দ্রোণাচার্য গার্দিওলার তিন অর্জুন

তাঁরা তিনজন আলাদা তিনটি লিগের ১ নম্বরে থাকা দলের কোচ। তিনজনই একই গুরুর শিষ্য

জাভি হার্নান্দেজ। বার্সেলোনার কিংবদন্তি মিডফিল্ডার, সর্বকালের সেরা মিডফিল্ডারদের একজনও। এখনকার পরিচয়—বার্সেলোনার কোচ। লা লিগায় তাঁর দলের এ মুহূর্তে অবস্থান—১৮ ম্যাচে ৪৭ পয়েন্ট নিয়ে ১ নম্বরে।

মিকেল আর্তেতা। বার্সেলোনার একাডেমিতেই বেড়ে ওঠা স্প্যানিশ মিডফিল্ডার। তবে ক্যারিয়ারের সবচেয়ে ভালো সময়টা কাটিয়েছেন ইংল্যান্ডের এভারটন ও আর্সেনালে। এখনকার পরিচয়—আর্সেনালের কোচ। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে তাঁর দলের অবস্থান—১৯ ম্যাচে ৫০ পয়েন্ট নিয়ে ১ নম্বরে।

ভিনসেন্ট কোম্পানি। তর্কযোগ্যভাবে বেলজিয়ান ফুটবল ইতিহাসের সেরা সেন্টারব্যাক। দেশের ক্লাব আন্ডারলেখটে বড় হলেও প্রায় পুরো ক্যারিয়ারই কাটিয়েছেন ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার সিটিতে। এখনকার পরিচয়—বার্নলির কোচ। ইংলিশ চ্যাম্পিয়নশিপে তাঁর দলের অবস্থান—২৮ ম্যাচে ৬২ পয়েন্ট নিয়ে ১ নম্বরে।

অমিল অনেক আছে। তবে তিনজনের মধ্যে যা সবচেয়ে বড় মিল, সেটা তো এরই মধ্যে বুঝে গেছেন। তিনজন আলাদা তিনটি লিগের ১ নম্বরে থাকা দলের কোচ। কিন্তু এ রকম তো আরও অনেক কোচের দলই ইউরোপের বিভিন্ন লিগে ১ নম্বরে। আলাদা করে এই তিনজনের কথা কেন?

সেটা অন্য একটা মিলের কারণে এবং সেটা বেশ চমকপ্রদ। তিনজনই একই গুরুর শিষ্য এবং সেই গুরুর নাম বললেই আপনি চিনে ফেলবেন। জাভি, আর্তেতা ও কোম্পানির সেই দ্রোণাচার্য ফুটবল ইতিহাসের সেরা কোচদের একজন—পেপ গার্দিওলা।

ম্যান সিটি কোচ পেপ গার্দিওলা

শিষ্যের অবশ্য প্রকারভেদ আছে। জাভি ও কোম্পানি যেমন সরাসরিই গার্দিওলার অধীনে খেলেছেন। তাঁদের কোচ হয়ে ওঠার পেছনেও গার্দিওলারই বড় ভূমিকা, এটাও দুজন নানা সময়ে বলেছেন। আর্তেতার ব্যাপারটা আলাদা। তিনি কখনো গার্দিওলার দলে খেলেননি। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই গার্দিওলাকে আদর্শ মেনে বড় হয়েছেন।

১৫ বছর বয়সে যখন বার্সেলোনার বি দলে যোগ দেন, তখনই যা জানিয়ে দিয়েছিলেন। গার্দিওলা বার্সেলোনার বি দলের দায়িত্ব নেওয়ার আগেই আর্তেতা সেই দল ছেড়ে গেছেন। ছোটবেলার আইডলের অধীনে খেলার স্বপ্ন তাই আর পূরণ হয়নি। তবে গার্দিওলার কাছ থেকে শেখার স্বপ্ন তাঁর ঠিকই পূরণ হয়েছে, সেটা অন্যভাবে।

অবসরের পর তিনটা প্রস্তাব পেয়েছিলেন আর্তেতা। আর্সেনাল একাডেমির দায়িত্ব নেওয়া, টটেনহামে মরিসিও পচেত্তিনোর সহকারী হিসেবে যোগ দেওয়া অথবা ম্যানচেস্টার সিটিতে গার্দিওলার সহকারী কোচ হওয়া। সিদ্ধান্ত নিতে মোটেও ভাবতে হয়নি আর্তেতাকে।

তিন বছরের কিছু বেশি সময় গার্দিওলার সঙ্গে কাজ করেছেন আর্তেতা। এ সময় জিতেছেন দুটি প্রিমিয়ার লিগ, একটি এফএ কাপ ও দুটি লিগ কাপ। শিক্ষাটা যে বৃথা যায়নি, সেটার প্রমাণ দিতেও আর্তেতা দেরি করেননি। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে আর্সেনালের কোচ হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর নিজের প্রথম মৌসুমেই এফএ কাপ জিতেছেন। সেই জয়ের পথে সেমিফাইনালে আর্সেনাল কোন দলকে হারিয়েছিল মনে আছে তো? পেপ গার্দিওলার ম্যান সিটি!

বার্সেলোনা কোচ জাভি

এমনিতে অবশ্য দুজনের মুখোমুখি লড়াইয়ে গার্দিওলাই এগিয়ে। সব টুর্নামেন্ট মিলিয়ে ৮ বার দেখা হয়েছে দুজনের। এফএ কাপের সেমিফাইনালে সেই হার ছাড়া বাকি ৭টি ম্যাচেই জিতেছেন গার্দিওলা। কিন্তু এই মৌসুমে সেই গার্দিওলাই কঠিন পরীক্ষায়। প্রিমিয়ার লিগে আর্সেনালের চেয়ে এক ম্যাচ বেশি খেলেও ৫ পয়েন্টে পিছিয়ে সিটি। লিগে আর্সেনালের বিপক্ষে সিটির দুটি ম্যাচই অবশ্য এখনো বাকি। শিরোপার লড়াইয়ে থাকতে হলে আর্তেতার বিপক্ষে সেই দুটি ম্যাচেই জিততে হবে গার্দিওলার। গুরু–শিষ্য লড়াইটা এবার তাই বাড়তি উপাদেয়।

জাভি বা কোম্পানি অবশ্য এখন সরাসরি গার্দিওলার প্রতিপক্ষ নন। বার্সেলোনায় গার্দিওলার অধীনে খেলা জাভি তাঁর প্রিয় দলের কোচ হয়ে ফিরেছেন ২০২১ সালের নভেম্বরে। তাঁর অধীনে প্রথম মৌসুমে বার্সা লিগ শেষ করেছিল দ্বিতীয় হয়ে।

এবার লিগে শীর্ষে থাকলেও চ্যাম্পিয়নস লিগে আগেরবারের মতোই এবারও গ্রুপ পর্ব থেকেই ছিটকে গেছে বার্সা। এর ফলে গার্দিওলার মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ থাকছে না জাভির। তবে গত বছর আগস্টেই প্রাক-মৌসুম প্রীতি ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছিল বার্সা-সিটি। ৩-৩ সমতায় শেষ হয়েছিল গুরু–শিষ্যের সেই লড়াই।

করোনা থেকে সেরে উঠেছেন আর্সেনাল কোচ আর্তেতা। ছবি: এএফপি

জাভির মতো কোম্পানিও গার্দিওলার সরাসরি ছাত্র। সিটিতে গার্দিওলার অধীনে তিন মৌসুম অধিনায়কত্ব করেছেন বেলজিয়ান সেন্টারব্যাক, জিতেছেন দুটি প্রিমিয়ার লিগ, একটি এফএ কাপ ও  দুটি লিগ কাপ। গত বছরের জুনে বার্নলির দায়িত্ব নেওয়া কোম্পানি কোচ হিসেবে এখনো মুখোমুখি হননি তাঁর গুরুর। সেই সুযোগ এমনিতেই কম। কোম্পানির দল বার্নলি খেলে চ্যাম্পিয়নশিপে।

তবে এ মৌসুমে এফএ কাপে দুই দলই এখনো টিকে আছে। সেখানে ভাগ্য সিটি-বার্নলিকে মুখোমুখি করে দিতেও পারে। তবে এবার না হলেও পরের মৌসুমে গুরুর মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ হয়তো পাবেন কোম্পানি। তাঁর দল এবার চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে আগামী মৌসুমের প্রিমিয়ার লিগে উঠে আসবে বলেই মনে হচ্ছে। আর গার্দিওলা তো ২০২৫ পর্যন্ত সিটির সঙ্গে চুক্তি নবায়ন করেই রেখেছেন।

বার্নলি কোচ ভিনসেন্ট কোম্পানি

আর্তেতার পর তাহলে নিজের আরও এক শিষ্যকে প্রিমিয়ার লিগে সরাসরি প্রতিপক্ষ হিসেবে পাবেন গার্দিওলা। কে জানে, বার্সেলোনা আগামীবার চ্যাম্পিয়নস লিগে থাকলে দেখা হতে পারে আরেক শিষ্য জাভির সঙ্গেও।

গার্দিওলাকে নিয়ে তাঁরা তিনজন

জাভি

আমার ফুটবল–দর্শন আসলে তাঁর দর্শনের মতোই। আমি তাঁর কাছ থেকে অনেক শিখেছি। তিনি কীভাবে কাজটা করেন, তাঁর লক্ষ্য কী, ফুটবলটা তিনি কীভাবে দেখেন, অনেক কিছুই। তিনি ফুটবল-পাগল এক ট্যাকটিশিয়ান, তাঁর আশপাশে থাকাটাও আনন্দময়। আমরা প্রায়ই কথা বলি, আমাদের মধ্যে দারুণ সম্পর্ক। অবসর পেলে আমরা দেখা করি, একসঙ্গে খেতে খেতে ফুটবল নিয়ে কথা বলি।

ভিনসেন্ট কোম্পানি

আমার কোচ হওয়ার পেছনে তাঁরই সবচেয়ে বড় ভূমিকা। আমার ফুটবল ক্যারিয়ারেও তাঁর বড় অবদান। তিনি আমাকে খেলাটা অন্যভাবে দেখতে শিখিয়েছেন। আমার কাছে তিনি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেমন গুরুত্বপূর্ণ আরও অনেক খেলোয়াড় ও কোচের কাছে। তিনি কীভাবে সমস্যা সমাধান করেন, সেই ধারণাটা আমি নিয়েছি, তবে সমাধান আমাকে আমার মতোই করতে হয়।

মিকেল আর্তেতা

১৫ বছর বয়স থেকে তিনি আমার আদর্শ। তখন থেকেই পরিচয় এবং আমাদের দুজনের সম্পর্ক। কোথাও কোচিং না করিয়েও যে আমি তাঁর সহকারী হতে পেরেছি, সেটা তাঁর আগ্রহের কারণেই। তিনি আমাকে অনেক স্বাধীনতা দিয়েছিলেন কাজ করার। অনেক বেশি শুনতেন, বলতেন কম। আমাকে আত্মবিশ্বাস দিতেন সব সময়, যেন তিনি তখন থেকেই জানতেন, আমি ভালো কোচ হব।
মিকেল আর্তেতা ও পেপ গার্দিওলা, তখন ম্যানচেস্টার সিটিতে দুজন গুরু-শিষ্য

তাঁদের তিনজনকে নিয়ে গার্দিওলা

জাভি

জাভিকে আমার উত্তরসূরি হওয়ার দরকার নেই, কারও উত্তরসূরিই হওয়ার দরকার নেই। সে একেবারে নিজের মতো হবে। ওর রক্তে বার্সেলোনার ডিএনএ। আমি নিশ্চিত, সে বার্সেলোনাকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে।

কোম্পানি

ভিনসেন্ট কোম্পানি অসাধারণ এক অধিনায়ক ছিল। দলকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করতে পারত সে। সে ভালো কোচ এবং আমি নিশ্চিত একদিন সে ম্যানচেস্টার সিটিরও কোচ হবে। এটা আমারও ইচ্ছা।

আরতেতা

মিকেল সব সময়ই শেখে। যখন আমরা একসঙ্গে কাজ করতাম, আমিই বেশি শিখেছি ওর কাছ থেকে। ওর ধৈর্য দারুণ। কোচদের সময় দিতে হয়। আমি খুশি যে আর্সেনাল ওর ওপর আস্থা রেখে সেই সময় দিচ্ছে।