয়ে আপত্তি এসেছে খোদ ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা দি সিলভার কাছ থেকে। টানা দুবার বিশ্বকাপ খেলতে না পারা নিজ দেশ ইতালির সমস্যা সমাধান করে আনচেলত্তি কেন ব্রাজিলে আসছেন সেই প্রশ্ন তুলে লুলা বলেছিলেন, ‘সে (আনচেলত্তি) কখনো ইতালির কোচ ছিল না। সে কেন ইতালির সমস্যা সমাধান করছে না। এমনকি তারা সর্বশেষ বিশ্বকাপটাও খেলতে পারেনি।’ তবে এই সমালোচনাকে দূরে সরিয়ে রাখলেও আনচেলত্তির সামনে এ মুহূর্তে জমা হয়ে আছে পাহাড়সমান চ্যালেঞ্জ।
কোপা আমেরিকার সময় আনচেলত্তির দায়িত্ব নেওয়ার অর্থ প্রতিযোগিতাটিতে সম্পূর্ণ নতুন কোচের অধীন খেলতে হবে ব্রাজিলকে। খেলোয়াড়দের সঙ্গে বোঝাপড়া এবং দল গঠনের জন্য কোনো সময়ই পাবেন না ইতালিয়ান এই কোচ। অর্থাৎ আনচেলত্তিকে কাজ শুরুই করতে হবে পরীক্ষা দিয়ে। যে পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়ার কোনো সময়ও থাকবে না তাঁর হাতে। আর সে পরীক্ষায় যদি আনচেলত্তি ব্যর্থ হন, তবে দায়িত্ব নেওয়ার শুরুতেই তাঁকে পড়তে হবে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে। অবশ্য পরীক্ষায় উতরে গেলেও দায়িত্ব সেখানেই শেষ নয়।
ব্রাজিল দলের কোচ হিসেবে সাফল্যের চূড়ান্ত মানদণ্ড মূলত বিশ্বকাপ। ২০০২ সালের পর আর বিশ্বকাপ জিততে না পারার যন্ত্রণা দূর করতেই নিজেদের ঐতিহ্য নষ্ট করে আনচেলত্তিকে কোচ করা। এমনকি তাঁর ওপর সিবিএফের আস্থা এত বেশি যে দেড় বছর অপেক্ষা করতেও রাজি আছে তারা। প্রত্যাশার বিশাল এক চাপ নিয়েই ব্রাজিল দলের দায়িত্ব নেবেন বর্ষীয়ান এই কোচ।
আর সেই বিশ্বকাপের জন্য দল গোছাতে আনচেলত্তি সময় পাবেন মাত্র দুই বছর। এই দুই বছরে খেলোয়াড় বাছাই থেকে দলের কৌশল নির্ধারণ সবকিছুই ঠিক করতে হবে তাঁকে। প্রতিদ্বন্দ্বী কোচদের চেয়ে দুই বছর পিছিয়ে থেকেই কাজ শুরু করতে হবে ৬৪ বছর বয়সী এই কোচকে। সেই পার্থক্য শেষ পর্যন্ত আনচেলত্তি মেটাতে পারবেন কি না, সে প্রশ্ন রয়েই যায়।
অবশ্য আনচেলত্তি এক বছর পর ব্রাজিল দলের দায়িত্ব নিলেও তিনি চাইলে পরোক্ষভাবে এখনই কাজ শুরু করতে পারেন। সরাসরি দায়িত্ব না নিলেও বাইরে থেকে অনেক বিষয়ে নিজের মত দিতে পারেন। আর একই সঙ্গে ক্লাব ও জাতীয় দলের দায়িত্ব পালনের উদাহরণও একেবারে কম নয়। স্যার আলেক্স ফার্গুসন একই সময়ে আবেরডেন এবং স্কটল্যান্ড জাতীয় দলের কোচের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ডাচ কোচ গাস হিডিঙ্ক ২০০৫-০৬ সালে ১১ মাসের জন্য একই সঙ্গে পিএসভি এবং অস্ট্রেলিয়ান জাতীয় দলের দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
হিডিঙ্ক অবশ্য এই কাজ একবার নয় দুইবার করেছিলেন। ২০০৯ সালে একই সঙ্গে চেলসি ও রাশিয়া জাতীয় দলের কোচের দায়িত্বে ছিলেন এই কোচ। টোটাল ফুটবলের জনক রাইনাস মিশেলও একই সঙ্গে ক্লাব ও কোচের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি একই সঙ্গে বার্সেলোনা এবং নেদারল্যান্ডসের কোচ হিসেবে কাজ করেছিলেন। দুই মাসের জন্য ক্লাব আমেরিকা এবং মেক্সিকো জাতীয় দলের কোচ হিসেবে কাজ করেছিলেন মিগুয়েল হেরেরা। এখন আনুষ্ঠানিকভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে এই পথ অনুসরণ করতে পারেন আনচেলত্তিও। তবে রিয়াল মাদ্রিদের মতো পরাশক্তির দায়িত্ব পালনের সময় আদৌ ব্রাজিল দলের তদারকির সুযোগ আনচেলত্তি পাবেন কি না, সে প্রশ্ন থেকেই যায়।
তা ছাড়া ব্রাজিলের কোচ হয়ে বিশ্বকাপ জেতার জন্য আনচেলত্তিকে পেরোতে হবে ঐতিহাসিক বাধাও। বিদেশি কোচ হিসেবে বিশ্বকাপ জেতার কোনো নজির ইতিহাসে নেই। এখন পর্যন্ত দেশীয় কোচ ছাড়া বিশ্বকাপ জিততে পারেনি কেউই। আনচেলত্তিকে তাই নতুন করে ইতিহাস লেখার পথটা তৈরি করে নিতে হবে। আর আনচেলত্তি যদি শেষ পর্যন্ত বিদেশি কোচ হিসেবে বিশ্বকাপ জয়ের নজির গড়তে পারেন তবে আরেকটি মাইলফলকও নিজের করার সুযোগ থাকছে তাঁর। মার্সেলো লিপ্পি ও ভিসেন্তে দেল বস্কের পর তৃতীয় কোচ হিসেবে বিশ্বকাপ ও চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতার বিরল কৃতিত্ব অর্জন করবেন ইতালিয়ান এই কোচ। ১৯৯৫-৯৬ সালে জুভেন্টাসের হয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতা লিপ্পি ২০০৬ সালে বিশ্বকাপ জেতান ইতালিকে। আর স্পেনের হয়ে ২০১০ সালে বিশ্বকাপ জেতা দেল বস্ক ১৯৯৯-২০০০ এবং ২০০১-০২ সালে চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতান রিয়াল মাদ্রিদকে।
এ মুহূর্তে অবশ্য এসব মাইলফলক বা অর্জনের হাতছানির দিকে তাকানো একটু বাড়াবাড়িই মনে হতে পারে। কাগজে–কলমে বিশ্বকাপের বাকি এখনো তিন বছর। আগের বিশ্বকাপের ব্যর্থতার রেশই এখনো কাটাতে পারেনি ব্রাজিল। এদিকে আনচেলত্তি আবার দায়িত্ব নেবেন আরও এক বছর পর। অর্জনের হাতছানির চেয়ে দায়িত্ব নেওয়ার পর অল্প সময়ের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক একটি দল গঠন করাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে আনচেলত্তির জন্য।