রিয়াল মাদ্রিদের জার্সিতে ভিনিসিয়ুস যতটা উজ্জ্বল, ব্রাজিলের জার্সিতে ততটা নন
রিয়াল মাদ্রিদের জার্সিতে ভিনিসিয়ুস যতটা উজ্জ্বল, ব্রাজিলের জার্সিতে ততটা নন

ভিনিসিয়ুস তুমি কার—রিয়াল নাকি ব্রাজিলের, নেইমার কিন্তু ব্রাজিলের ছিল

পাহাড়টা ভালোবেসেছিল মেঘকে/আর মেঘ কী ভাবে শুকনো খটখটে পাহাড়টাকে বানিয়ে তুলেছিল ছাব্বিশ বছরের ছোকরা...পুর্ণেন্দু পত্রীর কবিতার লাইনগুলো পড়লেই যে কেউই বুঝবেন, এখানে লুকিয়ে আছে ত্রিভুজ প্রেমের গল্প। ভিনিসিয়ুস জুনিয়র, রিয়াল মাদ্রিদের সমর্থক আর ব্রাজিলের ফুটবলপ্রেমীদের গল্পটাও এ রকম—ত্রিভুজ প্রেমের প্যাঁচ!

আসলে ফুটবল–বিশ্বে তারকা ফুটবলারদের অনেককে ঘিরেই আছে এমন ত্রিভুজ প্রেমের গল্প। একটা সময় যেমন লিওনেল মেসিকে নিয়ে বলা হতো—তিনি যতটা না আর্জেন্টিনার, তার চেয়ে বেশি বার্সেলোনার। এখন একই কথা বলা হচ্ছে ভিনিসিয়ুস জুনিয়রকে নিয়ে—তিনি যতটা না ব্রাজিলের, এরচেয়ে বেশি রিয়াল মাদ্রিদের। নেইমারের গল্পটা অবশ্য ভিন্ন, তিনি শুরু থেকেই যেন ছিলেন ব্রাজিল ও বার্সেলোনার!

ব্রাজিল দলে ভিনিসিয়ুসের অভিষেক ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে। বিখ্যাত হলুদ জার্সিতে এখন পর্যন্ত ৩৪ ম্যাচ খেলে ৫টি করে গোল ও গোলে সহায়তা তাঁর। ম্যাচপ্রতি গোল ও গোলে সহায়তা ০.১৫ করে।

প্রীতি ম্যাচ থেকে বিশ্বকাপ, কোপা আমেরিকা, কিংবা বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব—অনেক দিন ধরেই ব্রাজিল যেন নিজেদের হারিয়ে খুঁজছে। খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, ছন্দ হারানো ব্রাজিলকে আবার দাপুটে রূপে ফিরে আসতে দেখার অপেক্ষায় থাকা দলটির সমর্থকেরা তাকিয়ে থাকত নেইমারের দিকে। কিন্তু চোটের কারণে প্রায় ১০ মাস মাঠের বাইরে আছেন নেইমার। এখন ব্রাজিলকে পুরোনো রূপে দেখতে সমর্থকেরা তাকিয়ে থাকে রিয়াল মাদ্রিদের তারকা ভিনিসিয়ুসের দিকে।

কিন্তু রিয়ালের জার্সি আর ব্রাজিলের জার্সিতে ভিনিসিয়ুসের পারফরম্যান্স আকাশপাতাল! রিয়ালের হয়ে প্রায় প্রতি ম্যাচেই দুর্দান্ত খেলা ভিনিসিয়ুস ব্রাজিলের হলুদ জার্সিটা গায়ে পরলে কেমন যেন ম্লান হয়ে যান। বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে গতকাল রদ্রিগোর একমাত্র গোলে ইকুয়েডরের বিপক্ষে জেতা ম্যাচেও ভিনিসিয়ুস খেলেছেন গড়পড়তা মানের ফুটবল। সব মিলিয়ে ব্রাজিলের ফুটবলপ্রেমীদের মধ্যে একটি প্রশ্ন ঘুরছে—ভিনিসিয়ুস তুমি কার? রিয়াল নাকি ব্রাজিলের?

রিয়াল তারকা ভিনিসিয়ুস জুনিয়র

ভিনিসিয়ুস আসলে কার, এটা বোঝার জন্য রিয়াল ও ব্রাজিলের জার্সিতে তাঁর পারফরম্যান্সে চোখ বোলানো যায়। ব্রাজিলের ক্লাব ফ্ল্যামেঙ্গো থেকে ভিনি রিয়ালে নাম লেখান ২০১৮ সালে। প্রথম মৌসুম থেকেই স্প্যানিশ ক্লাবটির মূল দলের হয়ে খেলছেন তিনি। এখন পর্যন্ত রিয়ালের হয়ে ২৬৯টি ম্যাচ খেলেছেন ভিনিসিয়ুস, গোল করেছেন ৮৪টি, সতীর্থদের ৭৮টি গোলে করেছেন সহায়তা। রিয়ালের হয়ে তাঁর ম্যাচপ্রতি গোল ০.৩১ আর ম্যাচপ্রতি গোলে সহায়তা ০.২৯।

ব্রাজিল দলে ভিনিসিয়ুসের অভিষেক ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে। বিখ্যাত হলুদ জার্সিতে এখন পর্যন্ত ৩৪ ম্যাচ খেলে ৫টি করে গোল ও গোলে সহায়তা তাঁর। ম্যাচপ্রতি গোল ও গোলে সহায়তা ০.১৫ করে। এখন যদি ব্রাজিল দলে অভিষেকের সময় থেকে রিয়ালে তাঁর পারফরম্যান্স ধরা হয়, সেটা এ রকম—২৩৯ ম্যাচে ৮১ গোল ও ৬৫টি গোলে সহায়তা। ম্যাচপ্রতি গোল ০.৩৪ ও ম্যাচপ্রতি গোলে সহায়তা ০.২৭। যার মানে, রিয়ালের তুলনায় ব্রাজিলের জার্সিতে ভিনিসিয়ুস সত্যিই খুব ম্লান।

ব্রাজিলের হয়ে এখন পর্যন্ত নেইমার ১২৮ ম্যাচ খেলে করেছেন ৭৯ গোল, গোলে সহায়তা ৫৯টি। ম্যাচপ্রতি গোল ০.৬২ ও সহায়তা ০.৩৮। ভিনির সঙ্গে তুলনা করতে যদি ব্রাজিলের হয়ে নেইমারের প্রথম ৩৪ ম্যাচের পরিসংখ্যানে চোখ রাখা হয়, সেটা তো স্বপ্নের মতো!

ক্যারিয়ারের লম্বা একটা সময় যে মেসির পিঠে তকমা লেগে গিয়েছিল—আর্জেন্টিনার নয়, বার্সার খেলোয়াড়; সেই মেসির আর্জেন্টিনা দলের পরিসংখ্যানও এর চেয়ে ভালো ছিল সব সময়। এটা ঠিক যে বার্সেলোনার হয়ে মেসি সব সময়ই অন্য গ্রহের ফুটবল খেলেছেন। দলটির হয়ে ৭৭৮ ম্যাচ খেলে তাঁর গোল ৬৭২ ও গোলে সহায়তা ৩০৩টি। ম্যাচপ্রতি গোল ০.৮৬ ও গোলে সহায়তা ০.৩৯। আর আর্জেন্টিনার হয়ে তিনি খেলেছেন ১৮৭ ম্যাচ। গোল করেছেন ১০৯টি, গোলে সহায়তা ৫৮। ম্যাচপ্রতি গোল ০.৫৮ ও গোলে সহায়তা ০.৩১।

আর্জেন্টিনার তারকা লিওনেল মেসি

কেউ কেউ বলতে পারেন, মেসি তো ক্যারিয়ারের শেষ দিকে এসে আর্জেন্টিনার প্রতি অনেক বেশি নিবেদন দেখিয়েছেন, আর্জেন্টিনাকে ২০২২ কাতার বিশ্বককাপ জিতিয়ে পিঠ থেকে নামিয়ে ফেলেছেন এক সময় ‘সিন্দাবাদের ভূত’-এর মতো জেঁকে বসা বার্সার খেলোয়াড় তকমা। তাহলে আর্জেন্টিনার হয়ে মেসির প্রথম ৩৪ ম্যাচের পরিসংখ্যান দেখে আসা যাক, সেই সময় কী করেছিলেন তিনি। ২০০৫ সালে আর্জেন্টিনা দলে অভিষেক হওয়া মেসি প্রথম ৩৪ ম্যাচে ৯ গোল করার পাশাপাশি সতীর্থদের ১০ গোলে করেছেন সহায়তা। ম্যাচপ্রতি গোল ০.২৬ ও গোলে সহায়তা ০.২৯। ব্রাজিলের হয়ে ভিনিসিয়ুস নিজের প্রথম ৩৪ ম্যাচে যা করলেন, এর চেয়ে অনেক ভালো আর্জেন্টিনার হয়ে মেসির প্রথম ৩৪ ম্যাচের পরিসংখ্যান।

শুধু মেসি কেন, রিয়াল ও ব্রাজিল দলে ভিনিসিয়ুসের বর্তমান সতীর্থ রদ্রিগোর বেলায়ও তাই। রিয়ালের হয়ে ২২১ ম্যাচ খেলে তিনি গোল করেছেন ৫৫টি, গোলে সহায়তা ৪২। ম্যাচপ্রতি গোল ০.২৫ ও ম্যাচপ্রতি গোলে সহায়তা ০.১৯। ব্রাজিল দলে অভিষেকের পর রিয়ালের হয়ে তিনি খেলেছেন ২১১ ম্যাচ, গোল ৫০টি, গোলে সহায়তা ৪১। ম্যাচপ্রতি গোল ০.২৪ ও ম্যাচপ্রতি গোলে সহায়তা ০.১৯। আর ব্রাজিলের জার্সিতে ২৮ ম্যাচ খেলে রদ্রিগোর গোল ৭টি, সহায়তা ১টি। ভিনির থেকে ব্রাজিলের হয়ে গোল করায় অনেক এগিয়ে রদ্রিগো, তা ছাড়া ক্লাব ও জাতীয় দলের হয়ে সমানতালে খেলে যাচ্ছেন তিনি।

ব্রাজিল ফরোয়ার্ড নেইমার

নেইমার তো এ ক্ষেত্রে ভিনির চেয়ে অনেক অনেক এগিয়ে। এমনকি মেসির চেয়েও এগিয়ে নেইমার। ক্লাবের তুলনায় জাতীয় দলেই যেন বেশি ভালো খেলেন বর্তমানে আল হিলালে খেলা ব্রাজিলিয়ান তারকা। বার্সার হয়ে নেইমার ১৮৬ ম্যাচ খেলে ১০৫ গোল করার পাশাপাশি সতীর্থদের ৭৬টি গোলে সহায়তা করেছেন। ম্যাচপ্রতি গোল ও গোলে সহায়তা যথাক্রমে ০.৫৬ ও ০.৪১। পিএসজির হয়ে তিনি খেলেছেন ১৭৩ ম্যাচ, গোল ১১৮টি ও সহায়তা ৭৭টি। ম্যাচপ্রতি গোল ০.৬৮ ও সহায়তা ০.৪৫।

ব্রাজিলের হয়ে এখন পর্যন্ত নেইমার ১২৮ ম্যাচ খেলে করেছেন ৭৯ গোল, গোলে সহায়তা ৫৯টি। ম্যাচপ্রতি গোল ০.৬২ ও সহায়তা ০.৩৮। ভিনির সঙ্গে তুলনা করতে যদি ব্রাজিলের হয়ে নেইমারের প্রথম ৩৪ ম্যাচের পরিসংখ্যানে চোখ রাখা হয়, সেটা তো স্বপ্নের মতো! ব্রাজিলের হয়ে প্রথম ৩৪ ম্যাচে নেইমারের গোল ২০টি, গোলে সহায়তা ১৩। ম্যাচপ্রতি গোল ০.৫৯ আর গোলে সহায়তা ০.৩৮।

তাহলে কী বুঝলেন? নেইমার যতটা ক্লাবের, ততটাই ব্রাজিলেরও। রদ্রিগোও হয়তো সে পথেই হাঁটছেন। ভিনি কি পারবেন নেইমার হতে, নাকি তিনি শেষবেলায় গিয়ে মেসির মতো পিঠ থেকে নামাবেন সিন্দাবাদের ভূত!