অষ্টম ব্যালন ডি’অর হাতে মেসি
অষ্টম ব্যালন ডি’অর হাতে মেসি

কেকের ওপর ছোট্ট চেরিটাও মেসির

দ্য চেরি অন দ্য কেক—ইংরেজি এই বাক্যের অর্থ হতে পারে বাড়তি পাওয়া। লিওনেল মেসির অষ্টম ব্যালন ডি’অর জেতার ব্যাপারটা অনেকটা তেমনই। বিশ্বকাপ জেতার পর ব্যক্তিগত শ্রেষ্ঠত্বের এ পুরস্কারটি মেসি না পেলেও খুব একটা ক্ষতি হতো না। মেসি নিজেও ব্যালন ডি’অর নিয়ে আকাঙ্ক্ষার সমাপ্তির কথা বলেছিলেন।

কিন্তু এবার না পেলে হয়তো ভক্তদের একটু অপূর্ণতা ও আক্ষেপ নিশ্চয় থেকেই যেত। বিশ্বকাপের জয়ের বছর বলে কথা। আজকের পর সেই অপূর্ণতাটুকুও আর থাকল না। সাতটি ব্যালন ডি’অর জিতে আগেই নিজেকে বাকিদের ধরাছোঁয়ার বাইরে নিয়ে গিয়েছিলেন মেসি। আর এবার অষ্টমটি জিতে সেই দূরত্বে তুলে দিলেন চীনের শক্ত প্রাচীর। এ প্রাচীরটি হয়তো শিগগির খুব সহজে আর ভাঙবে না।

‘সূর্য ডোবা শেষ হলো কেননা সূর্যের যাত্রা বহুদূর’—কবিতার এই লাইনের মতোই মেসির সূর্য ডোবা অর্থাৎ বৃত্তপূরণের শেষের শুরুটা হয়েছে বিশ্বকাপ দিয়ে, যা হয়তো ব্যালন ডি’অর দিয়ে আরেকটু ভরাট হলো। কিন্তু সূর্য ডুবলেই তার যাত্রা শেষ নয়, বরং সেটা নতুন শুরুও বটে। মেসিও তেমনই। বিশ্বকাপ ও ব্যালন ডি’অর ব্যক্তি মেসির ব্যক্তিগত অর্জনের ভাঁড়ারকে পূর্ণ করেছে। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে যে তুমুল রূপকথার গল্পটা মেসি আমাদের জন্য রেখে যাচ্ছেন, তা হয়তো কখনোই ফুরাবে না। যেমন ফুরায়নি পেলে কিংবা ম্যারাডোনার জাদুবাস্তব গল্প।

তবে জাদুকরি এই রূপকথার গল্পের পেছনে থাকে অনেকগুলো ছোট ছোট গল্প। সেসব গল্পই তৈরি করে মানুষের জীবনের পথ। যেখানে একটি গল্প যুক্ত হয় অন্য একটি গল্পের সঙ্গে। একটি গল্প প্রভাবিত করে অন্য একটি গল্পকে। সেসব গল্প বেশির ভাগ সময় সাধারণ কিছুই হয়ে থাকে। কিন্তু কেউ কেউ আছেন, যাঁরা গল্পের গরুকে গাছে চড়াতে পারেন অর্থাৎ অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারেন। একপর্যায়ে নিজের গল্পটা নিজেই লিখতে শুরু করেন। আর তেমনই এক গল্প থেকে মহানায়কের মতো বেরিয়ে আসেন একজন মেসি।

ব্যালন ডি’অর অনুষ্ঠানে পরিবারের সঙ্গে মেসি

মেসির পুরো জীবনটাই গেছে মাপামাপিতে। তাঁর বয়স যখন আট, তখনই মা–বাবা তাঁর উচ্চতা নিয়ে দুশ্চিন্তা করা শুরু করলেন। পরীক্ষায় জানা গেল তাঁর শরীরের নির্দিষ্ট একটি হরমোনের ঘাটতি রয়েছে। তবে ১ হাজার ৫০০ ডলারের চিকিৎসা ব্যয় বহন করা তাঁর পরিবারের পক্ষে সম্ভব ছিল না। রোজারিওর দুটি কোম্পানিও এগিয়ে এসেছিল সহায়তায়। কিন্তু দুই বছর পর টাকা ফুরিয়ে গেলে নিউওয়েলস জানাল, তাঁর ইনজেকশনের খরচ চালাতে পারবে না৷ মেসির পরিবার বুয়েনস এইরেসের রোজারিওতে গিয়ে রিভার প্লেটে ধরনা দিল।

রিভার প্লেট তাঁকে যাচাইয়ের জন্য ডাকল। সেদিন যারা ম্যাচ খেলতে এসেছিল, মেসি ছিল তাদের মধ্যে সবার ছোট। তাঁকে সুযোগও দেওয়া হলো সবার শেষে। বেশি সুযোগের অবশ্য প্রয়োজনও ছিল না। খেলা শেষে কোচ ডাক দিয়ে বললেন, ‘এই ছেলের বাবা কে?’ হোর্হে মেসি এগিয়ে এলে তিনি বললেন, ‘সে থাকবে’। এভাবেই শুরু। তবে মেসিকে কখনোই চুক্তির প্রস্তাব দেওয়া হয়নি। রিভার প্লেট কখনোই নিউওয়েলসের সঙ্গে মেসির দলবদল নিয়ে কোনো দর–কষাকষি করেনি। এমনকি তাঁর চিকিৎসার ব্যয়ও বহন করেনি। তাই ভিন্ন কিছু ভাবতেই হয় হোর্হে মেসিকে। সিদ্ধান্ত নিতে হয় বিদেশ গমনেরও।

মেসি অবশ্য সব সময় রোজারিওতেই থাকতে চেয়েছিলেন। হয়তো চেয়েছিলেন পারানা নদীতে ধীরগতির যেসব জাহাজ চলে, তাদের মতো সহজ জীবন। চেয়েছিলেন বন্ধুদের সঙ্গে লেপার ডে উদ্‌যাপন করে জীবন কাটিয়ে দিতে। কিন্তু নিয়তির অমোচনীয় কালিতে লেখা হয়েছিল মেসির ভাগ্যের অন্য পথরেখা। ভাগ্যকে আর কে ঠেকাতে পারে! মেসিও পারেননি।

২০০০ সালে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে গেলেন বার্সেলোনায়। কে জানত মেসির সামনে একদিন এই আটলান্টিককেও তুচ্ছ দেখাবে। সেদিন অবশ্য সব কিছুই অনিশ্চিত ছিল। হোর্হে মেসির মনে আশা ‘মোর দ্যান এ ক্লাব’ ফিরিয়ে দেবে না তাঁকে। তবে সেখানেও বিপত্তি। কোচ কারলেস রেক্সাস তখন বার্সেলোনায় ছিলেন না। লিও ও তাঁর বাবা হোটেলে অপেক্ষা করলেন পাক্কা দুই সপ্তাহ।

আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ জিতিয়ে ক্যারিয়ারের একমাত্র অপ্রাপ্তি ঘুচিয়েছেন মেসি

আশপাশের এলাকা দেখে কাটিয়ে দিলেন তাঁরা৷ তাঁরা যখন ব্যর্থ মনোরথে ফিরে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন এল কাঙ্ক্ষিত সেই বার্তা। ফিরছেন রেক্সাস। এরপর মেসিকে নিয়ে গেলেন তাঁর বাবা। মেসি মাঠে নামার কয়েক মুহূর্তের মধ্যে নিয়ে নিলেন নিজের সিদ্ধান্ত। জানিয়ে দিলেন ‘ওকে দলে নাও।’ এ কথা বলার সময় তাঁর মনের মধ্যে বিন্দুমাত্র দ্বিধা ছিল না। ১৪ ডিসেম্বর বারের একটি ন্যাপকিনের পেপারে স্বাক্ষর করা হয় তাঁর প্রথম চুক্তি, যা আনুষ্ঠানিকভাবে সম্পন্ন করা হয় ২০০১ সালের মার্চে। মেসির পাশে থাকতে পরিবারও বার্সেলোনায় এসে থাকা শুরু করল।

পেশাদার ফুটবলারদের জন্য সবচেয়ে বড় যন্ত্রণা হচ্ছে একাকিত্বের যন্ত্রণা। ফাঁকা মাঠের নিঃসঙ্গতা কিংবা হোটেল রুমের একাকিত্ব জেঁকে ধরে তাঁদের। মেসিকেও যেতে হয়েছিল এমন পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে। একপর্যায়ে মনে হচ্ছিল বার্সেলোনা একটি বিরক্তিকর শহর। তাঁর ভাইয়েরও একই অবস্থা দেখে মেসির মা তাঁদের দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। যদিও সেটা মোটেই সহজ ছিল না। অনেক সময় মেসি বাথরুমে নিজেকে বন্দী করে কাঁদতেন। একদিন হোর্হে মেসি সিদ্ধান্ত নিলেন সবাইকে নিয়ে দেশে ফিরে যাবেন। কিন্তু জীবনের গল্প তো এত সরল নয়।

যদিও মেসির যন্ত্রণা ছিল সীমাহীন। মানুষের সঙ্গে মিশতে পারেন না। এমন জায়গায় বসতেন যেন কারও সঙ্গে কথা বলতে না হয়। সে সময়কার মেসিকে নিয়ে লিওনার্দো ফাসিও লিখেছেন, ‘বল ছাড়া সে এমন একজন দুর্দান্ত খেলোয়াড়, যার ভেতর থেকে ব্যাটারি খুলে ফেলা হয়েছে।’

মুখচোরা ছেলেটি তাই নিঃসঙ্গতার জ্বালা মেটাতে বলের সঙ্গে কথাই বলা শুরু করল। এমনকি নিজের ইশারায় বলকেও কি বলাতেন না! সেই যে সখ্য হলো, জীবনের উত্থান-পতনের গল্পে বলটিই যেন চিরতরে জড়িয়ে গেল। সেই বলকে বুকে জড়িয়েই লিখেছেন হাসি-কান্না অনেক গল্প। কখনো কান্নাভেজা চোখে বিদায় বলতে চেয়েছেন, আবার কখনো হিমালয়ের মতো মাথা উঁচু করে তুলে ধরেছেন শিরোপাও।

যে ছেলেটি একদিন স্বপ্নের বাইসাইকেল পেতে বাথরুমের দরজা ভেঙে মাঠে এসেছিল, তাঁর হাতেই উঠেছে ফুটবলে জেতা সম্ভব এমন সবকিছু। আর আজকের অষ্টম ব্যালন ডি‘অরটি যেন কেকের ওপর ছোট্ট চেরিটি। কে জানে ব্যালন ডি’অরের গল্পটা হয়তো আজ রাতে আনুষ্ঠানিকভাবে শেষই হয়ে গেল। মেসিও এখন সবকিছু থেকে অর্জনের মোহ ত্যাগ করে পাড়ি জমিয়েছেন মেজর লিগ সকারে। নিজের জন্য হয়তো নয়, অন্যকে জেতাবেন বলে। ওই যে শুরুতে বলেছি, সূর্য ডোবা শেষ হলেও সূর্যের যাত্রা তো শেষ হওয়ার নয়।!