ডিয়েগো ম্যারাডোনা জাদুবাস্তব এক গল্পের নাম। যিনি উঠে এসেছিলেন লাতিন রূপকথা থেকে। যাঁর পা দিয়ে লেখা হয়েছিল ফুটবলের অসামান্য সব গল্প। বিপরীতে ম্যারাডোনাকে নিয়েও লেখা হয়েছিল অসামান্য সব সাহিত্যগাথা। উরুগুয়ের বিখ্যাত ক্রীড়া সাহিত্যিক ও লেখক এদুয়ার্দো গালিয়ানোও তাঁর বই ‘সকার ইন সান অ্যান্ড শ্যাডো’তে একটা অধ্যায় লিখেছিলেন ম্যারাডোনাকে নিয়ে। ম্যারাডোনার মৃত্যুবার্ষিকীতে সেই অধ্যায়ের নির্বাচিত অংশের ভাবানুবাদ—
ডিয়েগো ম্যারাডোনা খেলেছিলেন, জিতেছিলেন, প্রস্রাব করেছিলেন এবং এরপরই হেরে গেলেন। সেদিন তাঁর মূত্রের নমুনায় তারা পেয়েছিল এফিড্রিনের উপস্থিতি এবং তাঁকে ছুড়ে ফেলা হয়েছিল ১৯৯৪ বিশ্বকাপ থেকে। যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্য অনেক দেশে এফিড্রিনকে খেলোয়াড়দের শক্তিবর্ধক কোনো ওষুধ বলে গোনায় ধরত না। তবে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতাগুলোতে এটিকে নিষিদ্ধের তালিকাতেই রাখা হয়েছিল।
এ বিতর্ক ছড়িয়ে পড়তেই স্তব্ধ হয়ে পড়ে চারপাশ। সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে কেলেঙ্কারির নানা কেচ্ছাও। বোমার মতো নৈতিকতার পতনের শব্দে সেদিন কানে তালা লেগে গিয়েছিল সবার। এরপরও আহত নায়কের পক্ষে কিছু আওয়াজ উঠেছিল বটে। যে আওয়াজ শুধু স্তব্ধতার চাদরে ঢেকে যাওয়া মাতৃভূমি আর্জেন্টিনাতেই শুধু নয়, এর ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছিল সুদূর বাংলাদেশেও। ফিফার বিরুদ্ধে আন্দোলনে গর্জে উঠেছিল দেশটির রাজপথ। দাবি ছিল, অনতিবিলম্বে মাঠে ফিরিয়ে আনতে হবে ম্যারাডোনাকে।
সত্যি কথা হচ্ছে, বিচার করে কাউকে শাস্তির মুখে ঠেলে দেওয়া কি আর এমন কঠিন কিছু! আর এটাও ভুলে যাওয়া উচিত হবে না যে বছরের পর বছর ধরে সেরা হওয়ার অপরাধ তো ম্যারাডোনার ছিলই। ক্ষমতাবানেরা যেসব কথাকে চাপা দিয়ে রাখতে চান, সেসব কথা গড়গড় করে বলে ফেলার পাপও তো ম্যারাডোনা করেছিলেন। একই সঙ্গে বাঁ হাতে খেলার পাপও যে তিনি করেছিলেন, সেটাই–বা কীভাবে ভুলি! অক্সফোর্ড ডিকশনারি বাঁহাতিদের সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে লিখেছিল, এটা শুধু ‘বাঁ হাত নিয়েই নয়’; বরং ‘অশুভ ও সন্দেহজনক’ ব্যাপারও বটে।
ডিয়েগো ম্যারাডোনা কখনো খেলার আগে শক্তি বাড়ানোর জন্য শক্তিবর্ধক ওষুধ সেবন করেননি। তবে এটাও সত্যি যে তিনি কোকেনে আসক্ত ছিলেন। কিন্তু কোকেন তিনি নিতেন বিষণ্ন-বিমর্ষ পার্টিগুলোতে গিয়ে, যেখানে হয় তিনি সব ভুলে যেতে চাইতেন কিংবা বিস্মৃত করে রাখতে চাইতেন নিজেকেও। কারণ, তিনি চাপা পড়ে গিয়েছিলেন খ্যাতির নিচে। কিন্তু এর বাইরে যাওয়ার সুযোগও তাঁর ছিল না। এই টানাপোড়েন তাঁকে একদণ্ড শান্তিতে বাঁচার সুযোগও দিচ্ছিল না। ম্যারাডোনা অবশ্য কোকেন নিয়েও যে কারও চেয়ে ভালো খেলতেন কিন্তু তাঁর ভালো করার কারণ কখনোই কোকেন ছিল না।
ম্যারাডোনা একসময় নিজের ব্যক্তিত্বের ভারেই ন্যুব্জ হয়ে পড়েন। যেদিন থেকে ভক্তরা তাঁর নাম ধরে গান গাইতে শুরু করে, তার অনেক আগে থেকেই মেরুদণ্ডের হাড়গুলো ব্যথার ভারে বেঁকে গিয়েছিল। ম্যারাডোনাকে বহন করতে হয়েছিল ‘ম্যারাডোনা’ নামটার ওজনও, যা তাঁর পিঠের আকৃতিই বদলে দিয়েছিল। তাঁর শরীরটাই তখন হয়ে উঠছিল আলাদা এক রূপক—পাগুলো যন্ত্রণাক্লিষ্ট, ঘুমানোর সময় ওষুধ ছাড়া এক করতে পারতেন না চোখের পাতা।
অল্প সময়েই তিনি বুঝে গিয়েছিলেন, মাঠে ঈশ্বর হয়ে বেঁচে থাকা কঠিন। কিন্তু তিনি এটাও জানতেন যে হাল ছাড়া যাবে না। অনেক বছর ধরে অতিমানবীয় পারফরম্যান্সের কারণে যন্ত্রণার বাবলে আটকে থাকার পর তিনি বলেছিলেন, ‘আমি চেয়েছিলাম তাদের আকাঙ্ক্ষিত হতে।’ তখন কোর্টিজন ইনজেকশন, ব্যথানাশক ওষুধ আর প্রশংসার তোড় তাঁকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে রাখত। উল্টো রথে ভক্তদের প্রত্যাশার চাপে চিড়েচ্যাপটা হওয়ার পাশাপাশি যাঁদের তিনি জ্বালিয়ে মেরেছিলেন, তাঁদের ঘৃণার চ্যালেঞ্জও নিতে হচ্ছিল ম্যারাডোনাকে।
দেবতার মূর্তি ভাঙার যে আনন্দ, তার সঙ্গে নতুন কাউকে একই জায়গায় বসানোর একটা সমানুপাতিক সম্পর্কও আছে। স্পেনে পায়ে বল না থাকার পরও পেছন থেকে তাঁকে আঘাত করেছিলেন গয়কোচিয়া। এরপর ম্যারাডোনাকে বাইরে থাকতে হয়েছিল কয়েক মাস। সেদিনও অনেক প্রতিপক্ষের অনেক অন্ধ সমর্থক ঘটনার প্রতিনায়ককে (গয়কোচিয়া) কাঁধে তুলে উল্লাস করেছিলেন। পৃথিবীব্যাপী আরও অনেক মানুষ তখন তারকাপুঞ্জে হানা দেওয়া এই অনুপ্রবেশকারীর পতনের আনন্দে মাতার অপেক্ষায় ছিলেন। তাঁরা বলেছিলেন, ক্ষুধায় তাড়িত এক ভুঁইফোড় ও মাস্তানের কিসের এত দম্ভ!
ইতালির নেপলসে গিয়ে ম্যারাডোনা হয়ে ওঠেন সন্ত ম্যারাডোনা। আর সন্ত জেন্নারো পরিণত হন সন্ত জেরমান্দোতে। রাস্তায় তখন তাঁরা এই হাফপ্যান্ট পরা দেবতার (ম্যারাডোনা) ছবি বিক্রি করতেন, যাঁকে আলোকিত করে রাখতেন মাতা মেরি স্বয়ং। অথচ তিনি ছিলেন এমন সন্ত, যাঁকে প্রতি ছয় মাস পরপর রক্তাক্ত হতে হতো।
শুধু তা–ই নয়, উত্তর ইতালির ক্লাবগুলো শবাধার ও বোতলে ভরা সিলভিও বের্লুসকোনির অশ্রুও বিক্রি করত। শিশু ও কুকুরেরা ম্যারাডোনার পরচুলা পরে বের হতো। এমনকি কে যেন গিয়ে মহাকবি দান্তের ভাস্কর্যের নিচে একটা ফুটবল রেখেও চলে এসেছিল। আর বিখ্যাত ফোয়ারা ত্রিতোনের গায়ে চড়েছিল নাপোলির বিখ্যাত নীল জার্সিও।
শিশু ও কুকুরেরা ম্যারাডোনার পরচুলা পরে বের হতো। এমনকি কে যেন গিয়ে মহাকবি দান্তের ভাস্কর্যের নিচে একটা ফুটবল রেখেও চলে এসেছিল।এদুয়ার্দো গালিয়ানো, লেখক ও ক্রীড়া সাহিত্যিক
নাপোলি-অগ্নিগর্ভ ভিসুভিয়াস আর ফুটবল মাঠের চিরকালীন হারের ধারাকে যারা নিজেদের নিয়তি বলে মেনে নিয়েছিল। এমনকি তারা কখনো কোনো ট্রফিও জিততে পারেনি। অবশেষে সেই ম্যারাডোনা হলেন তাদের ত্রাতা। তাঁর হাত ধরেই অন্ধকার দক্ষিণ (দক্ষিণ ইতালি) পরাজিত করেছিল শ্বেতশুভ্র উত্তরকে (উত্তর ইতালি)। ইতালির মাঠগুলোর সঙ্গে ইউরোপেও জয়ের ধারা অব্যাহত রেখেছিল তারা। দলটির প্রতিটি গোল প্রতিষ্ঠিত শৃঙ্খলাকে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল, যা ছিল ইতিহাসের বিরুদ্ধে নির্মম এক প্রতিশোধও।
মিলানের ভক্তরা দারিদ্র্যের জন্য তাঁকে প্রচণ্ড ঘৃণা করতেন। তাঁরা তাঁকে বলতেন, ‘কোঁকড়াচুলো ভাঁড়।’ শুধু মিলানই নয়, ১৯৯০ বিশ্বকাপে ম্যারাডোনার পায়ে বল গেলেই দুয়োয় ভরিয়ে দিচ্ছিল গোটা ইতালি। বাঁশি বাজিয়ে কান ঝালাপালা করে মনোযোগ নষ্ট করার চেষ্টা করত তারা। ফাইনালে আর্জেন্টিনা হারার পর তারা এমনভাবে উদ্যাপন করেছিল, যেন জার্মানরা বিশ্বকাপটা তাদের হয়েই জিতেছে।
আর ম্যারাডোনা যখন নাপোলি ছাড়ার কথা জানান, নাপোলির কিছু মানুষ জানালা দিয়ে ছুড়ে দিয়েছিল পেরেকগাঁথা তাঁর মোমের পুতুলগুলো। তিনি সেই শহরে বন্দিদশায় দিন কাটাচ্ছিলেন, যে শহর তাঁকে পাগলের মতো ভালোবেসেছিল। সে সময় কেমোরা নামের এক মাফিয়াগোষ্ঠী ছিল শহরটার মালিক। ম্যারাডোনাকে তখন খেলতে হয়েছিল নিজের হৃদয় ও পায়ের বিরুদ্ধে গিয়ে। আর হঠাৎ করেই ম্যারাডোনা হয়ে উঠলেন মারাকোকা। তিনি তখন এমন একজন দাগি অপরাধী, যারা তাঁকে নায়ক বানিয়েছিল, তাদের ধোঁকা দেওয়ার অপরাধ।
অনুবাদ: হাসনাত শোয়েব