২০১৪ বিশ্বকাপ কাভার করতে ব্রাজিলে গিয়েছিলেন প্রথম আলোর ক্রীড়া সাংবাদিক উৎপল শুভ্র। ফুটবলের তীর্থস্থানে গিয়ে ফুটবলের ‘রাজা’র ক্লাবে একবার ঢুঁ মারবেন না, তা তো হয় না! সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে তখন তাঁর এই লেখাটা আবারও প্রকাশ করা হলো। কিংবদন্তির মৃত্যুতে শ্রদ্ধার্ঘ...।
পেলের মাঠে দাঁড়িয়ে কোনো ব্রাজিলিয়ান যদি বলেন, এই বিশ্বকাপে ব্রাজিল নয়, সমর্থন করবেন আর্জেন্টিনাকে, ঠিক শুনেছি কি না নিশ্চিত হতেই হয়। প্রশ্নটা তাই আবার করা হলো। এবারও সেই একই উত্তর। লম্বা নখে নেইলপলিশ, গলায় দুটি হার, কানে দুল। কাঁধ পর্যন্ত ছাঁটা চুল আর ছিপছিপে গড়ন। ভিলমা লিমাকে দেখে বোঝার উপায় নেই, বয়স পঞ্চাশ ছাড়িয়ে গেছে। পরনে আঁটোসাঁটো সাদা একটা শার্ট। বুকে বিখ্যাত সেই ব্যাজ—এসএফসি। যেটির পূর্ণ রূপ সান্তোস ফুটবল ক্লাব।
ইংরেজি জানেন না। গত পরশু সান্তোস স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল ২৪ বছর বয়সী তরুণ লিওনার্দোকে দোভাষী বানিয়ে। বিশ্বকাপে কোনো ব্রাজিলিয়ান ব্রাজিলকে সমর্থন করবেন না—এটা চিন্তার অগম্য ছিল বলে এই জাতীয় কোনো প্রশ্নই করা হয়নি। প্রশ্নটা ছিল, এই বিশ্বকাপে ব্রাজিলের কেমন সম্ভাবনা দেখছেন? ভিলমার জবাবটা ভাষান্তরিত করে লিওনার্দো যখন জানিয়ে দিলেন, তিনিও একই দলে; রীতিমতো ভিরমি খাওয়ার জোগাড়।
দুজনেরই মনপ্রাণ জুড়ে আছে সান্তোস। যেখানেই সান্তোসের খেলা হোক, ঠিক দেখতে চলে যান। এতে বিস্ময়ের কিছু নেই। ক্লাব আনুগত্য এমনই হয়। কিন্তু ব্রাজিলের প্রতি এমন বিরাগ কেন? উত্তরটা দিলেন লিওনার্দো, ব্রাজিলের এই দলের খেলোয়াড়দের কাছে ব্রাজিলিয়ান ফুটবল শুধুই ইউরোপে গিয়ে টাকা কামানোর ‘মই’। ওদের কেন সমর্থন করব? তাই বলে বিশ্বকাপে কেন ‘চিরশত্রু’ আর্জেন্টিনার জয় চাইছেন? ‘ওদের খেলাই বেশি ভালো লাগে’—কথাটা বলে লিওনার্দোর হাসিতে বোঝা গেল, যুক্তিটা তাঁর নিজের কাছেও খুব বিশ্বাসযোগ্য হলো না।
ব্রাজিলের প্রতি তীব্র বিরাগ বোঝাতেই কি আর্জেন্টিনাকে বেছে নেওয়া? সাও পাওলো থেকে গুচ্ছের রেইস (ব্রাজিলিয়ান মুদ্রা) খরচ করে ৭২ কিলোমিটার দূরের সান্তোসে যাওয়ার একটাই কারণ। পেলে! সান্তোসের মাঠের প্রতিটি ঘাসে এখনো যেন জড়িয়ে আছেন ফুটবলের মহানায়ক। বিশ হাজারমতো ধারণক্ষমতার স্টেডিয়ামের তিন পাশে চেয়ারে সাজানো গ্যালারি, একদিকে এখনো পুরোনো দিনের স্মৃতিজাগানিয়া কংক্রিটের আসন। সেখানে দাঁড়িয়ে সামনে বাঁদিকে ঠিক মাঝখানের ভিআইপি বক্সটা চোখে পড়ে। যেটি শুধু পেলের জন্যই বরাদ্দ। সারা বিশ্ব চষে বেড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে যখনই সান্তোসে আসার সুযোগ মেলে, প্রিয় দলের খেলা দেখার সুযোগটা হাতছাড়া করেন না।
স্টেডিয়ামের মূল প্রবেশপথের বাইরেই পেলের দুটি মূর্তি। একটি মাঠে উল্লাসরত, অন্যটি আবক্ষ পেলে। ঠিক পেছনেই সান্তোস ফুটবল ক্লাবের জাদুঘরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পেলের অসংখ্য স্মৃতি। তার পরও সান্তোসে কাটানো ঘণ্টা তিনেকের দিকে যখনই ফিরে তাকাচ্ছি, মনে অবিশ্বাসের গুঞ্জন তোলা লিওনার্দো ও ভিলমার ওই কথাটা কখনো কখনো ছাপিয়ে যাচ্ছে পেলেকেও! নইলে কি আর পেলের সান্তোস নিয়ে লেখার শুরুতেই ওরা চলে আসেন?
মাঠে কোস্টারিকার বিশ্বকাপ দল অনুশীলন করছে। গ্যালারি থেকে ‘ওলে’ ‘ওলে’ চিৎকার তুলছে কোস্টারিকান সমর্থকেরা। ক্যামেরা নিয়ে কোস্টারিকান সাংবাদিকদের ছোটাছুটি। এর মধ্যেই লিওনার্দো সাদা চুলের এক ভদ্রলোককে দেখিয়ে বললেন, ‘উনি সাবেক ফুটবলার। পেলের সঙ্গে খেলেছেন।’ নামটা শুনে চমকিত—ক্লোদোয়ালদো।
১৯৭০ বিশ্বকাপজয়ী ব্রাজিলের বিখ্যাত সেই দলের তরুণতম সদস্য। উরুগুয়ের বিপক্ষে সেমিফাইনালে সমতাসূচক গোলটি তাঁর। নিজেদের সীমানা থেকে প্রতিপক্ষের চারজনকে কাটিয়ে ফাইনালে ইতালির বিপক্ষে কার্লোস আলবার্তোর বিখ্যাত সেই গোলের মূল কারিগর। সান্তোসে আট বছর পেলের সঙ্গে খেলেছেন। বাকি সব সতীর্থের মতো ক্লোদোয়ালদোও পেলেতে মোহাচ্ছন্ন। পেলে না ম্যারাডোনা—এই প্রশ্নে ‘দুজনের স্টাইল আলাদা’ বলার পর হাসি দিয়ে বললেন, ‘পেলের কোনো তুলনা হয় না।’
ব্রাজিলকে বাদ দিয়ে আর্জেন্টিনাকে সমর্থন করেন জানার পর এই প্রশ্ন ভিলমাকেও করা উচিত। যেটি আগেই করা হয়েছে এবং উত্তর এসেছে, ‘এটা কোনো প্রশ্ন হলো? এক হাজার বার পেলে।’ ষাটের দশকের সান্তোসকে সর্বকালের সেরা ক্লাব বলে মনে করেন এমন লোকের অভাব নেই। গৌরবের সেসব চিহ্ন ছড়িয়ে সান্তোস ফুটবল ক্লাবের জাদুঘরে। থরে থরে সাজানো ট্রফি, স্মৃতিকাতরতা জাগানো সব ছবি, স্মরণীয় সব অর্জনকে অক্ষয় করে রাখা স্মারক....একটা অংশ বরাদ্দ শুধুই পেলের জন্য।
শোকেসের সামনে তার দিয়ে বানানো পেলের একটা প্রতিকৃতি। গায়ে ব্রাজিলের জার্সি। ভেতরে কিশোর পেলে থেকে বিশ্বজয়ী পেলের অসংখ্য ছবি। ষোলো বছর বয়সে সান্তোসে নাম লেখানো পেলের পরিচয়পত্রটাও সেখানে সযত্নে সাজানো। কিউরেটরের ছোট্ট ঘরটাতে সাধারণ দর্শনার্থীদের প্রবেশাধিকার নেই। বিশ্বকাপ কাভার করতে বিদেশি সাংবাদিক পরিচয় সেটিতেও ঢোকার সুযোগ করে দিল। সেখানেও শুধু পেলে আর পেলে। পেলের বই, পেলের ছবিতে সাজানো বই খুলে খুলে দেখালেন কিউরেটর।
কিন্তু পেলের জার্সি-বুট এসব তো দেখছি না। সেসব কি তাহলে পেলে জাদুঘরের জন্য তুলে রাখা হয়েছে? সান্তোসেই পেলে জাদুঘরের কাজ শুরু হয়েছে বছর খানেক আগে। বিশ্বকাপের আগেই যেটি তৈরি হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। নতুন তারিখ নির্ধারিত হয়েছে ১৫ জুন। পেলে আছেন। আছেন ‘নতুন পেলে’ হিসেবে সান্তোসে আবির্ভূত রবিনহোও। তবে পেলের আসল উত্তরাধিকার কার, সেটি বোঝাতেই নেইমারকে নিয়ে আলাদা একটি শোকেস। যেটিতে নেইমারের ছবি-জার্সি-বুট, এমনকি লন্ডন অলিম্পিকে জেতা রুপার পদকটিও। এর কয়েক হাত দূরে ব্রোঞ্জের পাত দিয়ে বানানো মহিকান চুলের নেইমারের একটি মূর্তি।
পেলে-দর্শনার্থীদের জন্য সান্তোস ক্লাবের ঠিক উল্টোদিকের রাস্তার সেলুনটাও অনেক বছর ধরেই অবশ্য দ্রষ্টব্য। ওপরে বিশাল সাইনবোর্ড। যাতে পর্তুগিজে লেখা—কাবেলেইরো দো পেলে। যার অর্থ, পেলের নাপিত। ৫৭ বছর ধরে পেলে এই সেলুনে চুল কাটান। সর্বশেষ ঘুরে গেছেন গত ১ মার্চ। ক্ষৌরকারের নাম দিদি। বিখ্যাত খদ্দেরের নামটা বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করার অনুমতি যে পেয়েছেন, সেটি তো সেলুনের নাম থেকেই স্পষ্ট। সেই সেলুনও বলতে গেলে ‘মিনি পেলে জাদুঘর’।
দেয়ালে দেয়ালে শুধু পেলের ছবি। পেলের চুল কাটছেন দিদি, এটিরও একাধিক সংস্করণ। নিজের বিশাল একটা ছবিতে পেলের দেওয়া অটোগ্রাফ। যেটির মূল কথা, দিদি তাঁর বন্ধু। সবই দেখা হলো। পেলে যে চেয়ারে বসে চুল কাটান, সেটিতে বসে ছবিও হয়ে গেল। কিন্তু সান্তোসে এসে সর্বকালের সেরা ফুটবলার, ব্রাজিলিয়ানদের কাছে যাঁর একটাই পরিচয়—‘ও রেই’ (দ্য কিং), সান্তোসে তাঁর আবাসস্থলটা দেখে না গেলে হয় নাকি! রাস্তার নামটা পাওয়া গেল। ট্যাক্সি ড্রাইভারকে দেওয়া দিদির নির্দেশনাও।
সেই বাড়ি আর নেই, সেখানে এখন বিশাল অ্যাপার্টমেন্ট। সেটিই নাহয় দেখি! কিন্তু আধঘণ্টা খানেক ঘোরাই শুধু সার হলো। সেটি আর খুঁজে পাওয়া গেল না। সান্তোসে পৌঁছার কিছুক্ষণ পর থেকেই শুরু হয়েছে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। বৃষ্টিস্নাত সান্তোস সৈকতকে পাশে রেখে সাও পাওলো ফেরার পথ ধরার সময় কেমন যেন ঘোর! এতক্ষণ আমরা পেলের সান্তোসে ছিলাম!