ভিনিসিয়ুসের হাতে ‘দ্য বেস্ট’ ট্রফি
ভিনিসিয়ুসের হাতে ‘দ্য বেস্ট’ ট্রফি

রাস্তার ছেলেটির নাম ছিল ভিনি, এখন ভিনি ‘বেস্ট’

ওজনে মাত্র ৬.৪ কেজি। উচ্চতা মেরেকেটে ১ ফুট। সোনার লেশমাত্র নেই। পুরোটাই প্লাটিনামে মোড়ানো। দাম অজানা। সম্মানের তুলাদণ্ডে ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফার বর্ষসেরার ওই ট্রফিটাই হয়তো শেষ কথা। দোহার এস্পায়ার একাডেমির মঞ্চ থেকে ভিনিসিয়ুসের প্রতি চেয়েছিল ট্রফিটা। ঘড়ির কাঁটায়ও ফুরাচ্ছিল না অপেক্ষা। টিক, টিক, টিক…।

মঞ্চে নামটা ঘোষণা হতেই গটগট করে হাঁটা ধরলেন ভিনিসিয়ুস। পরনের স্যুটটা কালো হলেও মুখে কৃষ্ণমেদুর হাসির চিকিমিকি উঁকি দিচ্ছে। ভিনি যখন মঞ্চের সিঁড়ি ভাঙছেন, তখন গজ-ফিতা নিয়ে কেউ কেউ বসে গিয়েছিলেন তাঁর এবং আরাধ্য ট্রফিটির আসল দূরত্ব মাপতে। যাত্রাটা শুরু হয়েছিল ঠিক কবে, কোত্থেকে?

রিও ডি জেনিরোর ছোট্ট পৌরসভা সাও গনকালো। সেখানকার রাস্তায় রাস্তায় বল পায়ে ড্রিবলিংয়ের সময় যে দৌড়টা শুরু করেছিলেন, কালে কালে সেই দৌড়ই পূর্ণ মাত্রা থেকে খানিক বিরতিতে প্রশান্তির হাঁটা হয়ে তাঁকে পৌঁছে দিয়েছে ফিফা ‘বেস্ট’ এর মঞ্চে। অন্য ভাষায়, ২০০৬ সালে বাবা নিয়ে গিয়েছিলেন মুতুয়ায় অবস্থিত ফ্লামেঙ্গোর শাখা অফিসে। ফ্লামেঙ্গো রত্ন চিনল। কিন্তু ধরে রাখতে পারল না। নিয়তি যে ঠিক করে রেখেছিল ওই মঞ্চটা। ফ্লামেঙ্গা থেকে তাই রিয়াল মাদ্রিদ। সেই পথে বিখ্যাত হলুদ জার্সিতেও আশা-ভরসার প্রতীক এবং তারপর বিশ্বসেরা হওয়ার দৌড়।

ভিনিসিয়ুস জুনিয়রের হাতে ‘দ্য বেস্ট’ ট্রফি তুলে দেন ফিফা সভাপতি জিয়ান্নি ইনফান্তিনো

সেই দৌড়ে গত অক্টোবরে আসি আসি করেও ব্যালন ডি’অরটা এল না। রদ্রির কাছে হারলেন ৪১ পয়েন্টে। ভিনি-যাত্রার এই পথ পর্যন্ত তাঁকে আপনার চেনা থাকলে এটাও জানেন, ২৪ বছরের ছেলেটি মনে মনে ভীষণ লড়াকু। বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়ছেন। লড়লেন ব্যালন ডি’অর না জেতায় করুণা কিংবা তির্যক চাহনিতে তাকানোদের সঙ্গেও। সেই রণ-যাত্রার পথেই দোহা-বিরতিতে ভিনির হাতে উঠল খুব প্রত্যাশিত ট্রফিটা।

অবশেষে! হ্যাঁ, অবশেষে বিশ্বসেরা হলেন কিংবা এই কাতারে উঠে আসার স্বীকৃতিটুকু পেলেন ভিনিসিয়ুস। যে স্বীকৃতির খোঁজে তাঁর যাত্রাটা শুরু হয়েছিল সাও গনকালো থেকে, সেই পথে হাঁটতে হাঁটতে ফিফার মঞ্চে উঠে সভাপতির কাছ থেকে ট্রফিটা নিয়ে ভিনি স্মরণ করলেন পেছনে ফেলে আসা পথ ও পথের মানুষদের।

শুনুন তাঁর মুখেই, ‘কোত্থেকে শুরু করব ঠিক জানি না। এটা (ট্রফিটি) এতটাই দূরে ছিল যে মনে হয়েছিল এ পর্যন্ত আসাটা অসম্ভব। আমি ছিলাম একটা বাচ্চা, যে সাও গনকালোর রাস্তায় খালি পায়ে ফুটবল খেলেছে। দারিদ্র্য ছিল, ছিলাম অপরাধে জড়ানোর কাছাকাছিও। এখানে আসাটা আমার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এটা অনেক শিশুদের জন্য, যারা মনে করে সবকিছুই অসম্ভব এবং এখানে আসা সম্ভব না, এটাও যারা ভাবে।’

ভিনি বলে চললেন, ‘যেসব খেলোয়াড়, কোচ, সাংবাদিক এবং আমার ভক্তরা যারা ভোট দিয়েছেন, তাদের সবাইকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। পরিবারকেও ধন্যবাদ জানাতে হবে। তারা আমারটা পূরণে নিজেদের স্বপ্ন বিসর্জন দিয়েছে। (ফিফা) সভাপতিকে ধন্যবাদ জানাই, ধন্যবাদ কার্লোকেও (রিয়াল কোচ) এবং আমার দলকে, যারা আমাকে এখানে উঠে আসতে সাহায্য করেছে, বিশ্বাস করতে শিখিয়েছে, আমিও পার্থক্য গড়ে দিতে পারি।’

ফিফা ‘দ্য বেস্ট’ ২০২৪ অনুষ্ঠিত হয়েছে কাতারের রাজধানী দোহায়

শেষে স্মরণ করেছেন ফ্লামেঙ্গোকেও, যেখান থেকে তাঁর উঠে আসা, ‘ফ্লামেঙ্গোকে ধন্যবাদ জানাতেই হবে। তারাই আমাকে মাঠে ও রাস্তায় দেখেছিল। ফ্লামেঙ্গো ছাড়া এখানে আসতে পারতাম না।’

ভিনির হাতে বেস্ট ট্রফি ওঠার পর সাও গনকালোর সিটি হলের মেয়র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বলেছেন, ‘লোকে ভোট দিলে এটা নিশ্চিত যে ব্রাজিল হতাশ হবে না। এই পুরস্কারটা তার প্রাপ্যতার চেয়েও বেশি ছিল।’

লোকের ভোট? সে তো বটেই। ব্যালন ডি’অর হাতছাড়া হওয়ার সময় থেকেই তো ভিনি পিপলস চয়েস। এবার বেস্ট পুরস্কারে তা যেন আরও ভালোভাবে বোঝা গেল। দ্বিতীয় রদ্রি যেখানে ভক্তদের ২ লাখ ৬৪,৮৩৫ পয়েন্ট পেয়েছেন, ভিনির পয়েন্টসংখ্যা সেখানে ১১ লাখ!

কোচদের পছন্দে অবশ্য এগিয়ে ছিলেন ম্যানচেস্টার সিটি তারকা। কোচদের ৪৬১ পয়েন্ট পেয়েছেন রদ্রি, ভিনি পেয়েছেন ৪৩৮। তবে অধিনায়কদের পছন্দে এগিয়ে ভিনিই। পেয়েছেন ৬১৭ পয়েন্ট। রদ্রির ৩৭৩। সাংবাদিকদের ভোটে আবার রদ্রি এগিয়ে। মাত্র ৫ পয়েন্ট ব্যবধানে। ভিনির ৫৩৮ পয়েন্ট, স্পেন তারকার ৫৪৩।

ভোটদাতাদের শীর্ষ তিনের মধ্যে শীর্ষে যিনি, তাঁর পয়েন্ট ৫, দ্বিতীয় ৩ এবং তৃতীয়কে ১ পয়েন্ট করে দেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে ভিনির মোট পয়েন্টসংখ্যা ৪৮, রদ্রির ৪৩। অর্থাৎ ৫ পয়েন্ট ব্যবধানে ভিনি জয়ী কিংবা অন্যভাবেও বলতে পারেন ‘দ্য বয় হু ড্রিবলড দ্য ওয়ার্ল্ড!’

ফিফাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ভিনির সাবেক এক শিক্ষক বলেছেন আসল কথাটা। যে প্রতিভা, তাঁকে আসলে শুরুতেই চেনা যায়,‘৮-৯ বছরে মাঠে নামানোর সময়ও বুঝতাম সে বিশেষ কিছু। এমনকি তার প্রতিপক্ষরাও বলত, ভিনিকে আটকাতে মোটরসাইকেলে চড়তে হবে।’

ভিনি বড় হয়ে ওঠার পর একই কথা শুনতে পারেন তাঁর প্রতিপক্ষদের কাছে থেকেও। গত মৌসুমেই যেমন রিয়ালকে লা লিগা ও চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতানোর পথে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ৩৯ ম্যাচে ২৪ গোলের পাশাপাশি ১১টি গোলও করিয়েছেন। চ্যাম্পিয়নস লিগে ছিলেন সর্বোচ্চ গোলদাতা। গোল করেছিলেন ফাইনালেও।

সেই ভিনি এবার হাঁটতে হাঁটতে হাসতে হাসতে গোল করলেন ফিফা বেস্টের মঞ্চেও। তাঁর এই গোলটির দাম কত? গুণে নিতে পারেন, ব্রাজিলিয়ানদের হাসিমুখগুলো পড়ে, ওজন করতে পারেন, ব্রাজিলের কোনো সুবিধাবঞ্চিত শিশুর সরল হাসিতে। ভিনি জিতলে যে জিতে যায় তারাও!