আবাহনী ক্লাব প্রাঙ্গণে আজ কে ছিলেন না! কিংবদন্তি হকি খেলোয়াড় আবদুস সাদেক, সত্তরের দশকের ফুটবলার আশরাফ আলী থেকে শুরু করে দেওয়ান শফিউল আরেফিন টুটুল, আবদুল গাফফার, শেখ মোহাম্মদ আসলাম, গোলাম গাউস, জাকির হোসেন, আলমগীর হাসান, জুলফিকার মাহমুদ, বিপ্লব ভট্টাচার্য; ছিলেন সাবেক ক্রিকেটার গাজী আশরাফ হোসেন, দিপু রায় চৌধুরী, খালেদ মাহমুদরাও। অন্য সময় হলে এটিকে আবাহনীর সাবেক খেলোয়াড়দের একটা মিলনমেলাই বলা যেত।
কিন্তু ধানমন্ডির আবাহনী ক্লাবে আজ বিকেলে জনা পঞ্চাশেক সাবেক খেলোয়াড় ও সংগঠক এসেছিলেন ভারাক্রান্ত হৃদয়ে। ক্লাবের পরিচালক কাজী ইনাম আহমেদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে তাঁরা এসেছিলেন আবাহনীতে ঘটে যাওয়া ধ্বংসযজ্ঞের ক্ষতচিহ্ন দেখতে। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার পর শেখ কামাল প্রতিষ্ঠিত আবাহনী ক্লাবে আক্রমণ চালায় একদল দুষ্কৃতকারী। ঘটেছে ব্যাপক ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা। দুর্বৃত্তরা লুট করে নিয়ে গেছে আবাহনীর ৫২ বছরের ইতিহাসের সাক্ষী প্রায় সব স্মারক ও ট্রফি। আজ ক্লাবে হাজির হয়ে সাবেক ও বর্তমান খেলোয়াড়-সংগঠকেরা আরজি জানিয়েছেন, লুট হয়ে যাওয়া ঐতিহাসিক ট্রফি ও স্মারকগুলো যেন ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
দুর্বৃত্তরা ক্লাবের অফিস রুমের এসি, কম্পিউটার খুলে নিয়ে যায়, কাগজপত্রে আগুন ধরিয়ে দেয়, এমনকি বাথরুমের স্যানিটারিসামগ্রীও নিয়ে যায়। এর মধ্যে ক্লাবের ট্রফি ও স্মারক লুট হয়ে যাওয়াটাই বেশি ব্যথিত করেছে সবাইকে। সভাকক্ষের শোকেসে থাকা এই ট্রফিগুলো আবাহনীর ৫২ বছরের ইতিহাসের সাক্ষী। ক্লাব প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে সাবেক তারকা ফুটবলার দেওয়ান শফিউল আরেফিন টুটুল বললেন, ‘যাঁরা ট্রফিগুলো লুট করে নিয়ে গেছেন, তাঁরা এসব কোথাও বিক্রি করতে পারবেন না। আর বিক্রি করতে পারলেও সেটি করতে হবে ভাঙারি হিসেবে। কিন্তু এই ট্রফিগুলোর সঙ্গে মিশে আছে আমাদের অনেক স্মৃতি, আবাহনীর ঐতিহ্য, আমি অন্তত এই ট্রফিগুলো যেন তাঁরা ফেরত দেন, সেই আনুরোধ করছি।’
আবাহনীর প্রথম অধিনায়ক ও হকি কিংবদন্তি আবদুস সাদেকের কথা, ‘আবাহনী ক্লাব এর আগেও অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে। কিন্তু এমন ঘটনা তো কখনো ঘটেনি। এই ক্লাবের সঙ্গে কত স্মৃতি জড়িয়ে। এই ক্লাব তো সবার। খুব কষ্ট পেয়েছি এই অবস্থা দেখে। আবাহনীর ইতিহাস-ঐতিহ্যই তো লুট হয়ে গেছে।’
জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক গাজী আশরাফ হোসেনও চান, লুটপাটকারীরা অন্তত আবাহনীর বিজয়ের স্মারকগুলো ফিরিয়ে দিক, ‘১৯৮০ সালে মাত্র ২০ বছর বয়সে এই ক্লাবে এসেছি। আবাহনীতে অনেক স্মৃতি। কত শিরোপা জিতেছি, কত সাফল্য পেয়েছি, সেই সাফল্যের স্মারকগুলো লুট হয়ে যাবে, ভাবতেই পারছি না। সেদিন যেসব জিনিস নষ্ট হয়েছে, তার অনেক কিছুই আবার প্রতিস্থাপন করা যাবে। কিন্তু ইতিহাস তো অমূল্য। সেটা কীভাবে ফেরত পাব?’
সাবেক ক্রিকেটার খালেদ মাহমুদ আবাহনী ও মোহামেডানের মতো ঐতিহ্যবাহী ক্লাবকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে রাখার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘অনেকেই আবাহনী বলতে আওয়ামী লীগ আর মোহামেডান বলতে বিএনপি বোঝেন, এটা ঠিক নয়। আবাহনী, মোহামেডান এ দেশের সব মানুষের ক্লাব। আমি নিজেও দুই ক্লাবেই খেলেছি। এই যে ট্রফিগুলো লুট হলো, এগুলো সোনা বা হিরের নয়, কিন্তু এসব ক্লাবের অমূল্য সম্পদ।’
সাবেক ফুটবলার আবদুল গাফফার মনে করেন, নতুন প্রজন্মের দেখার জন্যই ট্রফিগুলো ফেরত পাওয়া দরকার, ‘আমরা এই ট্রফিগুলো এই প্রজন্মকে দেখাতে চাই। আবাহনীর ঐতিহ্য ৫২ বছরের পুরোনো, ঐতিহ্যের স্মারক না থাকাটা খুব কষ্টের। যাঁরা লুট করে নিয়ে গেছেন, তাঁদের আশ্বস্ত করছি, আপনারা এগুলো ফেরত দিন, কোনো সমস্যায় পড়বেন না।’
এই দুঃসময়েও আবাহনীর কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে বলে সবাইকে আশ্বস্ত করেছেন ক্লাবের পরিচালক কাজী ইনাম আহমেদ, ‘আবাহনী বাংলাদেশের ক্লাব, বাংলাদেশের মানুষের ক্লাব, ধানমন্ডির ক্লাব, খেলোয়াড় ও সংগঠকদের ক্লাব। অনুরোধ করছি, এগুলো ফেরত দিন। আর সবাইকে আশ্বস্ত করছি, পরিস্থিতি যা-ই হোক, আবাহনী সব খেলাতেই দল গঠন করে খেলবে। আমরা ৫২ বছর ধরে আছি, আগামী ৫২ বছরও থাকব।’
আজ ক্লাবে আরও এসেছিলেন সংগঠক আহমেদ সাজ্জাদুল আলম, সাবেক ফুটবলার আশরাফউদ্দিন আহমেদ চুন্নু, খুরশিদ আলম বাবুল, সত্যজিৎ দাস রুপু, ইকবাল হোসেন। ক্রিকেটারদের মধ্যে ছিলেন ইমরান হামিদ, জাহিদ হোসেন প্রমুখ।