‘পাঁচ বছর পর এরিক টেন হাগের নাম কেউ মনে রাখবে না’
গত নভেম্বরে কথাটি বলেছিলেন সাবেক লিভারপুল কোচ ও ফুটবল পণ্ডিত গ্রায়েম সুনেস। ওই সময় ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে ঘিরে ওল্ড ট্রাফোর্ডে বিরাজ করছিল অস্বস্তিকর পরিবেশ; পুরো পরিস্থিতির দায় টেন হাগকে দিতে গিয়ে অমন মন্তব্য করেছিলেন একাধিক প্রিমিয়ার লিগ ক্লাবের ডাগআউট সামলানোর অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সুনেস।
নভেম্বরের পর মার্চ—খুব বেশি সময় গড়ায়নি। উল্টে যায়নি সুনেসের কথাটাও। এ সময় টেন হাগও এমন কিছু করেননি যে তাঁর নাম ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে বিশেষভাবে খোদাই হয়ে যাবে।
তবে দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম ১০ মাসে ৫৩ বছর বয়সী এই ডাচ কোচ ইউনাইটেডকে ব্যক্তিত্ব ও দৃঢ় মানসিকতা দিয়ে যতটুকু পাল্টে দিয়েছেন, দক্ষতা আর অভিজ্ঞতায় ভর করে যে পথে তুলে এনেছেন, প্রিমিয়ার লিগের সফলতম ক্লাবটি ততটা আর দেখেনি স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন-পরবর্তী যুগে।
ফার্গুসনের ২৬ বছরের জমানায় ১৩টি প্রিমিয়ার লিগ, দুটি চ্যাম্পিয়নস লিগসহ মোট ৩৮টি শিরোপা জিতেছিল ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। ২০১৩ সালে ফার্গুসন ছেড়ে যাওয়ার পর ওল্ড ট্রাফোর্ডে এসেছেন ৬ জন কোচ। প্রায় এক দশকের এই সময়টিতে লুই ফন গালের অধীনে একটি এফএ কাপ, জোসে মরিনিওর অধীনে একটি করে লিগ কাপ, ইউরোপা লিগ ও কমিউনিটি শিল্ড এবং ডেভিড ময়েজের অধীনে একটি কমিউনিটি শিল্ড জিতেছে ইউনাইটেড।
ফার্গুসন-পরবর্তী যুগে ইউনাইটেডের সর্বশেষ শিরোপা ২০১৭ সালে। এরপর পাঁচ মৌসুম চলে গেছে ওল্ট ট্রাফোর্ডের ট্রফি কেসে নতুন কিছু যোগ হয়নি। প্রায় অর্ধযুগ অপেক্ষার পর এখন একটি ট্রফির খুব কাছে দাঁড়িয়ে ইউনাইটেড। আজ লিগ কাপের (কারাবাও কাপ নামে পরিচিত) ফাইনালে নিউক্যাসল ইউনাইটেডের বিপক্ষে খেলবে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড।
শিরোপাটি ইউনাইটেড জিতবে কি না, রাতেই জানা যাবে। তবে না জিতলেও টেন হাগের ‘ইমপ্যাক্ট’ ঠিক আড়ালে পড়ে যাওয়ার নয়। এরই মধ্যে এফএ কাপের পঞ্চম রাউন্ডে জায়গা করে নিয়েছে ইউনাইটেড।
প্রিমিয়ার লিগে আছে পয়েন্ট তালিকার তিন নম্বরে। গত সপ্তাহে বার্সেলোনাকে হারিয়ে টিকিট কাটা হয়ে গেছে ইউরোপা লিগের শেষ ষোলোতেও। সব মিলিয়ে বছরের এই সময়ে চারটি শিরোপার লড়াইয়ে থাকা একমাত্র ইংলিশ ক্লাব ইউনাইটেডই।
দলগত এই ছন্দময় যাত্রাপথে কিছু দারুণ মাইলফলকও স্পর্শ করেছে ওল্ড ট্রাফোর্ডের ক্লাবটি। বুধবার রাতে যে ম্যাচটি জিতে ইউনাইটেড ইউরোপা লিগের শেষ ষোলোয় জায়গা করেছে, সেটি ছিল ওল্ট ট্রাফোর্ডে টানা ১৮তম অপরাজিত ম্যাচ। যার মধ্যে ১৬টিতেই জয়, ড্র দুটি।
বার্সার বিপক্ষে জয়টি চলতি মৌসুমে ইউনাইটেডের ২৮তম। ইউরোপের শীর্ষ পাঁচটি লিগের আর কোনো ক্লাব এবারে মৌসুমে এত ম্যাচ জিততে পারেনি।
কোচ হিসেবে জয়ের শতাংশেও ইউনাইটেড ডাগআউটের শেষ পাঁচজনকে ছাড়িয়ে গেছেন টেন হাগ। তাঁর অধীনে খেলা ৩৯ ম্যাচে ইউনাইটেডের জয়ের হার ৭১ শতাংশ। ফার্গুসন-পরবর্তী যুগে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সাফল্যের রেকর্ড গড়া জোসে মরিনিও অনেকটা পেছনে, ৫৮ শতাংশ (১৪৪ ম্যাচে ৮৪ জয়)।
এই যে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বদলে যাওয়া, ফার্গুসন যুগের পর আবারও সব কটি প্রতিযোগিতায় বড় শক্তি হিসেবে নিজেদের জানান দিতে পারা—এর মূলে টেন হাগেরই অবদান দেখছেন ইংলিশ ডিফেন্ডার লুক শ।
হাই প্রেসিং, বল দখলে রাখার প্রবণতা আর ফুল ব্যাকও মাঠের সামনের দিকে এগিয়ে খেলার যে ধরন ইউনাইটেডের খেলায় দেখা যায়, সেটির মূলে ডাচ কোচের ফুটবল-দর্শন। বিবিসি স্পোর্টসকে দেওয়া শর মন্তব্যে আছে সেই ছাপ, ‘কোচ চান পজেশনভিত্তিক খেলা। অনুশীলনে ট্যাকটিক্যাল স্টাফদের সঙ্গে প্রচুর কাজ করতে হয় আমাদের। টেন হাগ চান প্রতিপক্ষের ওপর চাপ সৃষ্টি করে খেলি, ম্যাচজুড়ে আক্রমণাত্মক থাকি।’
নিজস্ব ফুটবল-দর্শন বাস্তবায়নে দলের ওপর দরকার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ। আর সেই নিয়ন্ত্রণের কাজটি বেশ কঠোর হস্তেই করেন টেন হাগ। খেলোয়াড় যত বড় তারকাই হোক, বিশেষ কদর নেই তাঁর কাছে। রোনালদোর সঙ্গে তাঁর অস্বস্তিকর সম্পর্কের সূত্রপাত তেমনই এক ঘটনা থেকে।
ইউনাইটেড ছাড়তে মরিয়া রোনালদো ২০২২-২৩ শুরুর প্রাক্-মৌসুমে অনুপস্থিত ছিলেন। যার সূত্রে দুজনের সম্পর্কে অবনতি ঘটতে শুরু করে। এরপর মাঠে রোনালদোর প্রভাব বিবেচনায় তাঁকে খেলিয়েছেনও কম। ম্যাচের পর ম্যাচ বেঞ্চে বসিয়েছেন, বদলি হতে অস্বীকৃতি জানানোয় পরের ম্যাচের স্কোয়াড থেকে বাদও দিয়েছেন। যেটিকে পরে নিজের প্রতি অসম্মান উল্লেখ করে বিস্ফোরক সাক্ষাৎকারও দেন রোনালদো।
শুধু রোনালদো নন, বছরের শেষ দিকে তাঁর দেওয়া শাস্তি ভোগ করেছেন আক্রমণভাগে দারুণ ছন্দে থাকা মার্কাস রাশফোর্ডও। শৃঙ্খলা ভঙ্গ করায় উলভারহাম্পটনের বিপক্ষে তাঁকে প্রথম একাদশে নামাননি টেন হাগ।
লুক শর ভাষায় বিষয়টি আরও ভালোভাবে ফুটে উঠেছে, ‘বড় ব্যাপার হচ্ছে স্কোয়াডের মধ্যে তিনি কিছু নিয়ম জারি করেছেন এবং নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছেন। সবাইকে তাঁকে অনুসরণ করতে হয়। তিনি যা চান, তা কেউ না মানলে খেলার সুযোগ নেই। আপনি কে, সেটা কোনো ব্যাপার নয়।’
সবটাই যে নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা, তা নয়। খেলোয়াড়দের নিজেদের সমস্যা নিয়ে কোচের সঙ্গে কথা বলার সুযোগও অবারিত করে দিয়েছেন টেন হাগ। যেটা ওল্ড ট্রাফোর্ডে অনেক দিনই ছিল না বলে খবর ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমের। টেন হাগের কোচিংয়ে ঝুঁকি গ্রহণের প্রবণতাও স্পষ্ট। স্ট্রাইকার ভাউট ভেঘোর্স্টকে নাম্বার টেন হিসেবে খেলিয়ে রাশফোর্ডকে আরও মুক্তভাবে খেলার জায়গা করে দেওয়া, লুক শকে মাঝমাঠে খেলানো যার অন্যতম।
এভাবে মাঠের কৌশল বদলিয়ে ও সুশৃঙ্খল থেকে ইউনাইটেডকে বদলে দেওয়ার কাজটি করে চলেছেন টেন হাগ। যার চূড়ান্ত লক্ষ্য রেড ডেভিলদের আবারও শিরোপার দাবিদার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। ওল্ড ট্রাফোর্ডে একের পর এক ট্রফি নিয়ে আসা।
যার প্রথমটি আসতে পারে আজ লিগ কাপের ফাইনাল শেষে।