অভিষেকেই কীর্তি গড়লেন এস্তেভা
অভিষেকেই কীর্তি গড়লেন এস্তেভা

অভিষেকেই ব্রাজিলের ‘মেসিনিও’র কীর্তি, ছাড়িয়ে গেলেন রোনালদো–নেইমারকে

‘প্রতিভা’— বহুল ব্যবহৃত এই শব্দটি কৈশোরের বৃত্তে থাকা ফুটবলারদের নামের পাশে প্রায় ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। সবাই যে সেই বিশেষণের দ্যুতিকে সামলে প্রতিভার চূড়ান্ত স্ফুরণ দেখাতে পারেন, তা নয়। অনেকেই এই শব্দের ভার নিয়ে আসেন, কিন্তু ঝরে পড়তেও সময় লাগে না। তবে এর মধ্যেও কেউ কেউ আছে প্রতিবন্ধকতার জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে নিজেকে চেনান। লিওনেল মেসি, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো থেকে শুরু করে হালের কিলিয়ান এমবাপ্পে, ভিনিসিয়ুস জুনিয়ররা এভাবেই আবির্ভূত হয়েছেন ফুটবল মঞ্চে এবং আলো ছড়িয়েছেন।

এই তালিকায় এবার শোনা যাচ্ছে ব্রাজিলিয়ান কিশোর এস্তেভাও উইলিয়ানের নাম। ব্রাজিলের জার্সিতে পঞ্চম সর্বকনিষ্ঠ ফুটবলার হিসেবে আজ অভিষেক হয়েছে এস্তেভাওর। ইকুয়েডরের বিপক্ষে ১–০ গোলে জেতা ম্যাচের দ্বিতীয়ার্ধে বদলি হিসেবে মাঠে নামেন এই কিশোর। ব্রাজিলিয়ান সংবাদমাধ্যম ‘ও গ্লোবো’র দেওয়া তথ্য অনুযায়ী অভিষেকের সময় তাঁর বয়স ছিল ১৭ বছর ১৩৫ দিন। যা তাঁকে ব্রাজিলের জার্সিতে মাঠে নামা সর্বকনিষ্ঠ ফুটবলারদের মধ্যে যৌথভাবে শীর্ষ পাঁচে জায়গা করে দিয়েছে। এই তালিকায় তাঁর ওপরে পেলে, এদু, কুতিনিও ও এনদ্রিক। এস্তেভাওর মতো ১৭ বছর ১৩৫ দিনে অভিষেক হয়েছিল সাবেক ফুটবলার ওয়াল্টারের।

এই তালিকায় শীর্ষ নামটিই যে ব্রাজিলের ফুটবলের সবচেয়ে বড় নাম, তা কোনো সন্দেহ নেই। ১৯৫৭ সালের ৭ জুলাই আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ম্যাচে দিয়ে অভিষেক হয়েছিল পেলের। সে সময় তাঁর বয়স ছিল ১৭ বছর ২৫৭ দিন। সেই ম্যাচে ২–১ গোলে হারলেও, সেদিন পেলের পারফরম্যান্স তাঁর আগমনী বার্তা ঠিকই দিয়েছিল। সেই ম্যাচ থেকেই মূলত অমরত্বের পথে অবিশ্বাস্য যাত্রা শুরু করেন ‘ফুটবলের রাজা’। এখন পর্যন্ত বয়সের দিক থেকে অভিষেকে পেলেকে ছাড়িয়ে যেতে পারেননি অন্য কোনো ব্রাজিলিয়ান।

পেলের পর এদু। ১৯৪৯ সালে জন্ম নেওয়া এই ফুটবলারের অভিষেক হয় ৫ জুন ১৯৬৬ সালে, তখন তাঁর বয়স ১৬ বছর ৩০৩ দিন। পোল্যান্ডের বিপক্ষে তাঁর অভিষিক্ত ম্যাচে ব্রাজিল জিতেছিল ৪–১ গোলে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এদুকে সান্তোসে আনার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল পেলেরই। পেলের সঙ্গে মিলেই খেলেছিলেন ১৯৬৬ ও ১৯৭০–এর বিশ্বকাপ। এর মধ্যে ১৯৭০ সালে বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়নও হন এদু। পেলের বিদায়ের পর খেলেছিলেন ১৯৭৪ বিশ্বকাপেও। যদিও সেবার আর সাফল্য ধরে রাখতে পারেননি।

তৃতীয় কুতিনিও অবশ্য হালের কুতিনিও নন। এই কুতিনিওর জন্ম ১৯৪৩ সালে। আর অভিষেক হয় ১৯৬০ সালের ৯ জুলাই, বয়স তখন তাঁর ১৭ বছর ২৮ দিন। আগের দুজনের মতো অভিষেকের সময় কুতিনিওর ক্লাব ছিল সান্তোস। পরবর্তীতে সান্তোসের (৪৫৭ ম্যাচে ৩৬৮ গোল) হয়ে খেলা সর্বকালের সেরাদের একজনও হন কুতিনিও। দলের আক্রমণভাগে পেলের সঙ্গে দুর্দান্ত এক জুটিও গড়ে তোলেন এ স্ট্রাইকার। ১৯৬২ বিশ্বকাপে দলের হয়ে শিরোপা জিতলেও মাঠে নামতে পারেননি। চোটের কারণে জায়গা হারান ভাভার কাছে। ধারাবাহিকভাবে হাঁটুর আঘাত অবশ্য কুতিনিওর পুরো ক্যারিয়ারকেই ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল।

পরের নামটি একেবারেই সর্বসাম্প্রতিক, এনদ্রিক। এই মুহূর্তে যাঁদেরকে ব্রাজিলের ফুটবল ভবিষ্যৎ হিসেবে ভাবা হচ্ছে, এনদ্রিক তাঁদের অন্যতম। গত বছর অভিষেকের সময় তাঁর বয়স ছিল ১৭ বছর ১১৮ দিন। অভিষেকের পর বেশ কিছু রেকর্ড ভেঙেছেন এনদ্রিক। যদিও কোপা আমেরিকায় ব্যর্থতার কারণে সমালোচিতও হয়েছেন। সম্প্রতি রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে অভিষেকেই করেছেন গোল। সব মিলিয়ে এনদ্রিক এই মুহূর্তে ব্রাজিলের ফুটবলের অন্যতম ভরসার প্রতীক। সামনে হয়তো এস্তেভাওর সঙ্গে দারুণ এক জুটিও গড়ে উঠতে পারে তাঁর।

এনদ্রিকের ঠিক পরেই আজ জায়গা করে নিয়েছেন এস্তেভাও। ইকুয়েডরের বিপক্ষে ম্যাচের ৬২ মিনিটে লুইজ হেনরিকের বদলে মাঠে নামেন পালমেরাইসে খেলা এই উইঙ্গার। এর মধ্য দিয়ে তিনি পেছনে ফেলেছেন নেইমার ও রোনালদো নাজারিওকে। ম্যাচে বিশেষ পার্থক্য গড়তে না পারলেও জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ার সুযোগ পেয়েছেন এই কিশোর। তবে এটা কেবলই শুরু। এখনো তাঁর সামনে পড়ে আছে দীর্ঘ পথ।

মাঠে নামছে এস্তেভাও

এর আগে গত বছরের শুরুর দিক থেকে বেশ ভালোভাবে আলোচনায় আসেন এস্তেভাও। যদিও মাত্র ১০ বছর বয়সে তাঁর মধ্যে লুকিয়ে থাকা প্রতিভার দ্যুতি ঠিকই বুঝতে পেরেছিল বিশ্বখ্যাত ক্রীড়াসরঞ্জাম প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান নাইকি। ব্রাজিলিয়ান সম্ভাবনাময় ফুটবলারদের প্রতি নাইকির এই আগ্রহ অবশ্য একেবারেই নতুন নয়। রোনালদো থেকে ভিনিসিয়ুস—প্রায় সবারই হয়েছিল এমন অভিজ্ঞতা। তবে একটা দিক থেকে তাঁদের সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন এস্তেভাও।

নাইকির সঙ্গে পেশাদার চুক্তি করা ব্রাজিলের সর্বকনিষ্ঠ ফুটবলার পালমেইরাসের বয়সভিত্তিক দলের এই উইঙ্গার। তিনি এখন ‘মেসিনিও’ নামেই পরিচিত। খেলার ধরন মেসির মতোই বলেই তাঁকে দেওয়া হয়েছিল এই তকমা। পাশাপাশি মেসির প্রতি তাঁর অনুরাগও বেশ প্রবল। যদিও এই নাম নিয়ে নিজের অস্বস্তির কথাও বলেছিলেন তিনি, ‘আমাকে এস্তেভাও উইলিয়ান নামে ডাকলেই খুশি হব। কারণ, ওটাই আমার নাম। লোকে ওই তকমা দিয়েছে। কারণ, আমি মেসিকে খুব পছন্দ করি।’

হ্যাঁ, এটা তো সত্যি যে মেসি হওয়া মোটেই সহজ নয়। এস্তেভাও নিজেই হয়তো অন্য কারও নামের ছায়ায় ঢাকা পড়তে চাইবেন না। নিজের নাম নিয়ে নিজ গুণেই জ্বলে উঠতে চাইবেন তিনি। আজ ম্যাচ শেষে এস্তেভাও বলেছেন, ‘জাতীয় দলের হয়ে অভিষেক হওয়ায় আমি খুবই আনন্দিত। এটা আমার শৈশবের স্বপ্ন ছিল, আমার পরিবারেরও। জয় দিয়ে আমার অভিষেক হওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। আমি আমাদের সেরাটা দিয়েছি এবং সামনেও আরও কঠিন পরিশ্রম করব।’

ব্রাজিলকে সঠিক পথে ফেরাতে এনদ্রিক–এস্তেভাওদের মতো তরুণদেরই এগিয়ে আসতে হবে। বেশ কিছু দিন নিজেদের ঐতিহ্য হারিয়ে ধুঁকছে ব্রাজিলের ফুটবল। এমনকি ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের যে নান্দনিকতা, সেটাও হারিয়ে গেছে। এখন এনদ্রিক-এস্তেভারা সুদিন ফেরাতে পারেন কি না, সেটাই দেখার অপেক্ষা।