কোলে দশ মাসের কন্যাশিশু। ব্যাকপ্যাকে নিয়ে এসেছেন শিশুকন্যার আনুষঙ্গিক সামগ্রী। দুধ আর পানির ফিডার, কিছু খাবার। ধানমন্ডির আবাহনী লিমিটেডের মাঠে দলের অনুশীলনে দেখা মিলল আলিনা মেলোর। তাঁর পরিচয়, ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার জোনাথন ফার্নান্দেজের স্ত্রী। স্বামীর অনুশীলন যেন তাঁর কাছে উপলক্ষই। মাঠের এক পাশে ম্যাট বিছিয়ে বসে রইলেন। একমনে দেখতে থাকলেন অনুশীলন। জোনাথনের কারিকুরিতে মুগ্ধ হয়ে মাঝেমধ্যে হাততালিও দিচ্ছিলেন।
রিও ডি জেনিরোতে জন্ম আর বেড়ে ওঠা। জোনাথনও ব্রাজিলের সবচেয়ে বড় শহর রিওরই সন্তান। ব্রাজিলের শীর্ষ পর্যায়ের ক্লাব বোতাফোগো দিয়েই শুরু তাঁর। খেলেছেন সাও বেন্তো, গুয়ারানি ও আতলেতিকো ক্লাব গোইয়ানিয়েনসেতে। দুজনের পরিচয় আট বছর আগে। পরিচয় থেকে পরিণয়, এরপর বিয়ে। আলিনা–জোনাথনের ঘরে এসেছে মেয়ো। মায়ের কোলে চেপে মাঠে আসা মেয়োও আবাহনী ক্লাবে যথেষ্ট আদরের। অনুশীলনের আগ দিয়ে মেয়োকে নিয়ে রীতিমতো কাড়াকাড়ি—আবাহনীর খেলোয়াড়, কর্মকর্তা এমনকি অন্য সহকারীদের মধ্যে। কে, কার আগে কোলে নেবেন। মা আলিনা নির্ভার। বোঝাই যাচ্ছে মেয়োও অভ্যস্ত ভালোবাসার এই ‘অত্যাচারে’।
বাংলাদেশ আলিনার কাছে নতুন দেশ নয়। ২০১৯ সালে প্রথম এসেছিলেন এই দেশে। স্বামী জোনাথনের সঙ্গেই। জোনাথন তখন বসুন্ধরা কিংসের খেলোয়াড়। এসেই বাজিমাত করেছিলেন। কিংসের অন্যতম সেরা বিদেশি ছিলেন তিনি। কোস্টারিকার দানিয়েল কলিন্দ্রেস আর ব্রাজিলের রবসন দা সিলভার সঙ্গে তাঁর রসায়ন দেশের ঘরোয়া ফুটবলে জন্ম দিয়েছিল নতুন এক অধ্যায়ের। সেই জোনাথনই এখন আবাহনীর অন্যতম ভরসা। আলিনাও জানেন, আবাহনী বাংলাদেশের ফুটবলের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী ক্লাব। তাই তো বলেন, ‘এই দেশে আমি এসেছি ২০১৯ সালে। জোনাথন তখন বসুন্ধরা কিংসে খেলে। সব সময়ই দারুণ সময় কেটেছে বাংলাদেশে। মাঝখানে জোনাথন চোটে পড়ে কিংসকে বিদায় জানায়। এবার এসেছে আবাহনীতে। আমরা জানি আবাহনী বাংলাদেশের পুরোনো আর বড় ক্লাব। বহু সাফল্য আছে তাদের।’
ব্রাজিলিয়ান বলেই হয়তো ফুটবলটা রক্তেই আছে। ২০০২ সালের পর ব্রাজিল বিশ্বকাপ জিততে পারেনি বলে দুঃখ বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছেন জোনাথন–পত্নী, ‘বহুদিন হয়ে গেল ব্রাজিল বিশ্বকাপ জেতে না। হয়তো দলটা আগের মতো নেই। নেইমারের ওপর আশা ছিল, কিন্তু সে আশা পূরণ করতে পারেনি। এখন আবার দেখছি ব্রাজিলিয়ান ফুটবলে নানা সমস্যা। জানি না ভবিষ্যৎ কেমন আমাদের। তবে আমি আশাবাদী।’
প্রিয় ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার কে আলিনার! নেইমার, রোনালদো নাজারিও, কাফু, রবার্তো কার্লোস, রোনালদিনিও নাকি পেলে? একনাগাড়ে কয়েকজন ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তির নাম বলে গেলেও তিনি যে উত্তরটা দিলেন, সেটি অবাকই করল, ‘আমি এই প্রশ্নের সম্মুখীন প্রায়ই হই। আমার সামনে সবাই ব্রাজিলের সব সেরা ফুটবলারের নাম বলতে থাকে। সবাইকে যে উত্তর দিই, এখনো সেটিই দেব। আমার প্রিয় ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার আমার স্বামী—জোনাথন!’
ভালোবাসার মানুষ বলেই কি! আলিনা কিছুটা গম্ভীরই হয়ে গেলেন, ‘ব্রাজিলে সবাই রোনালদিনিও, নেইমার বা রোনালদো হতে পারে না। কিন্তু ব্রাজিলিয়ানরা সবাই ফুটবল ভালোবাসে। ফুটবলার হিসেবে জোনাথনের পরিশ্রম, খেলাটার প্রতি তাঁর ভালোবাসা, সত্যিই মুগ্ধ করার মতো। আমি ফুটবলের প্রতি ওর ভালোবাসাকে সম্মান করি। হ্যাঁ, সে–ই আমার সবচেয়ে প্রিয় ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার।’
জোনাথন কথাটা শুনে হাসলেন, ‘ও আমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসে বলেই হয়তো এমনটা বলছে। তবে এটা ঠিক আলিনা ফুটবলের যে ধরনের নিবিষ্ট দর্শক, ওর সবচেয়ে প্রিয় ফুটবলার হতে পারাটা গর্বের ব্যাপার।’
বাংলাদেশের কোন জিনিসটা পছন্দ? আলিনার উত্তর, ‘অনেক কিছুই। এ দেশের মানুষ খুবই মিশুক। সবার কাছে খুবই সম্মান পাই। ঢাকা শহরের রাস্তায় রিকশা দেখে প্রথমে খুব মজা পেয়েছিলাম। আমার রিকশা চড়তে খুব ভালো লাগে। বেশির ভাগ খাবারই প্রচণ্ড ঝাল। তবে মিষ্টি খুব ভালো। আবাহনী ক্লাবের আশপাশে অনেক শপিং মল। আমি প্রায়ই যাই। তবে যমুনা ফিউচার পার্ক অনেক দূরে হওয়ায় যেতে পারছি না। জোনাথন কিংসে যখন খেলত, তখন ওখানে প্রায়ই যেতাম। বাড়ির খুব কাছে ছিল।’
রিও থেকে ঢাকায় এসেছেন ১০ দিন হয়েছে। এখনো সেভাবে থিতু হতে পারেননি। আলিনা স্বামী, সন্তান নিয়ে ক্লাবেই থাকছেন আপাতত। বলেন, ‘আপাতত আবাহনী ক্লাবেই জোনাথন আর আমি মেয়োকে নিয়ে আছি। খারাপ লাগছে না। পরিবেশটা চমৎকার। খুব শিগগিরই হয়তো একটা ফ্ল্যাটে উঠে যাব।’
স্ত্রী ও কন্যা আসায় খুব ভালো লাগছে জোনাথনের, ‘ওরা থাকলে নির্ভার থাকতে পারি। আরও ভালো খেলার প্রেরণা পাই। আমার স্ত্রী যে আমার খেলার বড় সমালোচক, সেটা তো দেখতেই পাচ্ছেন।’
প্রিমিয়ার লিগে আবাহনীর শুরুটা মোটেও ভালো হয়নি। রহমতগঞ্জের বিপক্ষে ড্র দিয়ে শুরু করে দ্বিতীয় ম্যাচেই ফর্টিস এফসির বিপক্ষে হেরে বসেছে আকাশি–নীল জার্সির দলটি। জোনাথন এটাকে ধাক্কা হিসেবেই দেখছেন, ‘আবাহনীর মতো দলের জন্য বড় ধাক্কা। তবে মাঝেমধ্যে ধাক্কাও দলকে বদলে দেয়। আমরা তেমন কিছুর অপেক্ষাতেই আছি। চেষ্টা করে যাচ্ছি বাজে শুরুর ধাক্কাটা পারফরম্যান্স দিয়েই কাটিয়ে উঠতে।’